বিএনপির ওপর কওমিপন্থিদের বিশ্বাসে ‘ভাঙন’

প্রকাশ | ৩০ জুলাই ২০১৭, ১০:৫৩ | আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭, ১২:৩৩

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
ইসলামী ঐক্যজোটের ইফতারে খালেদা জিয়া, এমন ছবি দেখা যাচ্ছে না আর

ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কে নতুন মোড় নিয়েছে। এক যুগেরও বেশি সময় জোটের শরিক হিসেবে রাজনীতি করে আসা এবং আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনাকারী একটি কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রীক দলের নেতারা সম্প্রতি কঠোর সমালোচনা করেছেন বিএনপির। এরা আবার কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রীক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও।

বিএনপির প্রতি কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রীক ও হেফাজত সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস নড়বড়ে হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে সরকারি ঘোষণা আসার পর বিএনপির কোনো কোনো নেতার প্রতিক্রিয়ায় খুশি হতে পারেননি কওমিপন্থিরা। আবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভাস্কর্য অপসারণ বিষয়ে বিএনপির সুষ্পষ্ট কোনো বক্তব্য না থাকাতেও হতাশ হয়েছেন কওমিপন্থিরা। আবার স্থানীয় নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোকে সন্তোষজনক আসনে ছাড় না দেয়াও হতাশার তৃতীয় কারণ।

সর্বশেষ ২০ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন হেফাজতের নেতারা। ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে ওই সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে বিএনপি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে এবং বর্তমানে দলটি সহায়ক সরকার নামে পুনরায় নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।

এই সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আবদুল লতিফ নেজামী, যুগ্ম সম্পাদক মুফতি ফয়জুল্লাহ। লিখিত বক্তব্যে নেজামী বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওয়াজ উঠিয়ে বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও ও সন্ত্রাস চালিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ওই সময় নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির পাঁচজন প্রতিনিধিকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়, কিন্তু এতে বিএনপি রাজি হয়নি। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে বিএনপি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে এবং বর্তমানে তারা সহায়ক সরকারের নামে পুনরায় নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।’

নেজামী বিএনপির সমালোচনা করছেন যে ঘটনায়, তার দায় তিনিও এড়াতে পারেন না। কারণ, তখন তার দলও ওই আন্দোলনেই সম্পৃক্ত ছিল।

নেজামীর নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোটের এই অংশটি বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন করে ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি। এই অংশটি আবার রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামেরও অন্যতম শক্তি।

২০১৩ সালের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতের ঢাকা ঘেরাওয়ের সময় ইসলামী ঐক্যজোটের এই নেতারাই সেদিন শাপলা চত্বরে অবস্থান করেছিলেন। নেজামী ও ফয়জুল্লাহ সেদিন সেখানে বক্তব্যও দিয়েছিলেন।

ওই সমাবেশে খাবার-পানি সরবরাহ করে বিএনপি ও তার সমমনারাও। হেফাজতের সমর্থকে এগিয়ে আসতে দেশবাসীকে উদাত্ত আহ্বানও জানান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

ওই দিন শেষে রাতে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত কর্মীরা উচ্ছেদে বাধ্য হওয়ার পর সেখানে ব্যাপক প্রাণহানির গুজব উঠে। আর ওই বছর পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত হারের পেছনে এই গুজবকেও দায়ী করা হয়। হেফাজতে ইসলাম নিজেদেরকে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবি করলেও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়েই বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামে। আর শাপলা চত্বর থেকে উচ্ছেদের সময় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের কাহিনি প্রচার করে আওয়ামী লীগকে কার্যত কুপোকাত করে দেয় তারা।

তবে শাপলা চত্বরে এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ পরে আর প্রমাণ করতে পারেনি হেফাজতে ইসলাম। তারা তালিকা দেয়ার কথা বললেও পরে আর কোনো নাম দিতে পারেনি।

বিএনপির সঙ্গে মাখামাখি করে আসা এই হেফাজত নেতারাই এবার বেঁকে বসেছেন। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল এক সমাবেশে হেফাজতের আমির আহমেদ শফি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, সরকার ও ছাত্রলীগ আমাদের শত্রু নয়, বন্ধু।’ তার এই বক্তব্যের পরই মূলত, বিএনপির সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ফাটলের সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়।

তবে বিএনপি মনে করে ২০১৩ সালে ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থানের ঘটনায় যে তাণ্ডব সৃষ্টি হয় সেই সব ঘটনায় করা মামলা থেকে বাঁচতেই হেফাজতের নেতারা ভোল পাল্টেছেন।

শাপলা চত্বর কাণ্ডে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ পাঁচ জেলায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মোট ৮৩টি মামলা হয়। কেবল রাজধানীতেই মামলা হয়েছিল ৫৩টি। গত চার বছরে পুলিশ ১৫টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে। এর মধ্যে বাগেরহাটে একটি মামলার বিচার শেষ হয়েছে। এতে সব আসামি খালাস পেয়েছেন।

শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে দলের প্রতিনিধি হয়ে যোগ দেওয়া বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, ‘ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের যৌক্তিক দাবির প্রতি আমাদের সমর্থন ছিল এবং থাকবে। আশা করি জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে মাঠে নামলে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো বি‌এনপির পাশে এসে দাঁড়াবে।’

হেফাজত নেতা ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ফয়জুল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, আপনি যে অনুষ্ঠানের কথা বলছেন, সেটা হেফাজতের ব্যানারে নয়, ছিল ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে।

 

কিন্তু আপনারা তো হেফাজত নেতাও- এমন মন্তব্যের জবাবে ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘সেটা আলাদা বিষয়।’

তবে কওমিপন্থি এই নেতা বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্বের বিষয়টি স্বীকার করেন। বলেন, ‘দলের মজলিসে শুরার মত অনুযায়ী আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা দলের বৃহত্তম স্বার্থে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে বক্তব্য দিয়েছি। আমরা মনে করছি এই মুহূর্তে বিএনপি যে কর্মকাণ্ড করছে তা ঠিক নয়।’

‘তবে এই বক্তব্য ইসলামী ঐক্যজোটের। এটির সঙ্গে হেফাজতের কোনো সম্পর্ক নেই।’ আবার বলেন মুফতি ফয়জুল্লাহ।

জানতে চাইলে হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবু নগরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে হেফাজতের দূরত্ব আর ঘনিষ্টতার কিছু নেই। কারণ হেফাজত ইসলামী হচ্ছে অরাজনৈতিক সংগঠন। বিএনপির বিরুদ্ধে যারা বলেছেন তারা ভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে বলেছেন। এর সঙ্গে হেফাজতের কোনো সম্পর্ক নেই।’

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিশেষ কোনো দল, গোষ্ঠী বা সংগঠনের সমর্থন-সহযোগিতার ওপর বিএনপি নির্ভরশীল নয়। বিএনপির মূল শক্তি হলো জনগণ।’

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও কওমি মাদ্রাসাপন্থি ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। একসঙ্গে আন্দোলন ও একসঙ্গে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে গঠন করা হয়।

(ঢাকাটাইমস/৩০জুলাই/এমএম/ডব্লিউবি)