১১ বছর পরও সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালায় হতাশা

ফরহাদ খান, নড়াইল
 | প্রকাশিত : ১৩ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৩৭

১১ বছরেও ‘এস এম সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা’ নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। লোকবলের অভাবে প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে সংগ্রহশালাটি। তাই দর্শণার্থীদের বেশির ভাগ সময় ফিরে যেতে হয়।

সংগ্রহশালার একজন কর্মচারীকে প্রায় ১০ জনের কাজ করতে হয়। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেলে সংগ্রহশালার কার্যক্রমও অচল হয়ে পড়ে।

উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে শিশুস্বর্গের মঞ্চ। সংগ্রহশালার দেওয়ালেও স্যাঁতস্যাতে অবস্থা বিরাজ করছে। ইঞ্জিনচালিত দুই তলা নৌকাটিও চিত্রা নদীর পাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। শিশুদের জন্য নৌকাটি নির্মাণ করিয়েছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান; যা ‘ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ’ নামে পরিচিত।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত এসএম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা ২০০৬ সালের ১৪ অক্টোবর দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের পর চার মাস বেতন পান তারা। পরে আর বেতন পাননি কেউ। বর্তমানে একজন সহকারী কিউরেটর, মালি এবং অফিস সহায়ক কর্মরত আছেন। তবে, এখানকার মালি গোলাপ কাজীকে গ্যালারি গার্ড, ঝাড়ুদার এবং শিশুস্বর্গের তত্ত্বাবধায়কসহ দর্শণার্থীদের দেখভালের দায়িত্বও পালন করতে হয়।

দর্শনার্থীসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্মৃতিসংগ্রহশালার প্রবেশদ্বারের (গেট) পাশে অভ্যর্থনা কক্ষ বা টিকিট কাউন্টার থাকলেও ১১ বছর ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। ব্যবহারের আগেই ধূলোবালিতে বিবর্ণ হয়ে গেছে এখানকার চেয়ার, টেবিল, ফ্যানসহ আসবাবপত্র।

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আগাম যোগাযোগ করে রাখলে তবেই সংগ্রহশালায় প্রবেশের সুযোগ মেলে দর্শণার্থীসহ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের।

নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাথী খানম বলেন, ‘প্রায় সময়ই সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা বন্ধ থাকে। সময়টা সকাল হোক, কিংবা বিকেল; সবসময় বন্ধ থাকে।’

যদিও প্রবেশদ্বারে ঝুলানো সাইনবোর্ডে সংগ্রহশালা খোলার সময় সূচি লেখা আছে, সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটা এবং বিকাল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত। আর যোগোযোগের জন্য অস্পষ্ট মোবাইল ফোন নাম্বার দেয়া আছে। তবে, প্রবেশদ্বারে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অভ্যর্থনা কক্ষ বা টিকিট কাউন্টারেও কেউ কখনো বসেন না।

যশোর এমএম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের সম্মান শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘চিত্রশিল্পে এসএম সুলতানের খ্যাতি বিশ্বজোড়া থাকলেও তার প্রিয় শিশুস্বর্গ, ভ্রাম্যমাণ নৌকা, সংগ্রহশালা বেশ অবহেলিত। লোকবল ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সুলতানের শিল্পকর্ম সবাই দেখার সুযোগ পায় না। প্রবেশপথে দর্শনার্থীদের হোঁচট খেতে হয়। পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে।’

নড়াইলের গণমাধ্যম কর্মীরা জানান, সুলতানের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী এলে দুই তিন দিন সংগ্রহশালায় একটু যতেœর ছাপ পড়ে। অন্য সময় অবহেলিত থাকে। দর্শণার্থীসহ দেশ-বিদেশের কোনো অতিথি সংগ্রহশালা পরিদর্শনে আসলে এখানকার মালি গোলাপ কাজী প্রবেশদ্বারের চাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন। তিনিই আবার দর্শনার্থীদের সঙ্গী হয়ে সুলতান সংগ্রহশালা ঘুরে দেখান।

সুলতানের ছাত্র চিত্রশিল্পী বলদেব অধিকারী বলেন, ‘সুলতানের চিত্রকর্ম বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হলে তার সৃষ্টিকর্মকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেক্ষেত্রে সংগ্রহশালা নিয়মিত খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমনটি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়ার কুঠি বাড়িসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান নিয়মিত খুলে রাখা হয়। সেখানে প্রবেশমূল্যের ব্যবস্থা আছে। সুলতান সংগ্রহশালার ক্ষেত্রেও প্রবেশমূল্যের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে সেই টাকা থেকেও নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বেতন পুষিয়ে যাবে।’

দর্শণার্থীরা জানান, হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেলে সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালার ভেতরে সৃষ্টি হয় ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রায় দেড় বছর ধরে আইপিএসটি অকেজো হয়ে পড়ে থাকলেও মেরামত করা হচ্ছে না। সমস্যা রয়েছে এসিরও। এতে প্রয়োজনীয় আলো-বাতাসের অভাবে সুলতানের আঁকা ছবিসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুলতান সংগ্রহশালার দেওয়ালে স্যাঁতস্যাতে অবস্থায় বিরাজ করছে। আর উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে শিশুস্বর্গের মঞ্চটি। ভেঙে পড়ে গেছে মঞ্চের কয়েকটি কাঠ। এই মঞ্চেই সুলতানের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এছাড়া প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ইঞ্জিনচালিত দুই তলা নৌকাটিও রাখা হয়েছে চিত্রা নদীর পাড়ে। সম্প্রতি নদীর পাড় ভেঙে নৌকাটি ঝুঁকির মধ্যে আছে।

এ বিষয়ে নড়াইল পৌর মেয়র এবং জেলা প্রশাসককে অবগত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালার সহকারী কিউরেটর মেহেদী হাসান রানা। তিনি বলেন, ‘এখানে শীতের সময় দেশ-বিদেশ থেকে অনেক দর্শণার্থী আসেন। কিন্তু, লোকবলের অভাবে আমাদের কার্যক্রম কিছুটা বাঁধাগ্রস্ত হয়।’

এ ব্যাপারে মালি গোলাপ কাজী বলেন, ‘সপ্তাহের সবদিনই আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়; কোনো ছুটি নেই আমার। লোকবল নিয়োগ করলে সংগ্রহশালাটি আরো সুন্দর হতো।’

জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা হায়দার আলী জানান, প্রকল্পের মাধ্যমে সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালায় লোকবল নিয়োগ হবে। তিনি বলেন, ‘সংগ্রহশালাটি বর্ধিতকরণও হতে পারে। আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুতই এসব কার্যক্রম শুরু করবে।’

নড়াইল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন বিশ্বাস বলেন, ‘বিগত সময়ে পৌর মেয়র থাকাকালীন সুলতানের স্মৃতিসৌধ এবং বাড়ি যাওয়ার রাস্তা করেছি। প্রয়োজন হলে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে এখনো সহযোগিতা করব।’

জেলা প্রশাসক এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সুলতান সংগ্রহশালাটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও লোকবলের অভাবে কিছু সমস্যা রয়েছে। নিয়মিত খোলার জন্য সুলতান ফাউন্ডেশন থেকে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আশা করছি অচিরেই এ কার্যক্রম শুরু হবে। পাশাপাশি সুলতানের দুর্লভ ও মূল্যবান ছবিগুলোও সংরক্ষণ করা হবে।’

ঢাকাটাইমস/১৩আগস্ট/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :