আঠারোবাকি ও চিত্রাতীরের মানুষের মুখে হাসি

ফরহাদ খান, নড়াইল
 | প্রকাশিত : ৩০ জুলাই ২০১৭, ০৮:২০
ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত আঠারোবাকি ও চিত্রা নদী পুনঃখননে হাসি ফুটেছে নড়াইলসহ তিন জেলার লাখো মানুষের মুখে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর প্রাণ পেয়েছে এই দুই নদীর ৮৬ কিলোমিটার নৌপথ। এ ছাড়া নদীসংলগ্ন ৩৩টি খালের ৮৯ কিলোমিটার অংশ পুনরুর্জীবিত হয়েছে। ১৩টি বিলের পানি নিষ্কাশনের মধ্য দিয়ে নিরসন হচ্ছে নড়াইল, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলের ৪৩ হাজার হেক্টর জমির জলাবদ্ধতা।

এদিকে, ৫৭ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ আঠারোবাকি নদীর ৩২ কিলোমিটার অংশে সৃষ্টি করা হয়েছে মিঠাপানির জলাধার। প্রায় ৩০ বছর পর আঠারোবাকি এবং ২০ বছর পর চিত্রা নদী পুনঃখননের মধ্য দিয়ে নদী অভ্যন্তরীণ এবং আশপাশের জীববৈচিত্র্য সজীব হয়ে উঠেছে।

২০১১ সালে খুলনা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঠারোবাকি ও চিত্রা নদী পুনঃখনন ও জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলন। দুই বছর আগে ২০১৫ সালের জুনে প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯ দশমিক ১৫০ কিলোমিটার চিত্রা নদীর পুনঃখনন কাজ শেষ হয়।

আঠারোবাকি নদীর সংযোগস্থল খুলনার তেরখাদা উপজেলার ছাগলাদহ ইউপি কার্যালয় এলাকা থেকে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পাটনা পর্যন্ত চিত্রা নদী পুনঃখনন করা হয়। নদীর দুই পাড়ে সামাজিক বনায়নের আওতায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। পুনঃখননের মাটি দিয়ে নদীর কোল ঘেঁষে প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করে পাঁকা করা হয়েছে।

আর আঠারোবাকি নদী পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) নড়াইল ও খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নড়াইলের নড়াগাতি থানার চাপাইলঘাট থেকে খুলনার রূপসা উপজেলার আলাইপুর ব্রিজ পর্যন্ত ৪২ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার পুনঃখনন এবং রূপসার নন্দনপুর এলাকা থেকে আলাইপুর ব্রিজ পর্যন্ত সাত কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করা হচ্ছে। ৫৭ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর বাকি আট কিলোমিটারে নাব্য থাকায় সেটুকু পুনঃখনন বা ড্রেজিং করা হচ্ছে না।

ইতোমধ্যে আঠারোবাকি নদী পুনঃখনন ও ড্রেজিংয়ের ৫৫ ভাগ কাজ এবং ৩৩টি খাল পুনঃখননের ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে আঠারোবাকি নদীর বিভিন্ন স্থানে ব্রিজ নির্মাণ এবং নদীর দুই পাড়ে সামাজিক বনায়নসহ রাস্তা তৈরি করা হবে।

একটি স্লুইসগেট নির্মাণসহ আঠারোবাকি নদী পুনঃখনন ও ড্রেজিং কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি ৪০ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ‘খুলনা জেলার ভূতিয়ার বিল এবং বর্ণাল-সলিমপুর-কোলাবাসুখালী বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন (২য় পর্যায়) প্রকল্প’-এর আওতায় আঠারোবাকি নদী পুনঃখনন ও ড্রেজিং এবং স্লুইসগেট নির্মাণ চলছে। কাজটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট (বিডিপি) লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্পের অধীনে আঠারোবাকি নদী পুনঃখননসহ ১০টি কাজ রয়েছে। এগুলোর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি ৯০ লাখ ১৬ হাজার টাকা। ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর একনেকে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটি সরকারি অর্থায়নে ২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা।

প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও এরই মধ্যে চিত্রা ও আঠারোবাকি নদী এবং খাল পুনঃখননের সুফল পেতে শুরু করেছেন নড়াইল, বাগেরহাট ও খুলনা জেলার লাখ লাখ মানুষ। বদলে গেছে নদীবর্তী এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা।

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পাখিমারা গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ফুলমিয়া বলেন, ‘আঠারোবাকি নদী অনেক ডাঙ্গর (বড়) ছিল। স্টিমার পর্যন্ত চলত। স্বাধীনতার পর নদী আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে যায়। এখন নদী কাটায় আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। এতে কৃষিজমির জলাবদ্ধতা দূর হবে।’ আঠারোবাকি নদী মরে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছিল বলে জানান চরবল্লাহাটি গ্রামের নূর ইসলাম খান। সেই সমতল ভূমি কেটে নদীকে যৌবনা করা হচ্ছে। নদীর পানি দিয়ে কৃষকেরা শুষ্ক মৌসুমে ধান, পাট, পানের বরজসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করছেন।

বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার চুনখোলা ইউপি সদস্য মিরাজ শরীফ বলেন, আঠারোবাকি নদী খননের ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশাপাশি নোনা পানি থেকে রক্ষা পাবে ফসলি জমি।

পানি নিয়ে আগেকার কষ্টের কথা উল্লেখ করে চুনখোলা গ্রামের হেনা বেগম বলেন, ‘এখন নদীর পানি পরিষ্কার। এ পানি দিয়ে রান্নার কাজ, গোসলসহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে ব্যবহার করছি।’

নদী পুনঃখনন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সূত্রে জানা যায়, আটটি স্কেভেটর মেশিন দিয়ে আঠারোবাকি নদী পুনঃখনন করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে।

বাপাউবো খুলনার তেরখাদা অঞ্চলের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ) পলাশ কুমার ব্যানার্জি জানান, জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে আঠারোবাকি নদীর বিভিন্ন স্থানে ব্রিজ করার জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া নদীর দুই পাড়ে সামাজিক বনায়ন এবং রাস্তা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

আঠারোবাকি নদীটি নড়াইলের নড়াগাতি থানার চাপাইল সেতু এলাকার মধুমতি নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে খুলনা জেলার জেলখানাঘাট নামক স্থানে রূপসা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। বাপাউবো খুলনা বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শরীফুল ইসলাম বলেন, নদীর প্রায় ৩২ কিলোমিটার অংশে মিঠাপানির জলাধার থাকছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নড়াইল এবং খুলনা জেলার ভূতিয়ার বিল, পদ্ম বিল, বাসুখালী বিল, কোলা বিল, কেটলা বিল, সলিমপুর বিল, কালিয়া বিল এবং আশপাশের অন্যান্য বিলের পানি নিষ্কাশনের ফলে জলাবদ্ধতা দূর হবে। এ ছাড়া আঠারোবাকি নদীর সংযোগস্থল থেকে নড়াইলের কালিয়ার পাটনা পর্যন্ত ২৯ দশমিক ১৫০ কিলোমিটার চিত্রা নদী পুনঃখনন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণ এর সুফল পেতে শুরু করেছেন বলে জানান প্রকৌশলী।

বাপাউবো সূত্র জানায়, খুলনা জেলার ভূতিয়ার বিল এবং বর্ণাল-সলিমপুর-কোলাবাসুখালী বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন (২য় পর্যায়) প্রকল্পের ১০টি কাজের মধ্যে ইতিমধ্যে পাউবোর তত্ত্বাবধানে চিত্রা নদী পনুঃখনন, পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ, কালিয়ার পাটনা, ভোগবাগ ও তেরখাদার লস্করপুর এলাকায় তিনটি স্লুইসগেট নির্মাণ, ৬৫ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন কাজ এবং নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কোদলা ও মসুনদিয়া এলাকায় দুটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। কাজ চলছে কালিয়া উপজেলাসহ খুলনার তেরখাদা, দিঘলিয়া ও রূপসা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩৩টি অভ্যন্তরীণ নিষ্কাশন খাল পুনঃখনন এবং নয়টি স্লুইসগেট ও রেগুলেটর মেরামত।

প্রকল্পের আওতায় আরো রয়েছে তেরখাদার কোদলা ও মসুনদিয়া বিলে টিআরএম (পলিবাহিত পানি এনে তলদেশে উঁচু করা, যাতে দ্রুত পানি নিষ্কাশন হয়) পরিচালনা, টিআরএম পরিচালনার জন্য শস্য ক্ষতিপূরণ, নড়াইলের কালিয়া উপজেলার নবগঙ্গা ও মধুুমতি নদী এলাকায় ৩ দশমিক ১১২ কিলোমিটার স্থায়ী তীর সংরক্ষণ এবং পাটনা, চাপাইল ও ভোগবাগ এলাকায় রেগুলেটরসহ ছয়টি স্লুইসগেট নির্মাণকাজ। ২৮১ কোটি ৯০ লাখ ১৬ হাজার টাকার এই ১০ প্রকল্পের সব কটির কাজ ২০১৮ সালের জুনে শেষ বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

(ঢাকাটাইমস/৩০জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :