খাতুনগঞ্জের ক্ষতি বাড়াতে পারে পণ্যের দাম

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৭, ২১:৫১ | প্রকাশিত : ২৬ জুলাই ২০১৭, ১৯:৪৫

প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে ভাসছে চট্টগ্রামের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। পাল্লা দিয়ে চলছে বর্ষণ। আর তাতে ব্যবসা লাটে উঠছে ব্যবসায়ীদের। পানিতে ভিজে পণ্য নষ্ট হওয়ায় কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে ইতিমধ্যে কেউ কেউ সর্বস্বান্ত।

গতকাল বুধবার সর্বোচ্চ জোয়ারের পানিতে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নষ্ট হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আর এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগামী দিনে এসব পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

ব্যবসায়ীদের এই পরিণতির প্রধান কারণ ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’ বলে পরিচিত চাক্তাই খাল। জোয়ারের সময় এই খাল উপচে পানি ওঠে; কিন্তু ভাটায় নামে না সেই পানি। আর বৃষ্টির পানি ধারণ করতে না পেরে ভাসিয়ে দেয় নগর। অথচ এই চাক্তাই খাল একসময় চট্টগ্রামের নৌ-বাণিজ্যের ধমনি ছিল। এখন তা ভরাট হয়ে ব্যবসায়ীদের কান্নায় পরিণত হয়েছে।

চার-পাঁচ বছর ধরে শীতকাল ছাড়া বছরের আট মাস জোয়ারের পানিতে দেড়-দুই ফুট পানির নিচে ডুবে থাকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। শুরুর দিকে জলে ভিজে ক্ষতির অভিজ্ঞতা থেকে ব্যবসায়ীরা দোকানের সামনে তিন-চার ফুট উঁচু দেয়াল তুলেছিলেন। কিন্তু এই বাড়তি দেয়াল এখন আর পানি ঠেকাতে পারছে না। দিন দিন জলাবদ্ধতার উচ্চতা বাড়তে বাড়তে তা পাঁচ-ছয় ফুট দাঁড়াচ্ছে। দেয়াল উপচে পানি ঢুকছে আড়তে।

গতকাল বুধবার যেমনটা হয়েছে। আগের রাতের টানা বৃষ্টির পানি দুপুর থেকে কমতে থাকলেও বিকেলের দিকে হঠাৎ জোয়ারের পানি বাড়তে থাকে। এক সময় তা ছয়-সাত উচ্চতায় ভাসায় নগরীর অনেক জায়গা। তার সঙ্গে বৃষ্টির পানি মিশে আজ বুধবারও ভাসছে নগরী।

আজ বিকেলে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা যায়, চাল, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা, নারকেল, মসল্লাসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানের ভেতরটা জোয়ারের পানিতে ভাসছে। ডাল, চিনি ও সাবান গলে ভাসছে পানিতে। শুঁটকিপট্টি, ডালপট্টি, তেলপট্টি গলিতেও অথৈ জল। অধিকাংশ দোকানের কর্মচারীরা পণ্য রক্ষার কাজে ব্যস্ত। মালিকরা হতাশ চোখে বসে আছেন চৌকির ওপর।

ব্যবসায়ী ও নগর বিশেষজ্ঞরা জানান, পানি উপচানোর আরেক কারণ চাক্তাই খাল ভরাট হয়ে যাওয়া। প্লাস্টিক জাতীয় আবর্জনায় চাক্তাই খালের তলা প্রায় ৫-৬ ফুট ভরাট হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বঙ্গোপসাগরে জোয়ারের প্রবণতা। জোয়ারের সময় পানি খাল উপচে প্রবেশ করার পর চার-পাঁচ ঘণ্টা পানিতে ডুবে থাকতে হয়। জোয়ার কমলেও পানি আর নামে না।

এই সংকটের সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে অতিবৃষ্টি। গত সপ্তাহের শেষের দিকে শুরু হওয়া টানা বর্ষণে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এ বৃষ্টিতে অন্তত সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার মালামাল ভিজে নষ্ট হয়েছে বলে জানান চাক্তাইয়ের ব্যবসায়ী নেতা সিদ্দিকুর রহমান। সিদ্দিকুর বলেন, ‘গতকাল মঙ্গলবার হঠাৎ প্রবল জোয়ারে খাতুনগঞ্জের তিন হাজার দোকান পানিতে তলিয়ে গেছে। একদিনেই প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে। এভাবে পানিতে ডুবে থাকলে এবং জোয়ার ওঠা-নামা চলতে থাকলে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ছেড়ে ব্যবসায়ীদের পালাতে হবে।’

আদা-রসুন ও পিঁয়াজের বড় আমদানিকারক মেসার্স ফরহাদ ট্রেডিং। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ব¡াধিকারী নুর মোহাম্মদ বলেন, গতকাল মঙ্গলবার খাতুনগঞ্জে সর্বোচ্চ উচ্চতায় জোয়ারের পানি ওঠে। চার-পাঁচ ঘণ্টার জোয়ারের পানিতে কম-বেশি সব দোকানে পানি ঢুকেছে। তার মতে, ১৯৯১-এর প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের পর এবার সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় পানি হয়েছে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে।

গত কয়েক দিনের বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে নূর মোহাম্মদ বলেন, এই ক্ষয়ক্ষতির কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে, যা সবশেষে ভোক্তাদের ঘাড়ে পড়বে।

চাক্তাইয়ের চাল ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সভাপতি ওমর আজম বলেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে সাড়ে তিন হাজারের বেশি দোকান আছে। ৯০ শতাংশ দোকানে পানি ঢুকে ভোগ্যপণ্য নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, ‘চালের গুদাম নিচতলায় বলে সব কটিতে পানি ঢুকেছে। এ ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে উঠব বুঝতে পারছি না।’

একটি চালের আড়তের কর্মচারী জানান, সূর্য উঠলে রোদে শুকিয়ে অনেক পণ্য নতুনভাবে বস্তাবন্দি করে বাজারজাত করবেন অনেক ব্যবসায়ী। তবে সেসব পণ্যের গুণমান আর বজায় থাকবে না।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সৈয়দ সগীর আহমেদ বলেন, চার দিনের টানা বর্ষণ আর জোয়ারের পানি কাঁদিয়েছে ব্যবসায়ীদের।

তিনি বলেন, খাল-নদী সব দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য ব্যবসায়ীরা দাবি জানিয়ে এলেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রতি বছর বর্ষাকালে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হচ্ছে উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের এ সমস্যা আঞ্চলিক নয় জাতীয় সমস্যা হিসেবে নিয়ে সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে।

চাক্তাই খালের সংস্কার এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী সমাধান করা না গেলে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসা লাটে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ মকরেন সৈয়দ সগীর আমেদ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের গুদামে পানি প্রবেশের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির অজুহাতে দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।

বুধবারের হঠাৎ বিপর্যকর জোয়ারের বিষয়ে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, গতকাল জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮ ফুটের মতো ছিল। ফলে জোয়ারের পানি ঢোকে লোকালয়সহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকায় নিচতলার প্রায় সব দোকান, গুদাম কিংবা আড়তে জোয়ারের পানি ঢোকে।

(ঢাকাটাইমস/২৬জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বন্দর নগরী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা