বরিশালে জমজমাট ভাসমান ‘নৌকার হাট’
প্রকাশ | ০৭ আগস্ট ২০১৭, ০৮:০৬
ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল প্রবাদটি এখনো বর্ষা মৌসুমে নৌকা ও মাছ ধরার চাঁইয়ের মাঝে অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই এ অঞ্চলের মানুষ চলাচল ও পণ্য পরিবহনের জন্য নির্ভরযোগ্য বাহন হিসেবে খুঁজে নেন নৌকা। শুধু যাতায়াত আর পণ্য পরিবহন নয়, দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের মৎস্য শিকারের কাজে অন্যতম ভূমিকা এ নৌকার।
নৌকায় জাল, চাঁই নিয়ে অথবা বড়শি নিয়ে মৎস্য শিকারে ছোটেন জেলেরা। কাঁচা সবজি বিক্রির জন্য নিকটবর্তী হাট-বাজারে নিয়ে যাওয়ার প্রধান বাহন এই নৌকা। স্বরূপকাঠীসহ কয়েকটি এলাকায় এসব নৌকায় বসে বেচাকেনা হয় তরিতরকারিসহ নানা পণ্য। স্থানীয় ভাষায় বলে ভাসমান নৌকার হাট। তাই প্রতি বছর বর্ষা এলেই কদর বেড়ে যায় নৌকার। এ মৌসুমে এ অঞ্চলের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী নৌকা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এ অঞ্চলের মধ্যে নৌকার জন্য বিখ্যাত স্বরূপকাঠী। আষাঢ় মাস থেকে থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত আটঘর, কুড়িয়ানা ও ইন্দেরহাটে নতুন নতুন তৈরি ছোট নৌকা বিক্রির হাট বসে। ওই উপজেলায় বিভিন্ন প্রজাতির শাক, সবজি ও তরকারিসহ পেয়ারা এবং লেবুর ব্যাপক ফলন হয়। এসব কৃষিপণ্য বাজারে আনার জন্য ছোট খাল-বিল পার হতে নৌকার বিকল্প নেই। তাই নৌকার বিকিকিনি জমজমাট হয়ে উঠে। কুরিয়ানা বাজারে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক নৌকা বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীরা জানান। পার্শ্ববর্তী বানারীপাড়া, উজিরপুর ও ঝালকাঠী থেকেও নৌকা কিনতে স্বরূপকাঠীর বিভিন্ন বাজারে আসেন ক্রেতারা।
কাঠের জন্য বিখ্যাত এলাকা হিসেবে পরিচিত স্বরূপকাঠীতে চলছে নৌকা বানানোর ধুম। বৃষ্টির পানির সাথে সাথে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে নৌকার কদর। নতুন এসব নৌকায় নানান ধরনের শাক-সবজি নিয়ে কৃষক ও পাইকাররা আসছেন ভাসমান হাটে। ছোট ছোট গাছের চাড়া নিয়ে দূরবর্তী অঞ্চলেও নৌকা নিয়ে পাইকারা ছুটছেন। সর্বত্রই নৌকার কদর বেড়ে যাওয়ায় স্বরূপকাঠীর নৌকা তৈরির কারিগরদের এখন ব্যস্ততার কোনো শেষ নেই। স্বরূপকাঠীর পার্শ্ববর্তী বানারীপাড়া উপজেলার ইন্দেরহাট, ইলুহার, গাগর, আতাকোঠালী ও বৈঠাকাটাগ্রামের অসংখ্য পরিবার নৌকা তৈরির পেশায় নিয়োজিত। তারা স্বরূপকাঠী থেকে কাঠ কিনে নৌকা তৈরি করছেন। চাম্বল কাঠ দিয়ে ডিংগি ও ছোট আকারের পিনিশ নৌকা তৈরি করে বিক্রি করছেন। রেইন্ট্রি কাঠ দিয়েও কমদামি নৌকা তৈরি করা হয়।
নৌকার বিক্রেতা অনিল চন্দ্র দাস ঢাকাটাইমসকে জানান, শুধু বর্ষা মৌসুমে ব্যবহারের জন্য কমদামি বেশি নৌকা বিক্রি হয়ে থাকে। স্বরূপকাঠীর আটঘর কুরিয়ানা নদীতে নতুন তৈরি করা এ নৌকার ভাসমান হাট বসে।
বিক্রেতারা জানান, বর্ষায় মৌসুমে পানিতে চারদিকে থৈ থৈ অবস্থার কারণে কৃষি কাজের জন্য মানুষ যাতায়াত করতেও এসব নৌকা কিনেন। স্থানীয়রা এসব নৌকাকে পোষা নৌকা কেউ বা আবার কোষা নাও হিসেবে ডাকেন। তবে সবার কাছেই যেন বর্ষা মৌসুমে এসব নৌকা চলাচলের জন্য প্রধান বাহন।
নৌকারহাট ঘুরে দেখা গেল, যেন এক নৌ সাম্রাজ্য। যে দিকেই দুই চোখ যায় কেবল নৌকা আর নৌকা। আধুনিক সভ্যতায় যান্ত্রিক নানান ইঞ্জিন চালিত বোর্ডের রাজত্ব থাকলেও এখানকার মানুষের কাছে নৌকার কদর শত শত বছর ধরে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্রেতা, বিক্রেতা আর নৌহাট দেখার উৎসুখ মানুষের সমাগমে এসময়ে দেখা মেলে নৌকা বিকিকিনির এ মিলনমেলা। নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার ১০ ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের দেড় সহস্রাধিক পরিবার বংশ পরম্পরায় এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছে বলে জানা, উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নৌকার হাটে আসা ক্রেতা, বিক্রেতারা।
সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের আটঘরের খালে ও রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে দক্ষিণবঙ্গের বৃহত্তম এ নৌকার হাট।
ঝালকাঠীর পাষন্ডা গ্রাম থেকে আসা নৌকা মিস্ত্রি সঞ্জয় গরামী রবিবার ঢাকাটাইমসকে জানান, পাঁচ বছর ধরে তিনি এ নৌকার হাটে আসছেন। আজকের হাটে তিনি সাতটি নৌকা এনেছেন। বেচা-বিক্রি খুব ভালো বলে মনে হয়েছে তার কাছে।
এই মিস্ত্রি আরও জানান, নৌকার আকার ও প্রকারভেদে ৭০০ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকার নৌকা ওঠে এ হাটে। আমড়া, আম, রেইনট্রি, কড়াই ও চাম্বল কাঠ দিয়ে তৈরি হাটে আসা সিংহ ভাগ নৌকা।
হাটে আসা একাধিক নৌকা বিক্রেতা ও স্থানীয়দের কাছে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে এ উপজেলার দেশ বরণ্য কুড়িআনার আপেল খ্যাত পেয়ারা, আমড়া, চাই দিয়ে মাছ ধরা এবং গো-খাদ্য সংগ্রহে নৌকার কদর বেশি থাকে।
স্থানীয় নৌকা ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া ঢাকাটাইমসকে জানান, এ অঞ্চলের মানুষেরা নৌকায় করে খালের মধ্য ছোটখাট ব্যবসা বাণিজ্যে করে থাকে। সে কারণে পেনিস নৌকার চাহিদা একটু বেশি।
নৌকা মিস্ত্রি আলিম, উত্তম দাস বলেন, একটি পেনিস নৌকা তৈরিতে তার এক থেকে দেড় দিন সময় লাগে। কাঠ ও মজুরি মিলিয়ে তার খরচ পড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। যা তিনি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা লাভে বিক্রি করেন।
উপজেলার চামী গ্রাম থেকে আসা নৌকা ব্যবসায়ী মো. জয়নাল জানান, ৩০ বছর পর্যন্ত তিনি এই নৌকার হাটে আসছেন। তিনি জানান, প্রতি জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত এ হাটে নৌকা কেনা-বেচার ধুম থাকে। তবে আষাঢ় ও শ্রাবণে বেচা-বিক্রিতে মহাব্যস্ত থাকে হাটের নৌকা বিক্রেতারা। চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত, ফসল তোলা, শাপলা তোলা, চাঁই পাতা, গরুর খাদ্য সংগ্রহসহ নানা কাজে এখানকার বিক্রিত নৌকা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ঝালকাঠির বিনয়কাঠি থেকে আসা নৌকা ক্রেতা মো. সাইদুল বলে উঠলেন, এ বছর হাটে নৌকার দাম বেশি। গত বছর যে নৌকা দুই হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে সে নৌকা এবার তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বলদিয়া থেকে নৌকার হাটে আসা নৌকা মিস্ত্রি সাদিক ঢাকাটাইমসকে জানান, ১৯৭৪ সাল থেকে তিনি নিজ হাতে নৌকা বানিয়ে একসাথে ২৫ থেকে ৩০টি নৌকা নিয়ে হাটে আসেন। তিনি জানান, একটি ১২ হাতি নৌকা তৈরিতে একজনের সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। যার মজুরি ও কাঠ মিলিয়ে খরচ পড়ে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা। যা ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা লাভে তিনি বিক্রি করে থাকেন।
সাদিক আরও বলেন, এ বছর নৌকা তৈরিতে কাঠসহ সবকিছুর মজুরি বৃদ্ধিতে নৌকার দাম বেশি বলে তিনি দাবি করেন।
হাটে আসা একাধিক নৌকা মিস্ত্রি ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, উপজেলার স্বরূপকাঠি এবং মিয়ারহাট ও ইন্দ্রেরহাট থেকে তারা সহজলভ্যে কাঠ কিনে হাটে আসা এসকল নৌকা তৈরি করে থাকেন। উপজেলার শেকেরহাট, দলহার, আতা, কুড়িয়ানা, বেগুলি ও ডুবিরহাট, একতা, পঞ্চবেকিরসহ এখানকার মানুষেরা নৌকা তৈরিতে পারদর্শী।
নৌকা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন ইজারাদারদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার সম্পূর্ণ মুনাফা ভোগ করতে পারছেন না কারিগর ও বিক্রেতারা। ইজারাদাররা অহেতুক বাড়তি টাকা নেন বলে ব্যবসায়ীরা জানান। নৌকা ব্যবসায়ীদের দাবি, তাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী নৌ-হাট সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে নেয়া হোক সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ।
নৌকার হাটের ইজারাদার মনোজ কুমার ঢাকাটাইমসকে জানান, এখানে কোনো অতিরিক্ত খাজনা নেয়া হয় না।
(ঢাকাটাইমস/০৭আগস্ট/টিটি/জেবি)