কাউন্সিলর রুমকির বিরুদ্ধে মাদক-বাণিজ্যের অভিযোগ

প্রতীক ওমর, বগুড়া
| আপডেট : ০২ আগস্ট ২০১৭, ২২:৪১ | প্রকাশিত : ০২ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৪৪

বগুড়ায় কিশোরী ধর্ষণ ও মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনায় সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত পৌর কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকির বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক-বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ বলছে, রুমকির বিরুদ্ধে মাদকসংশ্লিষ্টতার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে তারা।

কিশোরীকে ধর্ষণকারী শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের স্ত্রীর বড় বোন এই রুমকি। অভিযোগ রয়েছে, এই নারী কাউন্সিলর ধর্ষণ ঘটনার বিচারের কথা বলে মা-মেয়েকে ডেকে নেয়ার পর তাদের নির্যাতন ও মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়।

শহরের চকসূত্রাপুর এলাকার বাসিন্দা রুমকি পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী মহিলা কাউন্সিলর। নির্বাচনে জেতার কয়েক দিনের মাথায় বগুড়া আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের হাতে ফুল দিয়ে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেন তিনি। তার ছোট বোন আশার স্বামী তুফান সরকার। তুফানের বড় ভাই মতিন সরকার বগুড়ার বর্তমান সরকারের আমলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের একজন।

মতিন সরকার জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। মঙ্গলবার তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় যুবলীগ।

বোনের স্বামী ও তার ভাইয়েরা ক্ষমতাধর হওয়ায় রুমকিও একপর্যায়ে শহরের বিভিন্ন অন্ধকার কারবারে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। কাউন্সিলর হওয়ার আগে থেকেই বোনজামাইয়ের মাদক বিক্রির তথ্য তার জানা ছিল। কাউন্সিলর হওয়ার পর তিনিও এই কারবারে জড়িত হন। পুলিশের কাছে তাদের পুরো তথ্য থাকলেও এত দিন তাকে কেউ কিছু বলেনি।

তুফানের ভাই মতিন সরকার মাদকের অবৈধ কারবারের অভিযোগে একাধিকবার পুলিশের হাতে আটক হন। তিনি র‌্যাবেরও তালিকাভুক্ত মাদক বিক্রেতা। একটি মামলায় তার ২৭ বছরের সাজাও হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সাজা এখন স্থগিত। পরিবহনে চাঁদাবাজি ও রেলের জায়গা দখলের অভিযোগ আছে মতিনের বিরুদ্ধে।

শহরের মাদকের স্পটগুলোর মধ্যে সেউজগাড়ী, মালতিনগর, জলেশ্বরীতলা, চেলোপাড়া, তিনমাথা, চারমাথা, জরুহুল নগর, পুরান বগুড়া এলাকায় অবাধে মাদকের কেনাবেচা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এর মধ্যে বাদুড়তলা, চকসূত্রাপুর এবং নামাজগড় এলাকার মাদকের কারবার দেখাশোনা করেন রুমকি। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, পুলিশ এসব জানলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযান চালায়নি।

বগুড়া জেলা বাসদের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম পল্টু বলেন, ‘বগুড়া শহরের পুরো মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন রুমকি এবং তার পরিবারের লোকজন। তাদের নানা অপরাধকর্মের ভয়ে এত দিন তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পায়নি।’

রুমকিদের ভয়ে কারো মুখ না খোলার কথা নিশ্চিত করেন বগুড়া জেলা সহকারী পুলিশ সুপারও (এ সার্কেল)। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রুমকি গ্রেপ্তারের পর তার সম্পর্কে অনেক তথ্য আসছে। তারা মাদকসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলেও ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলেনি। আমরা রুমকির মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’

যেভাবে জড়ান রুমকি

গত ১৭ জুলাই শহর শ্রমিক লীগের সভাপতি তুফান সরকার কলেজে ভর্তি করে দেওয়ার কথা বলে ওই কিশোরীকে বাসায় ডেকে নেন। এরপর দিনভর তাকে আটকে রেখে কয়েক দফা ধর্ষণ করেন। এতে ওই কিশোরী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনাটি ওই কিশোরীর মা জানতে পারেন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তুফান সরকারের স্ত্রীর কানে যায়। এরপর শুক্রবার বিকেলে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন তার বড় বোন রুমকি ও মা রুমী বেগম ওই কিশোরী ও তার মাকে অমানবিক নির্যাতন চালায়। পরে তাদের দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেয় তারা।

এই ঘটনা প্রথমে স্থানীয় মানুষের মাঝে জানাজানি হলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে খবর গেলে ঘটনার নায়ক তুফানসহ তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই দিন রাতে পাবনা থেকে আটক করা হয় রুমকিকে। রুমকি বর্তমানে চার দিনের পুলিশি রিমান্ডে আছেন। রুমকিসহ অন্য আসামিরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। আর কিশোরীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন তুফান।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, তাদের সহযোগী সংগঠনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দলটি কেন্দ্রীয়ভাবে একটি তদন্ত দল বগুড়ায় পাঠাবে। কবে নাগাদ পাঠাবে তা এখনো জানা যায়নি।

এদিকে জেলা বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছে সেখানে চিকিৎসাধীন মা ও মেয়ের। জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাস, অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা পবন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শাহ মেহেদী হাসান হিমু, শহর যুবদলের সভাপতি মাসুদ রানা, শ্রমিক দল নেতা লিটন শেখ বাঘা প্রমুখ। জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, বর্বরোচিত এই নির্যাতন সভ্য সমাজে মেনে নেয়া যায় না। তিনি সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এ ঘটনার প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান।

আবার রিমান্ডে তুফান, স্ত্রী ও শাশুড়ি

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, তুফানসহ তিনজনের রিমান্ড মঙ্গলবার শেষ হয়। বুধবার তাদের আদালতে হাজির করে আবার রিমান্ড চাওয়া হয়। তুফান ও তার সহযোগী মুন্নার দুই দিন এবং স্ত্রী আশা ও শাশুড়ি রুমির এক দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

এেিদক ধর্ষণের শিকার কিশোরী এবং তার মাকে আদালতে হাজির করে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, নারী শিশু আদালত-১ এর পিপি আমানুল্লাহ ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী এবং তার মাকে সেভ হোমে রাখার আবেদন করেছেন আদালতে। আদালত আগামীকাল সেই আবেদনের শুনানি দিতে পারে।

ফুঁসে উঠেছে বগুড়ার মানুষ

কিশোরীকে ধর্ষণ ও মা-মেয়েকে নির্যাতনের ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে বগুড়ার সাধারণ মানুষ। ধর্ষক ও তার সহযোগীদের বিচারের দাবিতে আজ বুধবারও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন শহরে বিক্ষোভ, মানববন্ধন করেছে। এদিকে পুলিশ ওই মামলার এজাহারভুক্ত ১০ আসামির মধ্যে নয়জন এবং সন্ধিগ্ধ আরো দুজনসহ ১১ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়া শহরের সাতমাথায় বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, সিপিবি-বাসদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্টি বগুড়া জেলা সংসদ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, সমাজ তান্ত্রীক ছাত্র ফোরাম।

অপরদিকে শহরের নবাববাড়ী রোডে জেলা বিএনপি ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। সমাবেশে বক্তরা ধর্ষণ ঘনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করেন।

(ঢাকাটাইমস/২আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :