বিউটি বোর্ডিং এর অন্দর বাহির

ইয়াকুব ভুইয়া, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৩ আগস্ট ২০১৭, ০৮:১৩

একটা বাড়ি কী করে একটি দেশের, একটি ভাষার সাহিত্য সংষ্কৃতির ইতিহাসের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে থাকতে পারে তার সবচেয়ে জলজ্যান্ত উদাহরণ বিউটি বোর্ডিং।

পুরান ঢাকার বংশাল মোড়ের যানজট পেরিয়ে খানিকটা এগুলেই ভিক্টোরিয়া পার্ক। আর পার্কের পাশের রাস্তা ধরে কিছুটা দূর সামনে এগুলেই শ্রীশদাস লেন। এই লেনের এক নাম্বার বাড়িটিই বিউটি বোর্ডিং।

বাড়িটি ছিল জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। লোকজন জমিদার বাড়ি বলেই চিনত। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় জমিদার সুধীর চন্দ্রের পরিবার ভারতে চলে যায়। তখন এখানে গড়ে ওঠে একটি ছাপাখানা। সে সময় এখান থেকেই প্রকাশিত হত সোনার বাংলা নামের একটি পত্রিকা। দেশ ভাগের পর সোনার বাংলা পত্রিকাটির অফিস কলকাতায় চলে গেলে জমিদারের কাছ থেকে জায়গাটি বুঝে নেন নলিনী মোহন সাহা ও তার ভাই প্রহ্লাদ সাহা। তারপর সোনার বাংলা প্রেসের জায়গায় নলিনী মোহন সাহা তার বড় মেয়ের নামানুসারে স্থাপন করেন বিউটি বোর্ডিং নামে আবাসিক ও রেস্তোঁরা।

এই বিউটি বোর্ডিংকে কেন্দ্র করেই পরে বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির রেনেসাঁ ঘটে। বিউটি বোর্ডিং ও এর আড্ডার ইতিহাস চল্লিশের দশক থেকেই সুখ্যাতি লাভ করেছিল। সমমনা লোকদের তখন নানা বিষয় নিয়ে চলত তোলপাড় করা সব আড্ডা।

অনেক কবি সাহিত্যিকেরই এভাবে লেখা তৈরির বহু ইতিহাস রয়েছে এই বিউটি বোর্ডিংয়ে। এক সময় এখানে কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সমর দাশ, সত্য সাহা, গোলাম মুস্তফা, খান আতা, জহির রায়হান, বেলাল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি ইমরুল চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শফিক রেহমান, ফয়েজ আহমদসহ শিল্প সাহিত্যের বহু বিখ্যাত মানুষ আড্ডা দিতেন বিউটি বোর্ডিং এর অন্দরে।

টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, যাদু শিল্পী জুয়েল আইচেরও দেখা মিলত বিউটি বোর্ডিং এর আড্ডায়।

চলচ্চিত্র শিল্পের কিংবদন্তি আব্দুল জব্বার এখানে বসেই লেখেন বাংলার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ এর চিত্রনাট্য। প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস বাংল ভাষার বহু বিখ্যাত গানের সুর সৃষ্টি করেছিলেন এখানে আড্ডা দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে।

ফিকে হয়ে যাওয়া হলদে ভবনটি এই কিংবদন্তিদের পদচিহ্ন বুকে নিয়ে আজো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো দাড়িয়ে আছে।

অবশ্য সময়ের সাথে সাথে কিছুটা বদলও এসেছে এখানে। মূল ফটকের উপরে হাতে লেখা সাইন বোর্ডের পাশপাশি লেগেছে ডিজিটাল সাইন।

মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ মাত্রই চোখে পড়বে ফিকে হয়ে যাওয়া হলদে রঙের দোতলা বাড়িটা। বাড়ির সামনে সবুজে ঘেরা প্রশস্ত উঠান। দেখলেই বোঝা যায় জম জমাট আড্ডা দেবার এটাই সবচেয়ে উপযোগী জায়গা। পাশে শোবার ঘর, খাবার ঘর, পেছনে সিঁড়ি ঘর ও উপাসনালয় সবই যেন রূপকথার গল্পের মতো করে সাজান। কিছু সময়ের জন্য মনে হবে যেন অতীতে হারিয়ে গেছেন।

প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে খাবার ঘর। সারি সারি টেবিল চেয়ার পাতা। প্রতিটিতে স্টিলের বড় থালা আর গ্লাস রাখা। একসময় এখানে পিঁড়িতে বসে মেঝেতে থালা রেখে খাওয়ানো হতো। খাবার ঘরটিতে ঢুকার সাথে সাথেই বাহারি সব খাবারের ঘ্রানে জিবে জল এসে পড়বে। খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত, ডাল, সবজি, শাকভাজি, ভর্তা, বড়া, চড়চড়ি, সরিষা ইলিশ, রুই, কাতলা, বাইলা, তেলাপিয়া, চিতল, পাবদা, ফলি, সরপুটি, শিং, কৈ, মাগুর, ভাংনা, চিংড়ি, চান্দা, বোয়াল, কোরাল মাছ, আইড় মাছের ঝোলের মতন নানান সুস্বাদু পদ।

এসব দিয়ে তৃপ্তি করে খাবেন। সেই তুলনায় বিল যে খুব বেশি আসবে তাও না। বিউটি বোর্ডিংএ বসে ইলিশের স্বাদ নিতে চাইলে খরচ করতে হবে ১৮০ টাকা। মুরগি ও খাসির মাংস ১০০, খিচুড়ি প্রতি প্লেট ৪০ টাকা, পোলাও ৫০ টাকা, সবজি ৩০ টাকা, বড়া ১০, চচ্চড়ি ৩০ আর একবাটি মুড়িঘণ্ট মিলবে মাত্র ৭০ টাকায়।

বোর্ডিংএ রয়েছে সব মিলিয়ে ২৭ থাকার ঘর। এর মধ্যে ১৭ টি সিঙ্গেল বেড ও ১০ টি ডাবল বেড। সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ২০০ টাকা আর ডাবল রুম ৪০০ টাকা।

এখন অবশ্য সেই আড্ডা আর বসে না বিউটি বোর্ডিং এ। হলেও খুব কম। দেখলে অনেকে হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না এখান থেকেই মোড় ঘুরে গিয়েছিলো একটি দেশের সাহিত্য সংষ্কৃতির। সৃষ্টি হয়েছিল অন্য এক জাতিসত্ত্বার যার মূলে ছিলো আড্ডাবাজ একদল মানুষ।

(ঢাকাটাইমস/০৩অগাস্ট/ইবিআর/কেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :