তুফান গ্রেপ্তারে বগুড়ায় স্বস্তি-অস্বস্তি

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
| আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০১৭, ০৮:২০ | প্রকাশিত : ০৬ আগস্ট ২০১৭, ০৮:১৪

সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনায় তুফান এবং তার সহযোগীরা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বগুড়া জুড়ে স্বস্তির হাওয়া বইছে। তবে সেই স্বস্তির নিঃশ্বাস মানুষ গোপনে নিলেও প্রকাশ্যে খুশির আমেজ দেখাতে ভয় পাচ্ছে।

এই ভয় থেকেই আবার একটা গুমোট অবস্থাও বিরাজ করছে বগুড়ায়। সুনসান নীরবতা সাধারণ মানুষের মাঝে। বিশেষ করে তুফন-মতিনের এলাকা চকসূত্রাপুর, নামাজগড়, বাদুড়তলা এলাকায় চলছে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছেন বগুড়া আওয়ামী লীগের একটি অংশও।

তুফানের গ্রেপ্তারে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে শহরের ২০ হাজার গরিব অটোরিকশাচালক। রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন আর তাদের চাঁদা দিতে হচ্ছে না। লাল জামা পরা তুফানের লাঠি বাহিনীও উধাও। কোথাও এদের আর দেখা যাচ্ছে না। ফলে হাসি ফুটেছে রিকশাচালকদের মুখে।

তেমনই একজন নামাজগড় এলাকার রিকশাচালক সোলায়মান আলী। জমি বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকায় একটা অটোরিকশা কিনেছেন। কিন্তু জানতেন না সেই রিকশা রাস্তায় নামাতে কাউকে তিন হাজার টাকা দিতে হবে। ফলে তাকে ধরে নিয়ে মারধর করে রিকশাটি তুফানের দরবারে রেখে দিয়েছিল তার অনুসারীরা। পাঁচ হাজার টাকা নজরানা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছিল গাড়িটি।

রিকশাচালক সুলাইমানের ভাষ্য, ‘মাস তিনেক আগের কথা। চারমাথা থেকে বাদুড়তলা হয়ে সাতমাথায় যাওয়ার জন্য দুজন প্যাসেঞ্জার ওঠে রিকশায়। আমি বাদুড়তলা পর্যন্ত আসতেই লাঠি হাতে লাল শার্ট পরা একজন গতিরোধ করে। সে কাগজ দেখতে চায়। আমি অবাক হয়ে কিসের কাগজ জানতে চাইলে লাঠি দিয়ে পিটাতে শুরু করে আমাকে। তার পর বললো ‘তুই ভাইরে চিনস না রিকশা চালাতে শহরের এসছিস?’ রিকশায় থাকা দুই হতভম্ব ভদ্রলোক গুন্ডাবাহিনীর চেহারা-সুরত দেখে কোন কিছু না বলে রিকশা থেকে নেমে যায়। তার পর রিকশাসহ সোলায়মানকে ধরে নিয়ে যায়। তখন বেলা ১২টা। তুফানের সূত্রাপুর চামড়াগুদাম লেনের বাড়িতে নিয়ে যায় তাকে। রিকশায় তালা মেরে সোলায়মানকে বলে, ‘ভাই এখন ঘুমায়। কোনো কথা না বলে সোজা কোথায় যাবি যা। রাত ৯টার পরে ফি ৩০০০ এবং জরিমানা ২০০০ মোট ৫০০০ টাকা নিয়ে আসিস। যদি তিন দিনের মধ্যে না আসিস তাহলে তোর রিকশা আর পাবি না।’

অনেক অনুরোধেও রিকশাটি না ছাড়লে সোলায়মান গ্রামের বাড়ি ফিরে যান। সুদের ওপর ৫০০০ টাকা নিয়ে দুই দিন পর হাজির হন তুফানের দরবারে। তুফান টাকা বুঝে পাওয়ার পর হাতে একটা নেমপ্লেট ধরে দিয়ে বলেন, রিকশার পিছনে লাগাস, তাহলে কেউ কিছু বলবে না।

সোলায়মান আজ খুব খুশি। পুলিশকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

এ রকম শত শত সোলায়মান এখন মনে মনে খুশি। তার পরও আতঙ্ক কাটছে না কারোই। কারণ পুলিশের সঙ্গে তুফানদের ভালো সম্পর্কের ফলে আইনের ফাঁক খুঁজে তারা বেরিয়ে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথাও পাচ্চে না তারা।

দুদককে দুষছে সাধারণ মানুষ

হঠাৎ করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া মতিন-তুফানকে নিয়ে বগুড়ার দুদক এত দিন কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। সাম্প্রতিক ধর্ষণ-কা-ের পর দুদকের একটি টিম দুই সরকারের সম্পদের তথ্য নেওয়ার জন্য মাঠে নামার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে বগুড়া দুদক কার্যালয় থেকে এখনো এই বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানানো হয়নি।

তুফান সরকারদের প্রতি দুদকের চোখ এতদিন বন্ধ থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে কী ব্যবস্থা নেয় সংস্থাটি সেটি দেখতে অপেক্ষা বগুড়াবাসীর।

ধর্ষণের আলামত মিলেছে পরীক্ষায় বগুড়ায় তুফান কর্তৃক ধর্ষণের শিকার কিশোরী মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসকদের ওই রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে ডাক্তাররা বলেছেন, মেয়েটি নাবালিকা।

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কে এম সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে গত সোমবার মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার হাতে ইতোমধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনটি পৌঁছেছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আবুল কালাম আজাদ রিপোর্টটি পাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, চিকিৎসকদের দেওয়া প্রতিবেদনে মেয়েটিকে ধর্ষণের আলামত মিলেছে। মেয়েটি প্রাপ্তবয়স্ক নয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে তাতে।

তুফান-রুমকি আবার রিমান্ডে

কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় আসামি তুফান সরকার এবং নারী কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকিকে আবার দুই দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত। শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টায় তাদের হাজির করা হয় অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (অপারেশন) আবুল কালাম তুফানের তৃতীয় দফায় এবং রুমকির দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শ্যাম সুন্দর রায় দুই আসামির দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে মুন্না নামের আরেক আসামির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে আদালতে।

দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া

বগুড়ায় শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকার কর্তৃক কিশোরী ধর্ষণ ও মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়ার ঘটনায় অবশেষে মুখ খুলেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। তুফান ও তার ভাই সদ্যবহিষ্কৃৃত যুবলীগ নেতা মতিন সরকারের জগত নিয়ে গণমাধ্যমে নানা লেখালেখি হলেও গত এক সপ্তাহ নীরবতা পালন করেন দলের নেতারা। আজ জেলা সভাপতি মমতাজ উদ্দিন বগুড়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে মমতাজ উদ্দিন বলেন, সংগঠন করা মানে অপরাধ করার লাইসেন্স নয়। সহযোগী সংগঠনসহ ভুঁইফোড় কিছু সংগঠনের কারণে আওয়ামী লীগের দুর্নাম হচ্ছে। সহযোগী সংগঠনগুলোকে তারপরও বগুড়ায় আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বারবার সাবধান করেছি। অনেক সময় কড়া ভাষায় সমালোচনা এবং সঠিক পথে আসার আহ্বান জানিয়েছি।কেউ শুনেছে কেউ শোনেনি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা অনেক সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বাসায় দাওয়াত খান। তাদের বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ফলে আমাদের অনেকে তোয়াক্কাই করে না।

তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যক্তির কারণে আওয়ামী লীগ দুর্নামের অংশিদার হবে না। শুধু তুফান সরকার অথবা মতিন সরকার নয়; যারা এদের ¯্রষ্টা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রশাসনের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে মমতাজ উদ্দিন বলেন, বগুড়ায় আইন-শৃঙ্খলা মিটিং-এ বারবার বগুড়ার যানজট, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, জুয়া ও মাদকের ব্যাপারে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি। বগুড়া শহরে মাত্র ৫ হাজার সিএনজির লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু অবৈধভাবে ২০ থেকে ২৫ হাজার লাইসেন্সবিহীন সিএনজি চলছে। সিএনজি স্ট্যান্ডগুলো বগুড়া শহরে যানজটের মূল কারণ। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে আওয়ামী লীগের এই নেতার (বিবৃতি দানকারী) বিরুদ্ধেও অভিযোগের ফিরিস্তি দিচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। তুফান মতিনকে সরাসরি সহযোগিতার অভিযোগসহ রেলের জমি দখলের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। যদিও তিনি ওই বিবৃতিতে বলেছেন, ‘কিছু গণমাধ্যম আমাকে জড়িয়ে যে খবর প্রকাশ করেছে তাতে আমি দুঃখ পেয়েছি।’

বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) সনাতন চক্রবর্তী বলেন, তুফান এবং রুমকিকে আবার দুই দিনের রিমান্ড পেয়েছে পুলিশ। সাম্প্রতিক ঘটনার আরো বিস্তারিত তথ্য উদ্ধার করতে আসামিদের আবার রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল। আদালত তাদের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। অন্যদিকে মুন্না আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। (ঢাকাটাইমস/৬আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :