স্কুল-কলেজে বর্ষাকালীন ছুটি ঘোষণা করা হোক

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৬ জুলাই ২০১৭, ২২:৩৯

বিশ্বের যে কোনো স্থানে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্ভাবনা থাকে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের। গ্রাম হোক আর শহরই হোক, বর্ষাকালে বাংলাদেশে জনজীবন নিয়মিতভাবে স্থবির হয়ে পড়ছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি, বানের পানি, বন্যা, বাঁধ ভেঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যাওয়া, জলাবদ্ধতা, রাস্তা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা সংকটে দেশজুড়ে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করে। ছোট-বড় সকলেই এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ স্থবিরতা। শহরের ছেলে-মেয়েদের একটা অংশ পাকা দালানের ঘরে থেকে, রেস্টুরেন্টে বাবা-মার সাথে খেয়ে, মার্কেটে ঘুরে সময় কাটিয়ে দিতে পারলেও গ্রামের বন্যা কবলিত শিশু, কিশোর-কিশোরীদের বর্ষাকালীন কষ্ট অবর্ণনীয়।

বর্ষা তাই শুধু গ্রামের সমস্যা নয়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মত বড় শহরেও মানুষের জীবনে এখন অসহনীয় রকমের বিড়ম্বনা আর কষ্টের শেষ নেই। বন্যায়, জলাবদ্ধতায় যেখানে শারীরিকভাবে সুস্থ বড় মানুষদের জন্যই চলাফেরা কঠিন, সেখানে স্কুল-কলেজে পড়া ছেলে-মেয়েদের দুর্ভোগের কথা বলাই বাহুল্য। ‘দুর্যোগ-বিহীন’ স্বাভাবিক ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে বিপদের শেষ নেই, সেখানে বৃষ্টি-বাদলার দিনে সাধারণ মানুষ রাস্তায়, ফুটপাতে এবং অনেকে ঘরের ভেতরে পর্যন্ত নিরাপদ নন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষ বৃষ্টির দিনে ঘরের ভেতরেই বন্দী হয়ে থাকেন। এমনদিনে স্কুল-কলেজে যদি ছেলে-মেয়েদের ক্লাস-পরীক্ষা থাকে তাহলে অবস্থা কী পরিমাণ নাজুক হয়ে পড়ে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই অনুভব করতে পারেন।

বর্ষাকাল ঠিকমত আসার আগেই দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগসহ পুরো দেশের নানা নিম্ন এলাকায় বর্ষা ও বৃষ্টির পানি-জনিত সংকট দেখা দেয়। ভারত থেকে আসা বানের পানি, অতিবৃষ্টির ফলে বাঁধ ভেঙ্গে এবার সিলেট, নেত্রকোনা, শেরপুরের মানুষের ফসলি জমি তলিয়ে গেছে, স্কুল-কলেজ ডুবে গেছে। স্বাভাবিক বৃষ্টিতেই ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের অবস্থাসম্পন্ন মানুষ, সরকারি দপ্তরের লোকজন গাড়ি ফেলে নৌকা কেনা শুরু করেছেন। কিন্তু যাদের রিকশা ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য নাই, তাদের অবস্থা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। শক্ত-সমর্থ মানুষ যদিও কোনোমতে অফিস করতে পারছেন, বাইরে কাজ করতে যেতে পারছেন, শিশুরা পারছেনা। এই অবস্থায় স্কুল-কলেজগুলো খোলা রেখেছেন আমাদের সরকার বাহাদুর। গ্রামের শিশুদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায় আমাদের নীতি-নির্ধারকদের। দিনের পর দিন স্কুলে যেতে না পেরে কত শিশুর স্কুলজীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, কত শিশুর পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ মরে যাচ্ছে তার হিসেব কি আমাদের নাগরিক এই নীতি-নির্ধারকরা কখনো ভেবেছেন?

কত স্কুল-কলেজ ভবন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, কতগুলো স্কুল-কলেজ ভবন, মাঠ তিন/চার মাস ধরে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত আছে সে হিসেব কি আমাদের সরকারি আমলা, জনপ্রতিনিধিরা রেখেছেন? মানুষের জীবন নিয়ে যেখানে টানাটানি, সেখানে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা এক প্রকার বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। একবার স্কুল থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেললে শিশুদের আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনা কত কঠিন তা অভিজ্ঞরা ভালোই জানেন। বর্ষার সিজনে দেশের শত শত স্কুল ভবন নষ্ট হয়ে যায়। এমনিতেই দেশের সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ভবনগুলোর অধিকাংশের জরাজীর্ণ অবস্থা। এক বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেরামত করতে করতে আরেকটি বর্ষা চলে আসে। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা টিকে আছে। টিকে থাকে ঠিকই, কিন্তু রুগ্ন অবস্থায়।

ঢাকা বা চট্টগ্রামের বিত্তশালী পরিবারগুলোর ছেলে-মেয়েরা গাড়ি দিয়ে তাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যাওয়া-আসা করলেও তাদেরও কষ্ট হয়। তারা নিজেরা যেমন ট্রাফিক জ্যামে বিরক্তি নিয়ে বসে থাকে, আবার তারা শহরের অন্য কোটি মানুষের কষ্টের কারণ হয়। বাংলাদেশে শহরে ট্রাফিক জ্যামের অন্যতম প্রধান কারণ এই প্রাইভেট গাড়িগুলো। যেহেতু স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও শহরে কোনো গণপরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করা যায়নি, বিত্তবানরা ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে ছেলে-মেয়ের স্কুলে-মার্কেটে আনা-নেয়া করেন। যাদের সামর্থ্য নাই গাড়ি কেনার, তারাও সময়ের অপেক্ষা করেন নিজেদের একটা গাড়ি কেনার। যাদের কখনোই সামর্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের ও বাচ্চাদের জীবন নিয়ে সৃষ্টিকর্তার ওয়াস্তে চলাফেরা করেন। কখনো রিকশা উল্টে যায়, কখনো রাস্তার গর্তে পড়ে যান, কখনো ম্যানহোলে পড়ে অক্কা পান। এভাবেই চলে শহরে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও অন্য মানুষের জীবন।

তাই সরকার বাহাদুরের কাছে আকুল আবেদন থাকবে, সারা দেশে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বর্ষাকালীন ছুটি ঘোষণা করা হোক। শুধু এবার নয়, স্থায়ীভাবে। কারণ বর্ষাকালে ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা দেশের গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে ভালো হবে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। বাঁধগুলো এভাবেই বানের পানিতে ভেসে যাবে, এভাবেই বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। সরকার বাহাদুর আরেকটা কাজ করতে পারেন। স্কুল-কলেজের একাডেমিক ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করতে পারেন। বর্ষা আসার আগেই বছরের পড়ালেখা শুরু ও শেষ হয়ে গেলে, বড়, ছোট সবারই কষ্ট কমে যাবে। শিশুদের জীবন সহজ করার দায়িত্ব এ রাষ্ট্রের।

লেখকঃ শিক্ষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :