পিতার প্রতি ভালোবাসা

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৭, ১৪:১৩ | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৩৪

সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম

অমিততেজী এক মহানায়ক, যিনি বাঙালি জাতির আলোর দিশারি, যিনি  সোনার বাংলা  গড়ার স্বপ্ন  দেখতেন  সেই ছোটো বেলা থেকে, যিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ  বাঙালি আমাদের  জাতির  পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর  রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট  নিষ্ঠুর, নির্মমতা, ক্ষমতা লিপ্সা আর  অসম প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এই ক্ষণজন্মা, কালজয়ী মহামানবকে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিনী আর পরিবারের প্রায় সব সদস্যসহ।

১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় শোক দিবস। দিবসটি আসলেই পুরনো অনেক কথা মনে  পড়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়ংকর নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাণ হারান। তবে মহান আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে ঠিক সে সময়  বিদেশে অবস্থান  করায়  বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  এবং শেখ রেহানা। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শেখ ফজলুল হক মনির বংশধরদ্বয়।

মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস কখনো গ্রামে পালিয়ে কখনো খাটের নিচে লুকিয়ে, কখনো বা মাটির গর্তে লুকিয়ে চোখ বন্ধ করে একটি আশার স্বপ্ন শুধু দেখেছি, যে স্বপ্ন জীবন বাঁচিয়ে রাখার সাহস জুগিয়েছে। সে স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা দেখার স্বপ্ন,  যে স্বপ্ন ছিল লাল সবুজ পতাকা উড়ানোর স্বপ্ন। স্বপ্নের সেই স্বাধীনতার স্বাদ পেতে না পেতেই বা বুঝে উঠার আগেই ১৯৭৫ সালে দেশে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটে গেল। আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম, শুনলাম- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার খবর আমার কিশোরী অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কী অর্জনের জন্য জগত জোড়া খ্যাত এতো বড় কীর্তিমানের নির্মম অবসান  বুঝে উঠতে পারছিলাম না! স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখছিলাম অদ্ভুত সব অঘটন! নয় মাসের পবিত্র রক্তভেজা মাটি তখনো ভাল করে  শুকাতে পারেনি। সেই পবিত্র রক্তভেজা মাটিতে অদ্ভুত, অচেনা মানুষদের  ছন্দহীন, সশব্দ, সহিংস্র পদচারণা। কী করবো! কাকে কী জিজ্ঞাসা করবো! আমরা কোথায় চলছি কিছু বুঝতে পারছি না! বাংলাদেশ রেডিও খুললেই আদ্ভুত এক কণ্ঠে  বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কৃতিত্বের ঘোষণা।   দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা! এর ফাঁকে ফাঁকে পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী আহমেদ রুশদি, আইরীন পারভীন, নুরজাহানের গাওয়া সব উর্দু গানের আসর। অবাক করা কাণ্ড! কোথা  থেকে  কোথা যাচ্ছি  আমরা? 

আমি  গোপালগঞ্জ  থেকে ঢাকা আমার সেঝ বোনের রাজারবাগ বাসাতে বেড়াতে  এসেছিলাম ।  ১৯৭৫ সালের  ১৪ আগস্ট  ছিল আমার  বোনের বড় ছেলের দ্বিতীয় জন্মদিন। মেহমান  চলে যেতে  প্রায়  রাত ১২ টা বেজে গিয়েছিল। অনেক রাতে  সবাই  ঘুমাতে গিয়েছে। কতক্ষণ ঘুমাতে  পেরেছিলাম মনে নেই। শুধু মনে আছে  গভীর রাতে  রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে  ভেসে  আসছে ভয়ঙ্কর গোলাগুলির শব্দ। যুদ্ধের আতঙ্ক তখনো  কারো মন থেকে মুছে যায়নি তাই ভয়ে আতঙ্কে বিছানা  আঁকড়ে  ধরে  বসে  আছি।  কিছু বুঝে  উঠতে পারছিলাম না কেন  আবার  যুদ্ধ? কে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? কী উদ্দেশ্যে করছে? এবার কী হতে  যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। গোলাগুলির শব্দে আমরা সবাই ভয়ে  জড়োসড়ো হয়ে  এক খাটে বসে থাকি।  পরদিন ১৫ আগস্ট খুব ভোরে সম্ভবত ফজরের আজানের পর  দুলাভাই বাসা থেকে বের হয়ে  যান।  কিছুক্ষণের  মধ্যেই  তিনি  ফিরে আসেন। বাসায় ফিরে উনি দুই হাতে মাথা চেপে বসে  থাকলেন কিছুক্ষণ, এরপর ভেজা ভারী কণ্ঠে জানালেন  ‘বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে...।’ তখন সাদাকালো টিভি চ্যানেল শুধু একটি- ‘বিটিভি’,  যার কার্যক্রম চলতো সম্ভবত  সন্ধ্যা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত।  দুলাভাই অনেক খোঁজাখুঁজি  করে একটি পুরনো রেডিও  খুঁজে পেলেন। রেডিও অন করতেই  শোনা  গেল অদ্ভুত  এক কণ্ঠ! অদ্ভুত সব কথা আর ঘোষণা! বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার  কৃতিত্বসহ  পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেবার কৃতিত্ব  সেই অদ্ভুত অচেনা কণ্ঠে...।

“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ” প্রতি ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে আমি আমার কিশোরী অনুভুতি নিয়ে  যা  দেখেছিলাম আর বুঝেছিলাম সেই  কথাগুলি আমি আমার আগের একটি লিখাতেও উল্লেখ করেছি। আমি শুধু আমার চোখে দেখা  না বোঝা ঘটনাগুলি উল্লেখ করেছিলাম। আজকে কেন জানি না মনে পড়ছে আমার  পরিপূর্ণ বয়সে দেখা আর  বোঝা  কিছু ঘটনা যা “ জাতির পিতা”  এবং তাঁর ক্ষণজন্মা সুযোগ্য সুকন্যা আমাদের “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা”-উভয়ের প্রতি কিছু মানুষের আপ্লুত ভালবাসার বিকৃত  প্রকাশের বাস্তব রূপ যা কখনো কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। 

অতি সম্প্রতি “পিতার ” প্রতি ভালবাসার প্রাবল্যে  আপ্লুত কিছু দেশপ্রেমী  স্বপ্রণোদিতভাবে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে অসম্মান, অমর্যাদা এমনকি হাজতবাসের ব্যবস্থা , আর্থিক ক্ষতিপূরণ– ইত্যাদি ব্যবস্থা করতে কোনো কিছুতেই কুণ্ঠাবোধ করেননি। সেই কর্মকর্তার অপরাধ ছিল তিনি ‘পিতার’ প্রতি সম্মান দেখিয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলায় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে একটি শিশুর আঁকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি   সংযোজিত করেছিলেন।  শিশুর আঁকা ছবিতে আন্তরিকতার কোনো কমতি না  থাকলেও  হয়তো  বঙ্গবন্ধুর হুবুহু আদলটি ফুটে উঠেনি। বঙ্গবন্ধুর  এরূপ বিকৃত (?) ছবি দেখে ভালবাসায় আপ্লুত মর্মাহতগণ পাঁচ কোটি টাকার মানহানির অভিযোগে  ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই ভালোবাসাবাসির বিকৃত কর্মকাণ্ডের অবসান হয় ‘ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য বিদুষী সুকন্যা “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার” সুবিবেচনামূলক সিদ্ধান্তে– “বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমনকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব হিসেবে পদায়ন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।---”

বর্তমানে সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত আমার স্বামীর (মুক্তিযোদ্ধা) সুদীর্ঘ চাকরি জীবনে এমন  অতি ভালবাসাবাসির প্রাবল্যের চাপ সইতে হয়েছে  কখনো তাঁকে কখনো আমাকেও । “জাতির পিতার ” প্রতি  সশ্রদ্ধ সম্মান, মর্যাদা  অক্ষুণ্ণ রেখে  অন্তত দুইটি  ঘটনা বর্ণনা করার ইচ্ছা প্রকাশ  করছি -  

১৯৯০ সাল থেকে  বেশ কয়েক বছর ধরে জেলা প্রসাশকের “ফিট লিস্টে”  নাম থাকা সত্বেও বিএনপি  সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার  কারণে দলীয় বিবেচনাতে (বিসিএস ১৯৭৩ বা মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচ হওয়ার কারণে) তাঁকে অযোগ্য বিবেচিত করে কোনো জেলাতে পোস্টিং দিতে বার বার বিব্রত সরকার অবশেষে ১৯৯৫ সালে সুদূর সীমান্ত জেলা ‘পঞ্চগড়ে’ জেলা প্রশাসক হিসেবে পোস্টিং দেন।

তখন চারিদিকে বিএনপি সরকার  বিরোধী আন্দোলন চলছে। উত্তরবঙ্গে এই আন্দোলনের রূপ ছিল ভয়াবহ। এ অবস্থায় জেলার বিভিন্ন  সামাজিক সংগঠনের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে যায়। এরই মধ্যে ইলেকশন হয়,  ইলেকশন বাতিল হয়। ১৯৯৬ সালে পুনরায় ইলেকশনে  আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। নতুন সরকার গঠনের পর পুরো উদ্যোমে জেলার কার্যক্রম শুরু হয়। বিভিন্ন সংগঠনগুলি  ঢেলে  সাজানো হয়। এমনই  একটি সংগঠন  “জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা”। জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উদ্যোগী, উৎসাহী সহধর্মিনী, বিভিন্ন খেলাতে  পারদর্শী, দক্ষ   স্থানীয় মহিলারা, রাজনৈতিক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সহধর্মিনী,  পদাধিকার বলে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার  স্ত্রী-  এঁদের সবার সমন্বয়ে “জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা” পুনর্গঠন করা হয়। জেলা প্রশাসকের সহধর্মিনী   হিসেবে পদাধিকার বলে সভানেত্রীর গুরুদায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়। জেলা  আওয়ামী লীগ সম্পাদকের সহধর্মিনী এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এর সহধর্মিনী দুজনে একত্রে সহসভানেত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সহধর্মিনীসহ আরও বেশ কিছু সরকারি বেসরকারি      গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সহধর্মিনীরাও গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কমিটি গঠনের পর সফলভাবে  এর  কার্যক্রম চলতে থাকে (পঞ্চগড় মহিলা ভলিবল টিম তখন সবার সহযোগিতায় আর আমার সভাপতিত্বে  বেশ কয়েকবার  জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায়  কৃতিত্বপূর্ণ  স্থান অর্জন  করে)।

এরইমধ্যে কোনো এক মিটিংয়ের কার্যক্রম চলাকালীন আকস্মিকভাবে বা আনাহুতভাবে কোনো এক  আওয়ামী লীগ নেতার সহধর্মিনী পরিচয় দানকারী  মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে পরিবেশ উত্তপ্ত করে তোলেন এবং  পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্যালাপ চলতে থাকে। প্রথম দিকে আমি ঠিক  বুঝতে পারছিলাম না  তিনি কি বলতে চাইছেন। সবশেষে  আমি তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে  আমি যখন সবাইকে শান্ত হয়ে মিটিংয়ের প্রতি  মনযোগী হতে অনুরোধ করছিলাম তখন সেই নারী আমার সামনে এসে টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার  করে বলতে থাকে, “Who are you?” “ আমাকে থামতে বলার আপনি কে? সভাপতির এই চেয়ারে বসার আপনার কোনো অধিকার নাই, আপনার স্বামী, ডিসি সাহেব “বঙ্গবন্ধুর” চেতনা ধারণ করে না,  সে  বিএনপি সরকারের আমলে এখানে ডিসি হয়ে এসেছে। সুতরাং আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নাই। আপনারও এই পদে থাকার  কোনো অধিকার নাই, আপনি সভাপতির পদটি আওয়ামী লীগের নেতা  তার স্ত্রীর উপর ছেড়ে দেবেন---।” যে কোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা আমি হতভম্ব হয়ে যাই কোনো নারী এমন অশোভন আচরণ দেখে। যিনি  চিৎকার করে দাবি করছেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর চেতনা, আদর্শ অন্তরে ধারণ করে আছেন এবং তিনি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমী। মুক্তিযুদ্ধ,  দেশ প্রেমে বা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসায় আপ্লুত সেই নারীকে আমি ভালো করে দেখা বা বোঝার আগেই উপস্থিত  অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহধর্মীরা ওই নারীকে মিটিং কক্ষ থেকে বের করে  দেন। চার বছর ধরে আমি আমার উপর অর্পিত সেই গুরুভারটি সবার সহযোগিতায় সফলভাবে পরিচালিত করি। সফলতা বা সহযোগিতার বিষয়টি যেমন এখনো  আমাকে আবেগ আপ্লুত করে তেমনি বঙ্গবন্ধুর চেতনায়  আপ্লুত (?)  সেই নারীর অশোভন আচরণ  স্মরণ করে আমি  এখনো বিচলিত হই, মর্মাহত হই।

১৯৯৫ হতে ১৯৯৯ পর্যন্ত পঞ্চগড় চার বছর সফলভাবে  জেলা প্রশাসকের  দায়িত্ব পালনের পর আমার  স্বামীকে পুনরায় ১৯৯৯ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলি করা হয়। সঙ্গত কারণে সেখানেও “জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার” এবং জেলা “লেডিস ক্লাবের” সভাপতির  গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। সেখানেও প্রায় দুই  বছরের অধিককাল আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব অন্য সবার সহযোগিতায় সফলভাবে পরিচালনা করি। স্থানীয় নারী এবং শিশুরা আমার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। সেই আকর্ষণের ফলশ্রুতিতে মাঝে  মাঝেই  বিভিন্ন নারী এবং শিশু সমাবেশে বা প্রতিযোগিতায় তাঁদের দাবিতে  পুরস্কার বিতরণী  অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে  তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার পরম  সৌভাগ্যের সুযোগ গ্রহণ করি। আমি নিজে সানন্দে সেসব  মুহূর্তগুলি উপভোগ করতাম, বিশেষ করে শিশুদের সমাবেশ। সিরাজগঞ্জে দায়িত্বভার গ্রহণের শুরুর দিকে একটি শিশুদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়  পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্কুলের শিশুরা দাবি করে বসে তাঁরা আমার হাতে পুরস্কার গ্রহণ করবে (শিশুরা বিচিত্র আর সহজ সাধারণের প্রতি সহজে আকৃষ্ট হয় বলে)। আমি ঢাকায় আমার কর্মক্ষেত্রে  কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বাচ্চাদের আবদারের বিষয়টি জানান। আমি বিব্রতবোধ করি, কারণ প্রায় ১৫ দিনের  মধ্যে আমার পক্ষে সময় বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমি অনুরোধ করি অন্য কারো হাতে পুরস্কার বিতরণের ব্যবস্থা করার জন্য। প্রধান শিক্ষিকা দুইদিন পর আমাকে ফোন করে জানান যে বাচ্চারা আমি ছাড়া আর  কারো হাতে পুরস্কার গ্রহণ করবে না। বাচ্চাদের কথা মনে করে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেই যে এক দিনের জন্য হলেও আমি সিরাজগঞ্জ যাব এবং  বাচ্চাদের স্কুলটিতে উপস্থিত হয়ে তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেব। নির্ধারিত দিনে আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপস্থিত থেকে  বাচ্চাদের  সঙ্গ দেই, তাদের  আয়োজন উপভোগ করি, বাচ্চাদের আনন্দ, উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। অনুষ্ঠান শেষে প্রধান শিক্ষিকার  কক্ষে চায়ের আয়োজন  করা হয়। কক্ষে বসে খেয়াল করে দেখি সেখানে আরও কিছু ভদ্র নারী, পুরুষ বসে আছেন। সবাইকে আমি শিক্ষক, শিক্ষিকা মনে করি। তাদের মধ্যে থেকে একজন আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে না দিতেই বলতে থাকেন, “আমি স্থানীয়  বিশিষ্ট  আওয়ামী লীগ  নেতা---। বঙ্গবন্ধু  শেখ  মুজিবুর রহমান  আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতো, সে কোনোদিন আমার সামনে চেয়ারে বসতো না,  কোনো অনুষ্ঠানে  যে কোনো সরকারি অফিসারকেই  প্রধান অতিথি করা হোক আমি উপস্থিত থাকলে আমিই সবার হাতে পুরস্কার  বিতরণ করি। সব সরকারি অফিসার আমাকে মুরব্বি মানে, আজকে  অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতেও আপনি কেন আমাকে দিয়ে পুরস্কার বিতরণ করতে বললেন না। ---।” তিনি আরও কী কী বলতেন বা বলেছিলেন সেসব শোনার বা বোঝার আগেই অসম্ভব ভালো, মার্জিত, ভদ্র , সুবিবেচক  প্রধান শিক্ষিকা পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। তিনি সেই নেতাকে   বলতে থাকেন, “চাচা উনি আমাদের মেহমান, আমাদের বিশেষ অনুরোধে উনি একদিনের জন্য  ঢাকা থেকে চলে এসেছেন বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য---” আমার চায়ের কাপ হাতেই  রয়ে  যায়, কাপে আর  চুমুক দেয়া হয় না---। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে সব রকম সৌজন্য রক্ষা  করে  সবার  থেকে বিদায়  নিয়ে চলে আসি। ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই বছরেরও অধিককাল সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিলে মিশে  সিরাজগঞ্জেও আমাদের সুন্দর  সময়  কেটে যায়  তারপরও  অসৌজন্যমূলক ঘটনা দুটি এখনো আমার মনে দাগ কেটে আছে,  এখনো মর্মাহত হই। 

সুভক্ষণে জন্ম নেয়া ক্ষণজন্মা মহামানব “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের “চেতনার ধারক বা বাহক (?) এসব মানুষগুলি এরূপ  অশোভন আর অসহিষ্ণুতার দীক্ষা কোথা  থেকে নিয়েছে ভেবে পাই না! জন্মের  পর হতে পরিবার থেকে জেনেছি বঙ্গবন্ধু আন্তরিকতা আর সৌজন্যতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তাঁর চেয়ে বয়সে এক বছরের বড়কেও তিনি গুরুজন তুল্য সম্মান দেখাতেন। সম্মানীয় বা মর্যাদাবান ব্যক্তিদের তিনি উপযুক্ত সম্মান দেখাতেন। সুবক্তা, সুভাষী, পরোপকারী, সত্যবাদী, নীতিবান, নির্ভীক দৃঢ় চিত্তের জন্য তিনি তাঁর ছোটবেলা থেকেই সবার প্রিয় ছিলেন। একজন বঙ্গবন্ধু রাতারাতি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেননি, বঙ্গবন্ধু  হওয়ার চর্চা তিনি করে এসেছেন  তাঁর  ছোটবেলা থেকে অথবা তিনি বঙ্গবন্ধু  হয়েই জন্ম গ্রহণ করেছেন। তাঁর এসব গুণের গল্প পরিবারের  তাঁর কাছ থেকে শোনা  যিনি তাঁদের ছোট বেলা থেকে শুরু করে কলেজ জীবন পর্যন্ত  এক সাথে কাটিয়েছেন। কর্মজীবনে  বিচ্ছিন্ন  হলেও তিনি স্মৃতিকথাগুলি ধারণ করে রেখেছিলেন অন্তরে। সময় অসময়ে তাঁর  আওড়ানো সেই  স্মৃতি কথাগুলো হয়তো এতো ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি  যখনও তিনি সবার মুখে মুখে “বঙ্গবন্ধু” হয়ে  উঠেননি বা সার্বজনীন ভাবে “জাতির পিতা” হয়ে উঠেননি।

মাঝে মাঝে মনে হয় বিশেষ  বিশেষ দিনে বঙ্গবন্ধুর  মাজার বা তাঁর স্মৃতি বিজড়িত বিশেষ  বিশেষ স্থান গুলিতে পুষ্পার্ঘ/পুষ্পস্তবক দেবার নামে শুধু ঠেলা-গুতার আনুষ্ঠানিকতা না করে  বিশেষ বিশেষ দিনে এই বিশেষ  বিশেষ  স্থানগুলি  ঘিরে  সর্বস্তরের সবার জন্য বঙ্গবন্ধুর ধারণ করা বা  চর্চা করা  গুণাবলি বা আদর্শের কিছু নিজেদের মধ্যে ধারণ করে প্রকৃত দেশপ্রেমী হবার লক্ষ্যে বিশেষ পদ্ধতিতে দিক্ষা বা শপথ নেয়ার ব্যবস্থা করা  যায় কি না! 

আইনজীবী- সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ