স্মৃতির পাতায় শেখ কামাল-৩

নকশাল ভেবে কামাল ভাইয়ের গাড়িতে গুলি করে পুলিশ

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
| আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৫৭ | প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ০৮:২৯
একটি মিছিলে শেখ কামাল ও সর্ব ডানে লেখক

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি, সাম্যবাদী দল, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টিসহ বেশ কয়েকটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল সিরাজ শিকদার, হক, তোহা, মতিন, আলাউদ্দিন ও টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে গোপনে নানা নাশকতামূলক কার্যকলাপ ও আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল। এদের সাথে পরবর্তীতে যোগ দেয় জাসদের গণ বাহিনী।

বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তারা গুলি হত্যা করে। ধীরে ধীরে সারা দেশে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিশেষ করে ১৬ ডিসেম্বর তাদের তৎপরতা বেশি বৃদ্ধি পেত। এক সময় তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বোমা ফাটিয়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে।

তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ভুয়া ধুয়া তুলে এসকল সংগঠনগুলো তরুণ ও যুব সমাজকে সহজেই দলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এসকল তরুণদের সরকারের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা হতো।

আরও পড়ুন: প্রতিটি কর্মীর প্রতি কামাল ভাইয়ের ছিল অসীম ভালবাসা

১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্বমুহূর্তে এই নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো সারাদেশে বোমা ফাটিয়ে ও লিফটলেট বিলি করে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাদের আপত্তিকর প্রচারণা ও আক্রমণাত্মক কার্যকলাপে দেশের মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে। নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর এ ধরনের নাশকতামূলক কার্যকলাপ ও জনগণের জানমাল রক্ষার্থে পুলিশ ও রক্ষী বাহিনীকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ যুবলীগ কর্মীরা এগিয়ে আসে। এদিকে কে বা করা সিরাজ শিকদারের লিফলেট ছাত্রলীগ অফিসের ভেতরে ছড়িয়ে দিয়ে যায়। ঢাকার এমন পরিস্থিতি নিয়ে ছাত্রলীগ অফিসে এক জরুরি সভা হয়। এই সভাতে কামাল ভাইও উপস্থিত ছিলেন।

সভায় ১৫ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছাত্রলীগ কর্মীদের দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আমার যতটুকু মনে পরে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো ছিল ন্যাপ মুজ্জাফরের অফিস, মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির অফিস, সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সেন্টার, সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের দূতাবাস, মতিঝিল গুলিস্তান, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ ঢাকার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী সকল সংগঠনের কার্যালয়।

কামাল ভাই গুলিতে আহত

সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত্রে ছাত্রলীগের কর্মীদের বিভিন্ন স্থানে পাহারায় মোতায়েন করা হয় এবং চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য বলা হয়। আমি ও নুরু ভাই একটি মোটর সাইকেলে (মোটর সাইকেলটি কামাল ভাইয়ের দেওয়া) সব এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখে ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে মিলিত হয়ে উৎসাহ দেই। পরিশেষে আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসি। কারণ এখানে তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে বরণ করে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

যথারীতি রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে পটকা ফাটিয়ে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরকে বরণ করে নেওয়া হয়। হঠাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেট দিয়ে কয়েকটি গাড়িকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখতে পেলাম। ঘটনা জানার জন্য আমরা কয়েকজন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করি। এখানে এসে দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনির ভাই, মোহাম্মদপুরের বরকত ভাই ও শাহান মামাসহ বেশ কয়েকজন গুলিতে আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন।

ঢাকা  মহানগর  ছাত্র লীগের সাবেক  সভাপতি  সৈয়দ  নুরুল  ইসলাম  ও  লেখকআমাকে দেখে শাহান মামা ইশারায় কাছে ডাকলেন এবং জানালেন কামাল ভাই গুরুতর আহত হয়ে এখন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছেন। কামাল ভাইয়ের গলায় গুলি লেগেছে। পরিস্থিতি সাংঘাতিক বলে তাকে শিগগির অপারেশন করা হবে।

শাহান মামার আরেক পরিচয় তিনি বিএনপি নেতা শমশের মবিন চৌধুরীর ছোট ভাই। মনির ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে কামাল ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন। আর বরকত ভাই মোহাম্মদপুর এলাকার মানুষের কাছে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী ও সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। এছাড়া তিনি আমার সাথে মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। যতটুকু জানি তিনি বর্তমানে শেখ কামাল স্মৃতি পরিষদের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

এখানে শাহান মামার কাছ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারলাম। একটি জিপে করে তারা যখন মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড় পার হচ্ছিলেন তখন ভুল বুঝাবুঝিতে সার্জেন্ট কিবরিয়া ও তার পুলিশ বাহিনী নকশালের জিপ মনে করে তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। যার কারণে জিপে বসা অবস্থায় তারা সকলেই আহত হন।

পরে কামাল ভাই আহত অবস্থায় ক্রলিং করে পুলিশের নিকটে গিয়ে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি শেখ কামাল।’ এ কথা শুনার সাথে সাথে গুলি থেমে যায়। এ প্রসঙ্গে কামাল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহান মামা বলেন, কামাল এই সময় এই সাহসী পদক্ষেপ না নিলে আজ হয়তো আমরা কেউই জীবিত থাকতাম না।

আরও পড়ুন: আমরা ওই আবদার না করলে শেখ কামালও বেঁচে থাকতে পারতেন

কামাল ভাইয়ের চালানো লাল জিপটিকে পুলিশ নকশালের গাড়ি বলে সন্দেহ করে গুলি চালিয়েছিল। তাছাড়া ওই দিন পারস্পরিক নিরাপত্তার জন্য পুলিশ রক্ষীবাহিনী ও বিডিআরের মধ্যে যে ফ্লাশ লাইটিং সিগন্যাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা কামাল ভাইয়ের জানা ছিল না। জানা থাকার কথাও নয়। নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির জন্য এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

এই দুর্ঘটনার খবর সাথে সাথে সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। তিলকে তাল করে দুষ্ট লোকেরা কামাল ভাইকে জড়িয়ে নানা অপপ্রচার চালায়। এই অপপ্রচারের কর্ণধার অনেকেই এখন বর্তমান আওয়ামী লীগের বিরাট বড় নেতা বনেছেন, মন্ত্রীও হয়েছেন। হাস্যকর হলেও তখন এও বাজারে শুনা গেছে যে কামাল ভাই নাকি ওই দিন রাতে দল বল নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক লুট করতে গিয়েছিলেন।

এ ধরনের অনেক অবাস্তব কথা জাসদসহ আমাদের স্বাধীনতার শত্রুরা সর্বস্তরে প্রচার করেছিল। যার কিছু কিছু আবার বঙ্গবন্ধুর কানেও আসত। এ ধরনের অপপ্রচারকে ওই সময় জাসদ ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির একত্রিত হয়ে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্ঠা চালাত। শুধু তাই নয় ঢাকা কলেজের জাসদ ছাত্রলীগের নেতারা ঐসময় গ্রিনরোডের দেওয়ালে চিকা মেরেছিলো ঠিক এমনিভাবে,

‘শেখ কামাল গুলি খাইলো

ব্যাংক লুট বন্ধ হইলো’

শুনেছি ঢাকা কলেজের এসকল নেতারা নাকি এখন আওয়ামী লীগের ভেতরে প্রবেশ করেছেন। কামাল ভাইকে নিয়ে এই অপপ্রচারকে স্তব্ধ করার জন্য সেদিনের ঘটনার অনেকেই এখনও বর্তমান। তাদের উচিত হবে সামনে এগিয়ে আসা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসার পর পর তিনি যখন হাসপাতালে বেড রেস্টে ছিলেন, ওই সময় নুরু ভাইয়ের সাথে কামাল ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম। এখনো মনে পরে, কামাল ভাইয়ের বিছানার পাশে গ্লোবের মতো খুব ছোট একটি টেলিভিশন ছিল। এখন সবই স্মৃতি।

চলবে.........

লেখক: কাউন্টি কাউন্সিলার স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিল, সুইডিশ লেফট পার্টি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :