শরীয়তপুরে শিক্ষার্থী খুন-ধর্ষণ-নিখোঁজ বাড়ছে

শরীয়তপুর প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৩ আগস্ট ২০১৭, ০৮:২৪

শরীয়তপুরে একের পর এক শিশু শিক্ষার্থী নিখোঁজ, স্কুলছাত্রী ধর্ষণ, গৃহবধূ খুন, প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা, অজ্ঞাত গলাকাটা লাশ উদ্ধার- এ রকম বহু ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে স্কুল ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থী নিখোঁজ ও লাশ উদ্ধার এবং ধর্ষণের ঘটনাই বেশি। ফলে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।

স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। কেননা, একটি খুনের আংশিক রহস্য উদঘাটন ছাড়া বাকি ঘটনাগুলোর কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

এই প্রতিবেদনে ২৯ জুন থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময়ের তথ্য নেয়া হয়েছে। নিখোঁজ লোকজনের পরিবার, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই এক মাসে জেলায় দুই শিশুর লাশ উদ্ধারসহ পাঁচটি খুন সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া তিন শিশুসহ চারজন নিঁেখাজ, তিন স্কুলছাত্রী ধর্ষণ, অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাসহ বেশ কটি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার করা হয়।

এই প্রতিবেদনের সর্বশেষ ঘটনাটি ৩০ জুলাইয়ের। শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের কোয়ারপুর তেতুলিয়া গ্রামে নানিবাড়ি বেড়াতে গিয়ে ওই দিন রাতে রিমা আকতার নামে অষ্টম শ্রেণীতে পড়–য়া এক স্কুলছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় খোরশেদ ফকির, দীপুসহ তাদের সহযোগীদের নামে পালং মডেল থানায় মামলা হয়।

এর আগে ২৮ জুলাই নিখোঁজ হয় ডামুড্যা উপজেলার চর মালগাওঁগ্রামের দুলাল চৌকিদারের ছেলে বড়সোনামুূখী নেছারিয়া আজিজিয়া মাদ্রাসার নাজেরা বিভাগের ছাত্র। চুল কাটানোর কথা বলে মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার পর তার আর কোনো সন্ধান নেই। এ ঘটনায় তার বড় ভাই পালং মডেল থানায় জিডি করেন।

নড়িয়ার ভোজেশ্বর ইউনিয়নের পাচক গ্রামের মৃত আজাহার ছৈয়ালের মেয়ে পাচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী (১২) তার নানিবাড়ি চৌকিদার কান্দিতে বেড়াতে যায়। সেখানে ২৭ জুলাই রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হলে প্রতিবেশী আরিফ মুন্সি তাকে মুখ চেপে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে আরিফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২৪ জুলাই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সখিপুর থানার শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. হুমায়ূন কবির উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে একই গ্রামের মুজাফর হাওলাদারের ছেলে মিরাজ হাওলাদার তার সহযোগীদের নিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায়। শাহনাজের চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এলে বখাটেরা পালায়য়। এ ঘটনায় সখিপুর থানায় মামলা হয়।

২৩ জুলাই শরীয়তপুর সদর উপজেলার উত্তর ভাষানচর গ্রামের ইদ্রিস মাদবরের ছেলে দাদপুর নুতনহাট নোমানিয়া কওমিয়া ও হাফেজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র (১১ পাড়া হাফেজ) ওসমান গনি মাদবর (১১) মাদ্রাসা থেকে নুতনহাট বাজারে গিয়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে একটি আখখেতে তার গলা কাটা ও এক চোখ উপড়ানো লাশ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় পালং মডেল থানায় মামলা হয়।

১৫ জুলাই সখিপুর সরদার কান্দি গ্রামের লেহাজ উদ্দিন শেখের মেয়ে সখিপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী লিজা আকতার (১০) বাড়ির পাশের রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। আট দিন পর বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ছৈয়াল কান্দি বিলে পাটক্ষেতের পাশে ভাসমান অবস্থায় তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় দুজন গ্রেফতার হয়।

১১ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টায় কাচিকাটা ইউনিয়নের চরজিংকিং গ্রামের রহমান মোল্যার মাদকাসক্ত ছেলে জহিরুল কথা কাটাকাটির জের ধরে মায়ের ওপর গুলি ছোড়ে। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তার স্ত্রী স্বপ্না বেগমের পায়ে বিদ্ধ হয়।

১১ জুলাই সখিপুর থানার আনন্দ বাজারের উত্তর পাশে রাস্তার পাশে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির (৩০) গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সখিপুর থানার উপপরিদর্শক নাজমুল হোসেন বাদী হয়ে সখিপুর থানায় মামলা করেন।

গত ১১ জুলাই শরীয়তপুর সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নের পশ্চিম চরোসুন্দি গ্রামের দেলোয়ার হোসেন সরদারকে প্রতিপক্ষের লোকেরা প্রকাশ্য দিবালোকে কোপায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় পালং মডেল থানায় মামলা হয়।

১০ জুলাই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নড়িয়া পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলী ছৈয়াল লোনসিংহ বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর জখম করে ধারালো দীল মোহাম্মদ, বাবর আলী সরদার, চুন্নু ছৈয়াল, সায়েদ সরদার, মতিন সরদার সিরাজ সরদারসহ কতিপয় লোক।

৭ জুলাই ভেদরগঞ্জ উপজেলার ওহাব ঢালী কান্দি গ্রামের নান্নু খানের ছেলে ডিএমখালী ইউনিয়নের মোল্যা কান্দি নুরানী মাদ্রাসার ছাত্র সিয়াম মাহমুদ আরাফাত বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় যাওয়ার পর থেকে নিখোজ। পরদিন ৮ জুলাই সিয়ামের বাবা সখিপুর থানায় একটি জিডি করেন। আজও তার কোনো সন্ধান মেলেনি।

২ জুলাই জাজিরা উপজেলার উমেদ আলী গোমস্তা কান্দি গ্রামের আবুল হাসেম সেকের ছেলে নুরুল আমিন সেক তার ৭ মাসের অন্তÍঃসত্ত্বা স্ত্রী রেশমা বেগমকে যৌতুকের জন্য গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে বিছানায় ফেলে রেখে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় জাজিরা থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ আমিনের মাকে আটক করে।

গত ২৯ জুন সদর উপজেলার পূর্ব চরোসুন্দি গ্রামের আ. রব সরদারের ছেলে ফরিদ সরদার তার স্ত্রী রেশমাকে যৌতুকের জন্য হত্যা করে ঘরের পাশে একটি কাঁঠালগাছে রশি বেঁধে তাতে ঝুলিয়ে রেখে বাবা-মাসহ পালিয়ে যান। এ ঘটনার অভিযোগে নিহতের পরিবার পালং মডেল থানায় মামলা করে।

শিশু নিখোঁজ, খুন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অভিভাবকরা জরুরি পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের প্রতি দাবি জানাচ্ছেন। সখিপুরের এক ছাত্রের অভিভাবক ইকবাল খান বলেন, ‘একের পর এক বিদ্যালয়গামী শিশু নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমাদের বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায়। এ ব্যাপারে প্রশাসন কর্যকর ব্যবস্থা নিয়ে কঠোর হওয়া উচিত।’

লিজার নিখোজ ও মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে বলে জানান সখিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মেসবাহ উদ্দিন। তিনি বলেন, এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উপস্থিতিও কমে গেছে।

পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খলিলুর রহমান বলেন, দেলোয়ার হত্যার ঘটনায় পাঁচজন, ওসমান হত্যায় একজন এবং রিমা ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

প্রতিিিট ঘটনার আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান সখিপুর থানার ওসি মো. মঞ্জুরুল হক আকন্দ। তিনি বলেন, কিছু কিছু মামলার আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

জাজিরা থানার ওসি মো. এনামূল হক বলেন, রেশমা হত্যার মূল আসামী আতœগোপনে আছ্ ে। তাকে গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা চলছে। বাকি আসামীরা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছে।

নড়িয়া থানার ওসি মোঃ আসলাম উদ্দিন বলেন, চৈতি ধর্ষনের ঘটনায় ধর্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার অভিযোগ পত্র দাখিলের প্রক্রিয়া চলছে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আযাদ বলেন, লিজা ও ওসমানের খুনের পর বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অভিভাবকদেরও এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

সহকারী পুলিশ সুপার গোসাইরহাট সার্কেল খায়রুল হাসান বলেন, স্কুলছাত্রী লিজা হত্যার ঘটনায় আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে। একটি খুনের এখনো পরিচয় মেলেনি। অন্যান্য মামলার তদন্ত কাজ চলছে। এ ছাড়া ডামুড্যার নিখোঁজ স্কুলছাত্রী, ভেদরগঞ্জের স্কুলছাত্রকে উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রতিটি ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান সহকারী পুলিশ সুপার নড়িয়া সার্কেল মো. আবদুল হান্নান। অধিকাংশ মামলার গ্রেপ্তার আসামি আদালতে দোষ স্বীকার করেছে। এসব মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১৩আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :