মহানবী (সা.)- কে নিয়ে লন্ডনে যা বলেছিলেন ফরহাদ মজহার

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৮ জুলাই ২০১৭, ২২:৩৩

ফরহাদ মজহারকে নতুন প্রজন্ম কতটুকু জানে? জানলেও কীভাবে জানে? সম্প্রতি তিনি ঢাকা থেকে ‘নিখোঁজ’ হয়ে খুলনায় উদ্ধার হয়ে বারবার মিডিয়ায় বড় খবর হয়ে এসেছেন। পরিবারের দাবি অনুযায়ী তাকে ‘অপহরণ’ করা হলেও একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, তিনি খুব স্বাধীনভাবে ঢাকার বাড়ি থেকে বের হয়েছেন ভোরে। আবার খুলনার ফুটেজে দেখা গেছে তিনি স্বাধীন ও সাবলীলভাবে হাঁটাহাঁটি করছেন। তদন্তে বের হয়ে এসেছে, অর্চনা নামের এক হিন্দু নারীর সাথে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আছে। অন্তঃসত্ত্বা অর্চনাকে টাকা দিতে তিনি নিজেই নাটক সাজিয়েছিলেন বলে গণমাধ্যম ও পুলিশের তদন্তে বের হয়ে এসেছে। এর আগেও দেখা গেছে, মূর্তির সামনে বসে আছেন ফরহাদ মজহার। সাংবাদিক প্রভাষ আমিন ‘ফরহাদ মজহারকে গ্রেপ্তার করা হোক’ শীর্ষক এক কলামে লিখেছেন, “পুলিশ ফরহাদ মজহারের কললিস্টের সূত্র ধরে চট্টগ্রাম থেকে অর্চনা নামে ‘উবীনিগ’ এর এক সাবেক কর্মীকে ধরে এনেছে। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। অনেকে অবশ্য অর্চনাকে এ যুগের জজ মিয়া বলতে চাইছেন। কিন্তু ফরহাদ মজহারকে যারা চেনেন, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যারা জানেন; তারা কিন্তু অর্চনার গল্প অবিশ্বাস করেননি। বরং অর্চনার মত আরো অনেকের নাম বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ফরহাদ মজহার নাকি অর্চনাকে নিয়মিত টাকা দিতেন। অপহরণের দিনও তিনি অর্চনাকে বিকাশে টাকা পাঠিয়েছেন। বাসার বাইরে থাকা ১৮ ঘণ্টা সময়ে তিনি ফরিদা আখতারের সঙ্গে যেমন ৬ বার টেলিফোনে কথা বলেছেন, অর্চনার সঙ্গেও ৬ বার কথা বলেছেন।

ফরহাদ মজহার কেন এই নাটক করলেন, এই প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব এখনও নেই। তবে বাতাসে নানা কথা। ‘উবীনিগ’ এর নাকি তার নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই শিথিল হয়ে গিয়েছিল। পর্যাপ্ত অর্থও পাচ্ছিলেন না। তাই অর্চনাদের জন্য ফরিদা আখতারের কাছ থেকে টাকা বের করতেই তিনি এই অপহরণ নাটক সাজিয়েছেন”।

মূর্তির সামনে বসে থাকা, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক চর্চা করা ফরহাদ মজহার যখন ইসলাম ধর্মের কথা বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহম্মদ (সা.) নিয়ে কথা বলেন, তখন বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষকে নড়েচড়ে বসার যথেষ্ট অবকাশ আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। এদেশের সাধারণ মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবেই অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপ্রিয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে এবং ঘোষণায় সংঘটিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুসলমানদের রয়েছে ঐতিহাসিক অবদান। আরবের ইসলাম আর স্থানীয় বাঙালি সমাজের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে এক অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ এক সমাজ ও সভ্যতা। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয়, প্রগতিশীল মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য লন্ডনে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে ওয়াটার লিলি গার্ডেনে সিটিজেন্স মুভমেন্ট ইউকে নামের এক সংগঠন আয়োজিত সেমিনারে ফরহাদ মজহার যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার লিখিত রূপের আজ তৃতীয় কিস্তি দেয়া হল। তিনি বলেছিলেনঃ

“ আমাকে আপনারা দার্শনিক বলেন। আমি জানিনা, আজও আমরা দার্শনিক হতে পেরেছি কি না? আমি একটা জিনিস, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, যদি আমরা আমাদের স্বার্থ শুধু মুসলমান আকারে দাবি করি, তাহলে আমরা বিশ্বসভায় টিকবনা, জিততে পারবনা। আমরা সম্প্রদায় আকারে, ঈমান-আকিদার লড়াই আকারে, আমরা মুসলমান, আমাদের মুসলমানের স্বার্থ আছে, এতে কোন সন্দেহ নাই, কারণ আমরা মজলুম। আফগানিস্তানের দিকে যদি তাকাই, সিরিয়ার দিকে যদি তাকাই, লিবিয়ার দিকে যদি তাকাই, বাংলাদেশের দিকে তাকাই, আমরা বুঝতে পারি, যেখানেই ইসলাম আজ একটা প্রধান ধর্ম, সে এলাকায় মুসলমানদের উপর নির্যাতন চলছে, তাদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার চলছে। সুতরাং আমরা মজলুম, তাহলে মুসলমানদের একটা স্বার্থ আছে, সে স্বার্থ অনস্বীকার্য। এই স্বার্থের জায়গায় দাঁড়িয়ে মুসলমানদের পক্ষে কথা বলা অবশ্যই দরকার, এতে কোনো সন্দেহ নাই। আমাদের ঈমান-আকিদা রক্ষার লড়াই গুরুত্বপূর্ণ। আমি বারবার আমার লেখায় বলেছি, আমাদের যারা ঈমান-আকিদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশে লড়াই করছেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ, ন্যায়সংগত লড়াই, এমনকি আধুনিক নীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে, আধুনিক গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, আপনার ধর্মের স্বাধীনতা স্বীকৃত, আপনারা লন্ডনের দিকে তাকান, আপনারা এই দেশে দেখেছেন সেটা। বাংলাদেশেও যখন অধিকারের জন্য লড়াই করি, সেটা স্বীকৃত। কিন্তু আমি একটা ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। যদি আমরা শুধু মুসলমান আকারে আমাদের স্বার্থের কথাটা বলি, আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে। আর সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে এই যে, ইসলাম তো শুধু মুসলমানদের জন্য আসে নাই। আপনারা কি একমত আমার সঙ্গে? (ঠিক ঠিক বলে রব)। যদি শধু মুসলমানদের জন্য না এসে থাকে, তাহলে আমাদের সকলের জন্যই ইসলামের কথা বলতে হবে, বলবার ভাষা বাইর করতে হবে এবং এইদেশে খ্রিস্টিয়ানিটি, আপনাকে কিন্তু খ্রিষ্ট ধর্মের কথা বলে আপনাকে খ্রিস্টান ডাকে নাই, সে আপনাকে গণতন্ত্রের কথা বলে, আপনি বিশ্বাস করেন; সে আপনাকে আধুনিকতার কথা বলে, আপনি বিশ্বাস করেন; সে আপনাকে সভ্যতার কথা বলে, আপনি বিশ্বাস করেন। কিন্তু যে সভ্যতার কথা বলে সেটা গ্রিক- খ্রিস্টীয় সভ্যতা, আপনি মেনে নেন আপনার অজ্ঞানতার জন্য; আপনি জানেন না, কোনটা খ্রিস্টীয় সভ্যতা, কোনটা আপনার সভ্যতা।

খ্রিস্টীয় সভ্যতার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নাই। রোমানরা ছিল একসময়, গ্রিকরা ছিল একসময়, গ্রিক সভ্যতা ছিল, খ্রিস্টীয় সভ্যতা ছিল, তাদের অবদান আছে। আমি একজন জন্মসূত্রে মুসলমান। হযরত ঈসা আমার নবী; ফলে কেন আমি খ্রিস্টানদের ঘৃণা করব? কী দরকার আছে? ওরাতো মিল্লাতে ইব্রাহিমের অন্তর্ভুক্ত, আমি মিল্লাতে ইব্রাহিমের অন্তর্ভুক্ত। ফলে তার সাথে (খ্রিস্টানদের) বন্ধুত্ব পাতানো, সম্পর্ক তৈরি করা, শক্তিশালী করা আমার কর্তব্য। কিন্তু সে যদি দাবি করে, সে যেমন করে জীবন ও জগতকে বুঝেছে, সেটাই একমাত্র বুঝ, এর বাইরে আর কোনো বুঝ নাই, ইসলামের কিছু দেবার নাই সভ্যতাতে, ইসলামকে যদি তারা বর্বরতার ধর্ম সে যদি বলে; সে যদি বলে, আপনি ইসলামের কথা বললে আপনি সন্ত্রাসী হয়ে যাচ্ছেন, তাহলে আমি যদি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, তার বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই জিহাদের জন্য তৈরি। নিঃসন্দেহে ইসলাম একটি সভ্যতার নাম। তাহলে এটার পার্থক্য আমাদের করতে হবে, শেখাবার দায়িত্ব আমাদের, আমরা যারা মুসলমান। আমাদের বুঝতে হবে ইসলাম একটা সভ্যতার নাম। কেউ খ্রিস্টান হতে পারে, হিন্দু হতে পারে, বৌদ্ধ হতে পারে। কিন্তু তোমার কাছে আমি একটা বাণী নিয়ে আসছি, তোমার কাছে আমি একটা নতুন কথা শোনাতে আসছি, তোমার কাছে নতুন সভ্যতার কথা শোনাতে আসছি, যেটা তোমার চেয়ে উদার, অগ্রসর, তোমার চেয়ে অনেক অনেক বেশী ইসলামের বুক অনেক বড়। এটা বুঝাতে হবে। আমার উদ্বিগ্নতা, আমার উৎকণ্ঠা আপনারা বুঝেছেন। যদি আমরা বুঝে থাকি, তাহলে আমাদের ঈমান-আকিদার জায়গাটা আমাদের রাখতে হবে, আলেম-ওলামারা আছেন। একই সঙ্গে, এই তরুণদের, যাদেরকে এখানে দেখছি, তাদের একেকজনকে দার্শনিক হতে হবে। আমাকে দার্শনিক বলছেন আপনারা, তাই আমি আপনাদের আহবান করছি, দার্শনিক হওয়ার জন্য। যদি জিজ্ঞাসা করি, ইসলামকে একজন খ্রিস্টানের কাছে দার্শনিক আকারে কীভাবে বলবেন?

আমরা ব্যক্তিতন্ত্রে বিশ্বাস করিনা, আমাদের সমাজ আগে, ব্যক্তি পরে। অন্য সভ্যতায় ব্যক্তি আগে, সমাজ পরে। আমরা উম্মায় বিশ্বাস করি, শুধু মুসলিম উম্মায় না। সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা আমরা মনে করি। এটা আমাদের প্রকল্প, আমাদের রাজনৈতিক প্রকল্প। ইসলাম শুধু অন্য ধর্মের মত, শুধু ধর্ম আকারে আসে নাই। আমরা আমাদের নবীকে রসুল আকারে জানি, তাকে একজন রাজনীতিবিদ আকারেও জানি। জানি কি না? (জানি জানি বলে মজলিশ থেকে চিৎকার)। তাহলে রাজনীতিবিদ হতে গেলে, তাঁর কাছ থেকে শিখতে হবে রাজনীতি কাকে বলে। তাহলে ইসলামিক রাজনীতি বলে একটা রাজনীতি আছে। এটা অন্য পলিটিশিয়ান থেকে একটু ভিন্ন রকম। তার মধ্যে ঔদার্য আছে, আপোষ আছে, সন্ধি আছে,। আছে না সন্ধি?

তিনি দার্শনিকও ছিলেন। তিনি জ্ঞানের প্রতিভূ ছিলেন এবং তিনি মুসলমানদের জন্য আসেন নাই, আপনারা যতই আমার উপর রাগ করেন। তিনি হচ্ছেন রাহমতল্লিল আলামিন হিসেবে, তিনি দুনিয়ার সকলের জন্য এসেছেন। এবং তিনি মানুষের জন্যও আসেন নাই। পশু-পাখি কীট-পতঙ্গ, দুনিয়ার যত সৃষ্টি, সকলের জন্য তিনি রহমত আকারে এসেছেন। তাদের প্রতি কতটুকু রহমত আমরা প্রদর্শন করি বলেন? আজকে বিদেশিরা আমাদের এনভায়রনমেন্ট শেখায়। আমাদেরকে ইকোলজি শেখায়। শেখায় না? আমরা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে এনভায়রনমেন্ট পড়ি, ইকোলজি পড়ি। আমরা দেখি তো। ছেলে-মেয়েরা আমার কাছে আসে, ফরহাদ ভাই আমি এনভায়রনমেন্ট শিখব। আমি তাকাই থাকি, বলি, ভালো। যদি আমরা ইসলাম শিখতাম, তাহলে আলাদা করে এনভায়রনমেন্ট এর কথা বলতে হতনা। যদি আমি ইসলাম বুঝতাম, তাহলে আলাদা করে ইকোলজি বুঝতে হত না।

আমি বাংলাদেশে যখন গেছি, আমি আপনাদের মত নর্মাল লোক না, আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি বুঝতে পেরেছি, আমাকে যদি সত্যিকার অর্থে মুমিন হতে হয়, তাহলে আমার কিছু কর্তব্য আছে। প্রথম কর্তব্য হল এই, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছে, মানুষ করে না, সৃষ্টি করেছে খলিফা হিসেবে। আমি যদি ভুল করে, তাহলে বলবেন আমাকে। আমি অত জ্ঞানী না, অল্প অল্প বুঝি। খলিফা করে তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। খলিফা হিসেবে আমি এতটুকু বুঝি, তার অবর্তমানে তার সৃষ্টিকে হেফাজত করা আমার কর্তব্য। ...ইসলাম অনেক বিশাল ব্যাপার। ইসলামের ভেতরে আমরা ঢুকতেই পারি নাই। এবং ঢুকব বলে বাংলাদেশটা আমাদের কব্জায় (মুঠো করে সবাইকে দেখান) রাখতে চাই। আমাদের একটা রাষ্ট্র দরকার। আমাদের একটা ক্ষমতা দরকার। আমরা সেই জায়গায় বহু কষ্টে দু’শ বছর লড়াই করে ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয়েছি, দেশ স্বাধীন করেছি। এরপরে ১৯৭২ সালে আবার দেশকে স্বাধীন করতে হয়েছে। এটার উপর দখল নাই। আমাদেরকে তারা বিতাড়িত করে ফেলতেছে। কী বলে? মুসলমান বলে আমাদের বিতাড়িত করতেছে। ফলে আমি প্রতিবাদ করেছি... (চলবে)।

লেখকঃ গবেষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :