বহুদিন পর দেশে এসে ফ্ল্যাটে মিলল মায়ের কঙ্কাল
ভারতের মুম্বাইতে এক প্রকৌশলী যুক্তরাষ্ট্র থেকে দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে মায়ের কঙ্কাল আবিষ্কার করেছেন। খবর বিবিসির।
মৃত আশা সাহনি বহুতল সোসাইটির ওই ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন - তবে তিনি কতদিন ধরে সেখানে মরে পড়ে আছেন তা পুলিশ এখনও জানাতে পারেনি।
ভারতে এমন লাখ লাখ বয়স্ক বাবা-মা আছেন যাদের ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে প্রবাসী জীবন কাটাচ্ছেন- কিন্তু ভারতে তাদের দিন কাটছে প্রবল একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতার মধ্যে।
পুলিশ জানায়, সাহানির স্বামী কেদারনাথ ২০১৩ সালে মারা যান। তাদের একমাত্র ছেলে ঋতুরাজ(৪৩) যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সাহানি বিষণ্ন মন নিয়ে একাই থাকতেন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে সর্বেশেষ ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সাহানি। ঐ সময় ছেলেকে সাহানি বলেছিলেন, একা থাকতে তার ভীষণ খারাপ লাগে। বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। এরপর আর মা-ছেলের সঙ্গে কথা হয়নি।
মুম্বাইয়ের লোখন্ডওয়ালার অ্যাপার্টমেন্টে তেষট্টি বছরের আশা সাহানিকে যে চোখে পড়ছে না - সেটা গত কয়েকমাসে তার প্রতিবেশীরা, ধোপা, কলের মিস্ত্রি বা মুদি দোকানদার কেউই খেয়াল করেননি।
এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গতকাল রবিবার ঋতুরাজ ভারতে আসেন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে আন্দেরির লোখন্ডওয়ালা মায়ের ফ্ল্যাটে এসে কলিংবেল চাপেন। বেশ কয়েকবার কলিংবেল চেপেও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ শুনতে পাননি ঋতুরাজ। অগত্যা একজন তালাচাবি’র মেরামতের কাজ করে এমন একজনকে ডেকে আনেন। তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেই কাপড় পরিহিত মায়ের কঙ্কাল দেখতে পান ঋতুরাজ।
ভারতে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, পড়াশুনো করে বিদেশে পাড়ি দেয়ার প্রবণতাও বাড়ছে - আর সেই সঙ্গে এই একাকীত্ব ব্যাপক এক সামাজিক সমস্যার চেহারা নিচ্ছে।
বয়স্ক মানুষদের নিয়ে কাজ করা ভারতের সবচেয়ে বড় এনজিও হেল্পএজ ইন্ডিয়ার মতে এই ধরনের ঘটনা আজকাল মোটেও বিরল নয়।
ওই সংস্থার প্রধান প্রকাশ বোরগাঁওকর বিবিসিকে বলছিলেন, ‘গত পাঁচ-ছয় বছরে আমরা বহু দৃষ্টান্ত দেখেছি যেখানে বিদেশে থাকা ছেলেমেয়েরা বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না বললেই চলে।’
‘একা থাকা বাবা-মাদের আমরা সব সময় পরামর্শ দিই কাছের পুলিশ থানায় রিপোর্ট করিয়ে রাখতে, কিন্তু একা থাকার কথাটা জানাজানি হওয়ার ভয়ে তারা সেটাও করাতে চান না। পুলিশেরও অন্তত সপ্তাহে একবার তাদের ভিজিট করে যাওয়ার কথা- কিন্তু বাস্তবে সেটাও ঘটে না।’
ভারতে ষাটোর্ধ্ব নাগরিক বা সিনিয়র সিটিজেনদের ৪০ শতাংশই সম্পূর্ণ একলা থাকেন- বলছে হেল্পএজ ইন্ডিয়ার সর্বশেষ জরিপ।
বহু ক্ষেত্রেই তাদের সন্তানরা কৃতি ও প্রবাসী, কিন্তু সারাদিনে তাদের একটা খোঁজ নেয়ারও কেউ নেই।
কলকাতায় প্রবীণ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিন্তু মনে করেন অনেক বাবা-মা নিজেরাই তাদের এ পরিস্থিতি ডেকে এনেছেন।
তিনি বলছেন, ‘একটা কথা বলতেই হবে এত বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষা যখন, উচ্চাশা যখন ... যেখানে বাবা-মারাও চান তার ছেলেমেয়ে বিদেশে যাক, আরও বেশি রোজগার করুক, গর্ব করে সেটা সবাইকে বলা যাক- তা থেকেই কিন্তু এই ডিটাচমেন্টটা আসে। ফলে এর পেছনে বাবা-মার অবদানও কম নয়। এই একাকীত্ব তারা নিজেরাই অর্জন করেন, আর তার ফলও তাদের ভোগ করতে হয়।’
‘আমি কলকাতায় যে পাড়ায় থাকি সেখানে তো ঘরে ঘরে এই অবস্থা। বুড়ো-বুড়ি একলা পড়ে আছে, দেখার কেউ নেই- কাজের লোকের ভরসায় কোনওরকমে থাকা। ওই মুম্বাইয়ের বুড়ির মতোই তাদের অবস্থা আর কী!’
ছেলেমেয়ের সান্নিধ্য না-পেয়ে তারা কেউ কেউ নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য অন্য রাস্তাও বেছে নিচ্ছেন বলে বলছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
‘আজকাল নতুন নতুন সব এজেন্সিও হয়েছে যারা কিছু ছেলেমেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে এই সব বাবা-মায়ের কাছে পাঠায় সাময়িকভাবে তাদের নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য। যেসব বাবা-মা আর্থিকভাবে স্বচ্ছ্বল তারা অনেকে এই সার্ভিস কিনছেনও - ওই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন আর কী’- বলছিলেন তিনি।
মুম্বাইয়ের গোরেগাঁওয়ের বাসিন্দা সুনীল চোপড়ার দুই ছেলেই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তার নিজের এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই। কিন্তু তিনি অনেক বন্ধুকে জানেন যারা একই ধরনের পরিস্থিতি সামলাতে পারেননি।
তিনি বলছেন, ‘আসলে ভারতে তো রাষ্ট্র কোনও সামাজিক নিরাপত্তা দেয় না - কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় আমি দেখেছি সিস্টেমটা সম্পূর্ণ আলাদা। ভারতে যে বাবা-মা তাদের সব সঞ্চয় ঢেলে সন্তানকে পড়াশুনো করান, সেই ছেলেমেয়ে দূরে চলে যাওয়ার পরে তারা অনেকেই আর্থিক ও মানসিকভাবে অকূল পাথারে পড়েন।’
‘তবু আমি বলব, আমার বাবা উন্নত জীবনের সন্ধানে পাঞ্জাব থেকে মুম্বাই এসেছিলেন, আমার ছেলেরা একই কারণে মুম্বাই থেকে অস্ট্রেলিয়া গেছে- আমি তাতে বাধা দেয়ার কে?’
হেল্পএজ ইন্ডিয়ার প্রকাশ বোরগাঁওকর মনে করেন, ভারতীয় সমাজের যেটা জোরের জায়গা ছিল- সেই যৌথ পরিবার প্রথা লুপ্ত হওয়াটাও এই একাকীত্বের একটা বড় কারণ। কিন্তু তার পরামর্শ, বয়স্ক বাবা-মাকে এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই জীবন কাটাতে হবে, ছেলেমেয়ে একদিন আমার ঠিক কাছে ফিরে আসবে- এই মিথ্যে আশা নিয়ে থাকলে চলবে না।
ভারতে এখন ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা সোয়া এগারো কোটির মতো - যা ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় আঠারো কোটিতে পৌঁছবে। বিশেষজ্ঞরা ধরেই নিচ্ছেন তার সঙ্গেই তীব্রতর হবে তাদের একাকীত্বের সমস্যা।
(ঢাকাটাইমস/৭আগস্ট/এসআই)