পুলিশের রক্তে বাঁচে জনতার জীবন

নাঈমুল হাসান রাসেল, বরগুনা
 | প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০১৭, ২০:৪৮

শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চলছে প্রসূতি স্ত্রী রাবেয়া বেগমের অপারেশন। এক ব্যাগ ‘ও’ পজেটিভ রক্তের জন্যে হন্যে হয়ে সারা শহর ঘুরে হতাশ বরগুনার গৌরীচন্না ইউনিয়নের ধুপতি গ্রামের দরিদ্র মোটরসাইকেল চালক সুমন হাওলাদার। রক্তের অভাবে প্রিয় স্ত্রীর জীবন এখন চরম সংকটে। এখানে ওখানে ধন্না দিয়েও কোথাও মেলেনি এক ব্যাগ রক্ত।

হঠাৎই সেই ক্লিনিকে উপস্থিত হলেন বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক। জেলা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার উপস্থিতির কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন ক্লিনিকটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বরগুনার পুলিশ লাইভ ব্লাড ব্যাংকের হয়ে মুমূর্ষু রোগী রাবেয়াকে রক্ত দিতে এসেছেন খোদ পুলিশ সুপার নিজেই। রক্তের প্রাথমিক কিছু পরীক্ষার পর রক্ত দিতে শুয়ে পড়লেন তিনি ক্লিনিকের বিছানায়।

শুধু রাবেয়া বেগমকেই নয়, জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে আসা দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের রোগীদের জরুরি রক্তের প্রয়োজনে বরগুনা জেলা পুলিশের উদ্যোগে স্থাপন করা হয়েছে ‘পুলিশ লাইফ ব্লাড ব্যাংক’।

জেলার ছয় শতাধিক পুলিশ সদস্যের রক্তের গ্রুপ এবং একাধিক জরুরি মোবাইল নম্বর দিয়ে লিফলেট ছপিয়ে তা বিতরণ করা হয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। স্থানীয় দরিদ্র মানুষের জরুরি প্রয়োজনে সক্রিয় এখন সেই ‘পুলিশ লাইফ ব্লাড ব্যাংক’। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বরগুনার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে আসা দরিদ্র পরিবারের জরুরি রোগীদের জন্যে এ পর্যন্ত ১৫৬ ব্যাগ রক্তদান করেছে জেলা পুলিশের এই পুলিশ লাইভ ব্লাড ব্যাংক।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিজন রক্তদাতা পুলিশ সদস্যকে জেলা পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভায় সম্মাননা পুরস্কারসহ একটি টি শার্ট, একটি মগ এবং ১০টি ডাব দিয়ে অনুপ্রাণিত করা হয়। এছাড়া দ্বিতীয়বার রক্তদাতা সদস্যকে প্রেরণা যোগাতে পুলিশ সুপারের ব্যক্তিগত খরচে দেয়া হয় নানা রকমের প্রণোদনা পুরস্কার।

২০১৬ সালের শুরুর দিকে পুলিশ লাইভ ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হলেও ওই বছরই ৩০ নভেম্বর জেলা পুলিশের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্লাড ব্যাংকের উদ্বোধন করা হয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, বরগুনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম। পুলিশ সুপার বিজয় বসাকের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে সেসময় উপস্থিত ছিলেন- বরগুনার সেসময়কার সিভিল সার্জন ডা. মো. রস্তুম আলী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বরগুনা জেলা পুলিশের ৬৩১জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সদস্যের তালিকা প্রকাশ করা হয়।

বরগুনা জেলা কমিউনিটি পুলিশিং-এর সাধারণ সম্পাদক সুখরঞ্জনশীল বলেন, জেলার দশ লাখ মানুষের জন্য জেলা সদরের একটি মাত্র চিকিৎসাকেন্দ্র বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল। নজিরবিহীন চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি এখানে রয়েছে জরুরি রক্তের সংকট। নিভৃত গ্রামাঞ্চল থেকে আসা দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের রোগীদের চিকিৎসা সেবা পেতে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে যেসব ধখল পার হতে হয় তার মধ্যে অন্যতম প্রধান সংকট এটি।

উপকূলীয় উন্নয়ন সংগঠন জাগানোরীর প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা হাসি বলেন, বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাকের উদ্যোগে স্থাপিত পুলিশ লাইভ ব্লাড ব্যাংক এখন সারাদেশের জন্যে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ।

তিনি আরও বলেন, বরগুনায় যোগদানের পর থেকে কমিউনিটি পুলিশিংকে ঢেলে সাজিয়ে নানামুখী সৃজনশীল উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পুলিশি সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন পুলিশ সপিার বিজয় বসাক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বিজয় বসাক বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর বীর সদস্যরাই রক্ত দিয়ে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।

তিনি বলেন, এরপর বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশ পুলিশই সবার আগে রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে চলেছে। তাই রক্তদানের এ ধারাবাহিকতায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন উপকূলীয় জেলা বরগুনার দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের মুমূর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচাতে জেলা পুলিশের উদ্যোগে স্থাপন করা হয়েছে এই ‘পুলিশ লাইফ ব্লাড ব্যাংক’। এ উদ্যোগের মধ্যদিয়ে জনগণের সাথে পুলিশের যেমন সম্পর্কের উন্নয়ন হবে, তেমনি সাধারণ দরিদ্র মানুষের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ আর বৃদ্ধি পাবে বলে আমি মনে করি।

পুলিশ সুপার বিজয় বসাকের সাথে কথা বলে আরও জানা গেছে, সেই ছাত্র জীবন থেকে এ পর্যন্ত ৪০ বারেরও বেশি রক্ত দিয়েছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১৪ জুন পুলিশ সুপার হিসেবে বরগুনায় যোগদান করেন বিজয় বসাক। যোগদানের পর থেকে কমিউনিটি পুলিশিং-এর উদ্যোগে নানামুখী সৃজনশীল কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে পুলিশি সেবাকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলেন তিনি। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীও মূল্যায়ন করেছেন বিজয় বসাকের সৃজনশীলতাকে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট পুলিশ ম্যাডেল (পিপিএম) এবং ২০১২ সালে তিনি অর্জন করেন আইজি ব্যাচ। এছাড়া বরগুনায় যোগদানের পর থেকে এ অবধি একাধিকবার বরিশাল বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপার হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/৩১জুলাই/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :