এমন হিংস্রতা এই বয়সে কোত্থেকে আসে?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ০৯:৫৯

এত হিংস্রতা কোত্থেকে আসে এই বয়সের ছেলেদের? সাহস আর বর্বরতার মধ্যে পার্থক্য আছে, এটা বোধহয় বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে কুপিয়ে দিনের আলোয় হত্যা করা ছেলেগুলোর জানা ছিলনা। নাকি এরা পশু হয়ে গিয়েছিল? বিশ্বজিৎ তো হেঁটে ফুটপাত দিয়ে তাঁর দোকানে যাচ্ছিল। এইরকম নিরীহ পথচারীকে কুপিয়ে হত্যা করা হল কেন? তবে কি আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির উৎপাদন এই খুনিগুলো?

এই সন্ত্রাসীগুলোকে আমরা নানা ভাবেই সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারি। ‘ছাত্রলীগ কর্মী’ পরিচয়টা দিন শেষে প্রধান হয়ে উঠেছে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে এই খুনিগুলো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিল। আবার কেউ যদি বলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাও অস্বীকার করা যাবেনা। কিন্তু এটাও ঠিক, এই সন্ত্রাসীরা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে এই খুন করেনি। এরা খুন করেছে, কারণ এরা দেখতে মানুষ হলেও ভেতর থেকে পশু হয়ে উঠেছিল।

ঠিক কোন সংস্কৃতির মধ্যে বড় হলে এভাবে একজন নিরীহ পথচারীকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা যায়! বনের পশুও একান্ত প্রয়োজন না হলে শিকার করেনা। তাহলে বিশ্বজিৎ এর খুনিরা নিশ্চয় বনের পশু থেকেও বেশী পাশবিকতা অর্জন করেছিল। এর দায় কার? শুধুই ছাত্রলীগ কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের? নাকি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এদেরকে পশু বানিয়েছে।

খুব কাছ থেকে দেখেছি, রাজনীতি করা ছেলে এবং মেয়েদের অনেকে কীভাবে স্বাভাবিক আচরণ ভুলে গিয়ে কৃত্রিম ভাব অর্জন করে। ছাত্রজীবনে হেলিকপ্টারে উঠা নিশ্চয় কৃতিত্বের। কিন্তু সেটা নিশ্চয় নিচের স্বাভাবিক যোগ্যতার কিংবা কোনো অর্জনের পুরষ্কার স্বরূপ। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতাদের অনেকেকে দেখি হেলিকপ্টারে করে এখানে সেখানে যাচ্ছে! ছাত্রলীগ নেতা মানে তো মন্ত্রী হয়ে যাওয়া না। এরাও ছাত্র। তাহলে এই হেলিকপ্টারে উঠে আকাশে উড়ে বেড়ানোর টাকা আসল কোত্থেকে? ছাত্রলীগের ছেলেদের কেউ কেউ কী এমন কাজ করে যে এদের এত টাকা খরচের সামর্থ্য অর্জিত হয়? নিজের পরিবারের টাকা খরচ করে যে কেউ হেলিকপ্টারে উঠে তাহলে সমস্যা নেই। যানজট এড়াতে কারো সামর্থ্য থাকলে কেউ হেলিকপ্টার কিনেও ফেলতে পারে। কিন্তু ছাত্র সংগঠনের নেতা হওয়ার আগে আর পরের চেহারা, কাপড়-চোপড়, খানাপিনা, ভাব-সাব ইত্যাদি মিলিয়ে দেখলেই সন্দেহ হয়। ছাত্রলীগের কারো কারো কথা বললে অন্যায় করা হবে। যাদেরকে ক্যাম্পাসে ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ স্লোগান দিতে দেখেছি তাদের অনেকেই এখন ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত। শাহবাগে এরাও দামি গাড়ি, দামি সিগারেট নিয়ে অল্প সময়ের জন্য আসে।

নেতা যখন সাধারণ থেকে অস্বাভাবিক রকমের অসাধারণ হয়ে উঠেন, তখন নিচের নেতা-কর্মীরাও তাতে প্রভাবিত হবে স্বাভাবিক। মনের ভেতরে কাজ করে হিরোইজম। নেতাকে ফলো করে তারা। হাঁটার স্টাইল, কথা বলার ধরন রপ্ত করার চেষ্টা করে। নেতা যেভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে হাত মেলান, কর্মীরাও একদিন এমন নেতা হয়ে বাকিদের দেখিয়ে দেয়ার তালে থাকেন। নেতার বদলে যাওয়া জীবন দেখে এরা অনুপ্রাণিত হয় বলা যাবেনা, উত্তেজিত হয়। নেতার সামনে ইঁদুরের মত বসে থাকে। নেতা চলে গেলে নিজেই নেতা হয়ে বাকিদের ধমকায়। হলের ক্যান্টিনে বসে খাওয়া যাবেনা, তাতে মান সম্মান নষ্ট নয়। নিজে পায়ে হেঁটে কোথাও যাওয়া যাবেনা। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও লাইন ধরে সেলফ সার্ভিসে নিজের খাবার আনা যাবেনা। সাথে থাকা চামচারা লাইন ভেঙ্গে বাকিদের বিরক্তির কারণ হয়ে খাবার এনে নেতাকে দিবেন। এই নেতাই যখন আবার বিদেশ যাবেন, লাইন ধরে খাবার নিয়ে সেখানকার নাগরিকত্ব অর্জনের চেষ্টা করবেন। কেউ ব্যক্তিগতভাবে এই কথাগুলো নিবেন না। নেতাদের সাথে বসা বাদ দিয়েছি অনেকদিন হল। কর্মীরা মনে করে আমিও নেতা। আমার সাথেও হাত মেলাতে চলে আসে। আমার খুব লজ্জা লাগে। আমিতো হাত মিলিয়ে কিছু কথা বলার লোক। কাউকে এভয়েড করতে পারিনা। নেতারা যেভাবে সাধারণ মানুষকে এভয়ড করেন, তাতে তারা এটাকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবেনা। নেতা গালি দেয়, কর্মীও গালি দেয়। নেতা গল্প করেন, কখন কাকে কোথায় মেরেছে, কবে কী অস্ত্র হাতিয়েছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

কর্মীরা পারফরম্যান্স দেখাতে চায়। নেতার মনোযোগ চান। তাই শিবির মারতে গিয়ে নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎকে মেরে ফেলে তারা। আচ্ছা তখন কি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি দেয়ার কথা ছিল? কমিটি আসলে সংগঠনের নেতাকর্মীরা এগুলো করে। কিন্তু ছাত্রলীগ তো এমন সংগঠন না। আওয়ামী লীগের চেয়ে বয়সে বড় ছাত্রলীগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিষ্কার লক্ষ্য নিয়ে। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে শুধু আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা একটু কঠিন ছিল। কারণ এক নীতি থেকে আরেক নীতিতে এসে সবাইকে বুঝিয়ে দলে টানার কাজ সহজ ছিলনা। ছাত্রলীগ দিয়েই জাতির জনক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের বিরাট অবদান আছে, ভাষা আন্দোলনে আছে। তাহলে আজকাল ছাত্রলীগ কেন বিশ্বজিৎকে খুন করে নিজের বদনাম করবে? ছাত্রলীগের প্রতিটি ছেলের একেকজন শেখ কামাল হয়ে উঠার স্বপ্ন দেখার কথা। শেখ কামালের আবাহনীর মত কোন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করার কথা, নতুন কোন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের এডিসি হওয়ার কথা। শেখ কামালের ‘স্পন্দন’ এর মত কোনো গানের দল প্রতিষ্ঠা করার কথা। খুকির মত কোনো নারীর প্রেমে পড়ার কথা। জাতির জনকের আহুত অর্থনৈতিক মুক্তির ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ সৈনিক হওয়ার চেষ্টা করার কথা।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :