সুযোগ চাই, মানুষ হব

প্রভাষ আমিন
 | প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ১৫:০২

বাংলাদেশের অনেক মানুষের স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। বাংলাদেশের সম্মানজনক ও বিলাসবহুল জীবন ছেড়েও অনেকে ছুটে যান যুক্তরাষ্ট্রে। প্রাথমিক মোহ কেটে যাওয়ার পর অনেকেই ধাক্কা খান। কারো কারো স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়। কেউ কেউ ফিরেও আসেন। তবে বেশিরভাগই টিকে থাকার জন্য কষ্টকর সংগ্রাম করেন। কয়েক বছর পর হয়তো কিছুটা স্থিতিশীলতা আসে, স্থিতিশীলতার হাত ধরে আসে কিছুটা সচ্ছলতাও। কিন্তু যত সচ্ছলতাই আসুক যুক্তরাষ্ট্রে কারো বাসায় গৃহকাজে সহায়তার জন্য লোক রাখা প্রায় অসম্ভব। মিলিয়নার, বিলিয়নারদের কথা জানি না; সাধারণ আয়ের সচ্ছল মানুষকেও নিজেদের কাজ নিজেদের করতে হয়। বাংলাদেশে যার গ্যারেজে নানা মডেলের গাড়ি, বেলায় বেলায় ড্রাইভার; যুক্তরাষ্ট্রে তার নিজের গাড়ি নিজেকেই চালাতে হয়। বাংলাদেশে যার ঘরে গণ্ডায় গণ্ডায় চাকর-বাকর, যুক্তরাষ্ট্রে তাকে নিজের কাজ নিজেকে করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের যুক্তরাষ্ট্রের বাসার চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, জয় এবং তার স্ত্রী ক্রিস্টিনা কাজ শেষে ফিরে ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে করেন। এটাই সেখানকার বাস্তবতা। বাংলাদেশের কূটনীতিবিদদের কেউ কেউ নানা কায়দায় বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী নিয়ে যান। সেটি নিয়েও নানা কেলেঙ্কারির খবরও আমরা জানি। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশে মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারেও গৃহকর্মী থাকেন। প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশে পুরুষরা ঘরের কাজে হাত লাগান না বললেই চলে। নারী চাকরিজীবী হোক আর গৃহবধূ, ঘরের সব কাজ তাকে একাই করতে হয়। তাই তিনি সাহায্যের জন্য মানুষ খোঁজেন। গার্মেন্ট খাতের ব্যাপক বিকাশের পর বাংলাদেশেও গৃহকর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। তবুও গ্রামের গরিব পরিবারের অনেকেই ঢাকায় বিভিন্ন বাসায় কাজ করেন। তাতে আমার আপত্তি নেই। কারো যদি সামর্থ্য থাকে, তিনি তার সাহায্যের জন্য কাউকে রাখতেই পারেন। কিন্তু শর্ত হলো, শিশু কাউকে রাখা যাবে না। যাদের রাখা হবে তাদেরকে যথাযথ অর্থ এবং সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কিন্তু আমাদের কেউ কেউ গ্রাম থেকে আনা গৃহকর্মীকে ক্রীতদাস মনে করেন। একবার ঢাকায় আনতে পারলেই হলো। তারপর তাকে রীতিমতো বন্দি করে রাখা হয়। রাখা হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, দেওয়া হয় নিম্নমানের খাবার। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাদের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। নির্যাতন আবার দুই ধরনের। ঘরের পুরুষ সদস্য দ্বারা যৌন নির্যাতন তো আছেই। আছে কথায় কথায় গৃহকর্ত্রীর শারীরিক নির্যাতন। আমরা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারি, নির্যাতিত গৃহকর্মীদের না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। সব নির্যাতনের খবর আমরা কখনোই জানি না। যখন নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যায়, যখন গৃহকর্মীটি মরতে বসে; তখনই কেবল দু-একটা ঘটনা জানাজানি হয়।

সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত আদুরীর গল্পটা তো আপনাদের সবার জানাই। বাবা-মা যত গরিবই হোন, সন্তানের প্রতি কারো ভালোবাসা তো কম নয়। বাবা-মা নিশ্চয়ই অনেক আদর করে সন্তানের নাম রেখেছিলেন আদুরী। কিন্তু পেটের দায়ে সেই মেয়েকে তারা ঢাকা পাঠান। তাদের আশা ছিল আদর-সোহাগ না পাক, দু বেলা ভালো-মন্দ খেতে তো পারবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। দিনের পর দিন নির্যাতনে আদুরী যখন মরতে বসেছিল, তখন তাকে ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে। সেখান থেকে যখন মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়, তখন তার যে হাল তা মানুষ হিসেবে যে কাউকে লজ্জা দেবে। আদুরী এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু তার শরীরে এখনো আঘাতের চিহ্ন, মনে ভয়। আদুরী হয়তো কখনোই এই স্মৃতি ভুলতে পারবে না। চার বছর আগের আদুরী আবার আলোচনায় এসেছে। কারণ তাকে নির্যাতনের ঘটনায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীর যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। এটা অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক রায়। নওরীন জাহান নদীরও দুটি সন্তান আছে। আদালতে রায় শোনার পর নদী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তার বাচ্চা দুটোর কী হবে? তাদের কে দেখবে? কিন্তু আমার প্রশ্ন একজন নারী তার সন্তানের বয়সী একটি মেয়েকে এভাবে মারতে পারে কিভাবে? আদুরীর ছবি যারা দেখেছেন, তাদের মনে নদী বা তার দুই সন্তানের জন্য কোনো মমতার উদ্রেক হবে না। অন্যায় করলে তাকে সাজা পেতেই হবে।

প্রশ্নটা এখানেই। আমরা প্রায়ই গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর দেখি পত্রিকায়। কিন্তু রায়ের খবর পেলাম একটিই। তাহলে বাকি নির্যাতনের ঘটনার কি বিচার হয় না? আসলেই বিচার হয় না। ডিমের কুসুম ছড়িয়ে যাওয়ায় সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী আয়েশা লতিফ ১১ বছরের সাবিনাকে যেভাবে নির্যাতন করেছেন, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোথায় এখন সাবিনা? কোথায় আয়েশা লতিফ? এভাবেই ধামাচাপা পড়ে যায় অসংখ্য নির্যাতনের ঘটনা। গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় ক্রিকেটার শাহাদাত দম্পতি কারাগারেও গেছেন। কিন্তু সেই মামলার কী অবস্থা? না, আপস হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে মিরপুরে পুলিশ দম্পতির বাসায় গৃহকর্মী রাসেলের মৃত্যুর ঘটনা সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মীমাংসা হয়েছে। ঢাকায় আমাদের বাসায়, আমাদের সাহায্য করতে যারা আসে, তারা গরিব। তাই বলে কি তাদের জীবনেরও কোনো দাম নেই? তাদের জীবনকে আমরা টাকা দিয়ে মাপবো। অন্যায় মানে অন্যায়। ফৌজদারি কোনো অপরাধের আপস করার কোনো সুযোগ থাকা উচিত নয়। পুলিশ দম্পতির যেখানে হত্যা মামলায় কারাগারে থাকার কথা, সেখানে মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তারা মুক্ত হয়ে যান কিভাবে? অন্যায় যে করে আর যে সহে; দুজনই অপরাধী। আর অপরাধীর শাস্তি না হলে অপরাধ কমবে না।

ক্রিকেটার হোক, পুলিশ কর্মকর্তা হোক, সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী হোক; অন্যায় করলে শাস্তি তাকে পেতেই হবে। নদীর মতো সব নির্যাতনকারীর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল গৃহকর্মী নির্যাতন কমে আসবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এ অপরাধপ্রবণতা কমানোর কোনো সুযোগ নেই। আর আমি সব গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে চাই, গৃহকর্মীর গায়ে হাত তোলার আগে আপনার সন্তানের কথা ভাবুন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে টিভি বিজ্ঞাপনে একটি স্লোগান আছে- সুযোগ চাই, মানুষ হব। নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী আর গৃহকর্তার জন্যও আমার একই আবেদনÑ তারাও যেন মানুষ হওয়ার সুযোগ পান। আমরা সবাই যেন মানুষ হই, সবার প্রতি যেন মানবিক আচরণ করি।

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :