স্টাডি সার্কেল: যেখানে সবাই শিক্ষক সবাই ছাত্র

উম্মে সালমা তানজিয়া
| আপডেট : ৩১ জুলাই ২০১৭, ১৮:৩৪ | প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০১৭, ১৭:৪৬

জনসেবার ২০০ বছরের ঐতিহ্যে লালিত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্ণধার হিসেবে নিয়োজিত হন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ক্যাডারের মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তারা। ভিন্ন ভিন্ন একাডেমিক শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন মেধাবী মুখেরা বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। তাদের অভিভাবক হিসেবে যথাযথ যত্নের মাধ্যমে ২১ শতকের প্রশাসনের উপযুক্ত একজন দক্ষ, সময়োপযোগী, সংবেদনশীল, জনমুখি, সেবাপরায়ণ কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হয় জেলা প্রশাসককেই।

জেলা প্রশাসনের বহুমুখি কর্মপরিধি, কালেক্টরেটের কর্মকর্তা স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে বর্তমানে নবযোগদানকারী একজন শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাস্তব পরিস্থিতির চাহিদা মেটাতে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে এমন সব কর্মযজ্ঞে যার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন তার পক্ষে সুচারুরূপে করা সম্ভব হয় না। পেশাগত এমন অবর্ণনীয় ব্যস্ততার কারণে তার পক্ষে দক্ষতা বৃদ্ধি ও আত্মোন্নয়নের জন্য সময় ব্যয় করাও দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে যে সময়ে তার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে চৌকষ কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের একজন ভবিষ্যৎ নক্ষত্র হয়ে গড়ে উঠার কথা, কিন্তু কর্মের চাপে পিষ্ঠ হয়ে সে চাকরির প্রতিই হয়ে পড়ে বীতশ্রদ্ধ। তার অজ্ঞতাকে শুধরে দিয়ে তাকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলার পরিবর্তে না জেনে-বুঝে করা তার ভুলের জন্য তাকে সইতে হয় গঞ্জনা, যা তাকে আত্মবিশ্বাসহীন করে, ফলে নিজের ওপর যে আস্থাহীনতা কর্মজীবনের প্রথমেই সৃষ্টি হয়, তার ভার তাকে ভবিষ্যত জীবনেও বহন করে চলতে হয়।

উপরের বিষয়গুলোর কথা মাথায় রেখে ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের উদ্ভাবন হলো- ‍‘স্টাডি সার্কেল’ যেখানে একাধারে সবাই শিক্ষক এবং সবাই ছাত্র। ‘স্টাডি সার্কেলে’ প্রতিদিন কর্মকর্তারা বাধ্যতামূলকভাবে সকাল ৯টায় উপস্থিত হন। সেশন চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। এখানে ভাব বিনিময়ের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইংরেজি। দৈনন্দিন কাজ করতে গিয়ে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কর্মকর্তারা যেসব আইনগত, প্রশাসনিক, সামাজিক, ব্যক্তিক সমস্যার সম্মুখীন হন স্টাডি সার্কেলে তা উপস্থাপন করা হয়। চলে আলোচনা। বিষয়ের জটিলতা ও গভীরতা অনুযায়ী আলোচনা চলার কাল প্রলম্বিত হতে পারে একাধিক সেশনে। সার্কেলের সদস্যদের জ্ঞানের অগম্য বিষয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে নিমন্ত্রণ করা হয় প্রশাসন ক্যাডারের বাইরের কর্মকর্তাদেরকেও। জেলা প্রশাসনের তিনটি ক্ষেত্রে (রাজস্ব, সাধারণ ও ম্যাজিস্ট্রেসি) প্রযোজ্য আবশ্যিক আইন-কানুন, বিধি-বিধানের পাশাপাশি স্টাডি সার্কেল আলোচনা করে সমকালীন তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলি, পর্যালোচনা করে কর্মস্থলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি এবং আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করে এসব ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা। এখানে যেকোনো কর্মকর্তার ইতিবাচক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করতে ছোট ছোট প্রণোদনা প্রদান করা হয়, ফলে অন্যরাও ভালো কাজ করতে অনুপ্রাণিত হয়। আবার কোনো একজনের করা ভুলকে এখানে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে না দেখে ইতিবাচক গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে শুধরে দেবার চেষ্টা করা হয়। যা সবাইকেই ওই একই ধরনের ভুল করা থেকে যথাসাধ্য বিরত রাখে। আর ভুল করা কর্মকর্তাটিও নতুন বিশ্বাসে, নতুন উদ্যোমে কাজ করতে উদ্যোগী হয়। স্টাডি সার্কেলের সদস্যরা সবাই বিশ্বাস করে ভুলের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় সৃজনশীল নতুন সম্ভাবনার।

‘স্টাডি সার্কেল’ শুধু একজন কর্মকর্তার জন্য নীরস কোনো একঘেয়ে প্লাটফর্ম নয়, যেখানে শুধু জটিল আইন-কানুন, বিধি-বিধানের আলোচনা হয়। একজন শুভবোধ সম্পন্ন সংবেদনশীল কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তুলতে এখানে করা হয় সাহিত্য চর্চা। মহামানবদের জীবনের যুগান্তকারী ঘটনাগুলো মনোরম উপায়ে উপস্থাপন করা হয়, যা সবাইকে মানবিক গুণাবলী অর্জনে সাহায্য করে। কর্ম ও ব্যক্তিজীবনে শুদ্ধাচার চর্চার তাগিদ দেয়া হয় প্রায় প্রতিটি সেশনের শেষ ধাপে। জেলা প্রশাসনের সব কর্মকর্তাকে যেহেতু সব সময় বিভিন্ন চাপের ভেতরে কাজ করতে হয় সে কারণে ‘Stress-Management’ বিষয়ক নানা উপায় স্টাডি সার্কেলের অন্যতম একটি প্রধান বিষয় হিসেবে অনুশীলন করা হয়ে থাকে।

‘স্টাডি সার্কেলে’ যেকোনো বিষয়ে উপস্থাপন করার জন্য নবযোগদানকৃত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকের রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। প্রশাসনের ৩৫ তম ব্যাচের একজন নবীন কর্মকর্তা এখানে ‘আয়কর রিটার্ন দাখিল’ বিষয়ে উপস্থাপন করে যেমন চমৎকৃত করেন জেলা প্রশাসকসহ সকলকে, তেমনি জেলা প্রশাসকের যেকোনো সাধারণ মানের উপস্থাপনাকেও গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতে পারেন স্টাডি সার্কেলের যেকোনো সদস্য।

ছয় মাস যাবৎ পরিচালিত আলোচিত ‘স্টাডি সার্কেলের’ কার্যকারিতা আসলে কতটুকু?

১। যে সব কর্মকর্তা আগে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন (ভাষাটি তার জানা থাকা সত্ত্বেও) ইতঃস্তত বোধ করতেন, স্টাডি সার্কেলে বিগত ছয় মাস নিয়মিত কথা বলার ফলে তিনি এখন ইংরেজিতে একটি সেশন পরিচালনা করার মতো দক্ষতা অর্জন করেছেন। হয়ত আরও অনেক পথ যেতে হবে আমাদের। তবুও ভয় ভেঙে দিতে পারার এই অর্জনটুকুও কম নয়।

২। আইনসমূহ একাকী পড়ে শেখার মধ্যে আইন বোঝবার যে সীমাবদ্ধতা থাকে, সকলের সাথে শেয়ার করার ফলে সে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়। দশজনের ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যার মাধ্যমে আইন বা বিধিটিকে বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্যালোচনার সুযোগ তৈরি হয়, ফলে একজন কর্মকর্তার মধ্যে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ বিষয়টি ডেভেলপ করে।

৩। উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ICT ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়ায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার একজন অগ্রগণ্য সৈনিক হিসেবে তারা মাঠ থেকেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সবাই শিখছে কিভাবে একটি বিষয়ে তথ্য-সমৃদ্ধ, হৃদয়গ্রাহী প্রেজেন্টেশন তৈরি করা যায়।

৪। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে এখানকার কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত বক্তব্য প্রদান করতে হয়। বক্তব্যের চর্চা না করলে উৎকর্ষ আসে না বলে সার্কেলে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করার সুযোগ রয়েছে। ফলে কর্মকর্তারা সাবলীল ভঙ্গিতে সুভাষণ দেয়ার দক্ষতা অর্জন করতে ক্রমশ সক্ষম হচ্ছে।

৫। স্টাডি সার্কেলে কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ নিয়ে আলোচনা হয় বিধায় সর্বসম্মতভাবে যেকোনো সমস্যার গ্রহণযোগ্য সর্বোত্তম সমাধানটি বের করা সম্ভব হয়।

৬। সর্বোপরি- এ সার্কেলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, সহযোগিতার যে সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে তা ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে তাকে পরমতসহিষ্ণু, পরোপকারি, জনসেবাপরায়ণ এব সংবেদনশীল একজন কর্মকর্তা ও মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে একটু হলেও ভূমিকা রাখবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

‘স্টাডি সার্কেলের’ ধারণাটি নতুন কোনো বিষয় নয়, যুগে যুগে বিভিন্ন আঙ্গিকে এর ব্যবহার ছিল। পুরনো সেই ধ্যান-ধারণাকেই ফলপ্রসূভাবে আত্মোন্নয়নে ব্যবহার করছে ফরিদপুর জেলা প্রশাসন। আমাদের সব কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন তাদের ব্যক্তি ও কর্মজীবনে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এনেছে তাদের প্রিয় ‘স্টাডি সার্কেল’।

লেখক: জেলা প্রশাসক, ফরিদপুর।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :