একটি অভিযান ও একজন মুখরা রমনীর ভাবাবরোহ

মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন
 | প্রকাশিত : ০৮ আগস্ট ২০১৭, ০৮:৪৩

কিছু দিন আগের ঘটনা। দুপুর বেলা অফিসে বসে আছি। হঠাৎ একজন কলেজ ছাত্রী অফিসে এসে কান্নাকাটি শুরু করল। কলেজ কমনরুম থেকে তার ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে। ব্যাগে তার এসএসসি, এইচএসসি ও বিএ পরীক্ষার মূল সার্টিফিকেটগুলোও ছিল। চুরি হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ওই ছাত্রীকে একটি মোবাইল ফোন থেকে একটি মেয়ে ফোন করে বলে, তার মূল সার্টিফিকেটগুলো তার কাছে আছে এবং সার্টিফিকেটগুলো অক্ষত অবস্থায় পেতে হলে তাকে বিকাশের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে।

আমি মেয়েটিকে তার সাথে দর কষাকষি করতে ও বিকাশের মাধ্যমে টাকা দেয়ার পরামর্শ দিলাম। মেয়েটি একদিন যাবত দর কষাকষি করে ১০ হাজার টাকায় রাজি করাল এবং তার কাছ থেকে বিকাশ নম্বরটা নিল। বিকাশ নম্বরটা আমাকে দেয়ার পর আমি বিকাশ হেড অফিসে কথা বলে ওই বিকাশ নম্বরের গ্রাহকের বিস্তারিত ঠিকানা সংগ্রহ করি।

গ্রাহক পরিচিতি পর্যালোচনায় দেখা যায় গ্রাহক একজন ৫০ বছরের মহিলা এবং তিনি একটি সরকারি অফিসে চাকরি করেন। তার বিস্তারিত অনুসন্ধানে আমি নিশ্চিত হই যে, তিনি এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত থাকতে পারেন না।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেল তারও একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আছে। তখন আমরা অনুমান করে নিলাম যে তাহলে ওই ভদ্র মহিলার কলেজপড়ুয়া মেয়েই হয়ত এ ঘটনার সাথে জড়িত। যাই হোক রাতে তার বাড়িতে অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হলো। দিনে তার বাড়িটা চিনেও আসা হলো।

রাত ১০টার দিকে আমরা তার বাড়িতে গেলাম। একতলা পাকা বাড়ি। সামনে তালাবদ্ধ কলাপসিবল গেইট। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মহিলার নাম ধরে ডাকতেই উনি এলেন। নিতান্তই এক সহজ সরল মহিলা। আমাদের পরিচয় দিলাম। উনারও পরিচয় নিশ্চিত হলাম। গেইট খুলতে বললাম। ভদ্র মহিলা আমাদের পরিচয় জানতে পেরে ফোন করে তার স্বামীকে দ্রুত বাসায় আসতে বললেন এবং তিনি তালা খোলার জন্য চাবি আনতে গেলেন।

এমন সময়ই গেটের সামনে একটা মেয়ে এসে হাজির। সম্পর্কে ওই মহিলার বোনের মেয়ে। তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে। ওই মেয়েটি অযাচিতভাবেই চিৎকার শুরু করেছে। আমাদের আইডি কার্ড দেখতে চাইল। আমাদের একজন তার আইডি কার্ড ওই মেয়েকে দেখাতেই সে কলাপসিবল গেইটের অপর পাশ থেকে টান দিয়ে আইডি কার্ডটি নিয়ে গেল এবং আমাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করল।

তার খালা গেইট খুলতে চাইলেই সে ধমক দিচ্ছে। আমি তাকে আমার পরিচয় দিলাম এবং বললাম যে আমরা একটা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই এসেছি। সে কোনো কথাই শুনছে না। তার এমন আচরণের কারণ কী জিজ্ঞাসা করতেই সে জানায় যে, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তার নাকি আন্দোলন করার অভিজ্ঞতা আছে। পুলিশ, র‌্যাব নাকি তার পাত্তা দেয়ার সময় নাই।

আমি তাকে বললাম যে, আমিও তোমার একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। এ কারণে হলেও তুমি গেইট খুলো এবং আমাদের অভিযান পরিচালনায় সাহায্য কর। কার কথা কে শোনে। শেষ পর্যন্ত আমরা বাসার ভেতর ঢুকলাম। ওই ভদ্র মহিলার কলেজপড়ুয়া মেয়ের কাছে বিকাশের ওই নম্বরটি পেলাম এবং আমাদের হেফাজতে নিলাম। কিন্তু এ মেয়েটিও অত্যন্ত ভদ্র। জিজ্ঞাসা করতেই সে অকপটে স্বীকার করলো যে, এই নম্বরটি তার মায়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করা এবং এটি সেই ব্যবহার করে।

কিন্তু গত দুই দিন আগে তার এক বান্ধবী তার এই নম্বরটি নিয়েছিল এবং একটু আগেই ফেরত দিয়ে গেছে। যাচাই বাছাই করে দেখা গেল তার কথা সত্যি। এখন তাকে নিয়ে তার ওই বান্ধবীর বাসায় যেতে হবে। কিন্তু তার আগে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় চরিত্র ওই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াকে ডাকা হলো। তার বিস্তারিত পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলো।

কোন বিভাগের ছাত্রী তা জিজ্ঞাসা করলে কলা অনুষদের একটা বিভাগের কথা বললো। পর তাকে বললাম আমাদের সরকারি কাজে বাধা প্রদানের জন্য আমরা তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। একথা বলতেই তিনি মুর্ছা খেয়ে মেঝেতে পড়ে যান। আবার সামনে যাকে পাচ্ছে তারই পা ধরে মাফ চাইতে এগিয়ে আসে। হাস্যকর! আবার বলে তার নাকি ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যাবে। সরকারি চাকরি পেতে সমস্যা হবে। সে মাফ চায়। আর নাকি জীবনে এরকম করবে না। যাই হোক মুখরা রমনীকে মাফ করা হলো।

এবার ওই বিকাশ নম্বরের মেয়েকে নিয়ে সরাসরি তার বান্ধবীর বাসায় গেলাম। মেয়েটিকে বাসায় পেলাম। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে সব স্বীকার করল। তার হেফাজত থেকে সার্টিফিকেটসহ চোরাই যাওয়া সকল মালামাল উদ্ধার করা হলো।

জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে, সেসহ তার কয়েক বান্ধবী ইয়াবা আসক্ত এবং টাকার জন্যই এসব করেছে। তার বেডরুমে ইয়াবা সেবনের কিছু উপকরণও পাওয়া গেল। যাই হোক তার বিরুদ্ধে নিয়মিত চুরির মামলা হলো। পরদিন তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা ও ঈদের পরে তার পূর্ব নির্ধারিত বিবাহ গোল্লায় গেল।

বিষয়টি কি শুধু নির্মমই ছিল? নাকি উপযুক্তও ছিল? না, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র?

লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :