আগস্ট-আমাদের শোকের মাস

মোহাম্মদ জমির
 | প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট ২০১৭, ১১:৩০

পঁচাত্তরের পর থেকে ১৫ আগস্ট বাঙালির জন্য কালো একটি দিন। সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে এই দিনে বাঙালির ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় রচিত হয়েছিল। কতিপয় চক্রান্তকারী সেনাসদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। তাদের বর্বরতা থেকে শিশু ও নারীরাও রেহাই পাননি। গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধায় পুরো জাতি আগস্ট মাস তার শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণ করছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ঘাতকের বুলেটে নিহত হন তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিল। দেশের বাইরে থাকায় ঘাতক চক্রের হাত থেকে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত সেসব খুনি দীর্ঘদিন ছিল বিচারের আওতাবহির্ভূত। ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সচল হয়। মাঝে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই বিচার ঝুলিয়ে রাখে তখনকার বিএনপি নেতৃত্বে থাকা জোট সরকার। আবার আওয়ামী লীগ সরকারে এলে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আদালতের চূড়ান্ত রায় কার্যকর হয়। খুনিদের পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। ছয়জন এখনো ভিনদেশে পলাতক।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্যতম এক অপকর্ম। পরের ২১ বছর খুনিরা যেভাবে দায়মুক্ত ছিল তাও আরেক কলঙ্কিত অধ্যায়। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ জবরদখলকারী খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন।

অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আবির্ভূত হন। সে সময় বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জনাব সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং জিয়া রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংশোধনীটি পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯।’ এটি এখন সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত আছে।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা দেওয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেত। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘ ২১ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। ওই বছর ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার আইনি বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে মোশতাকের জারি করা এবং জিয়াউর রহমানের সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকের দল দেশকে পাকিস্তানি চেতনায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ২১ বছরের অন্ধকার যুগের পর আবার বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে হাঁটতে থাকে। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের এই চলার পথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন সোনার বাংলা গড়ার। তিনি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। যার জন্য তিনি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, প্রগতিবাদ আর সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন এক ধারার সূত্রপাত করেছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। তা বাস্তবায়ন করার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় জাতির জনককে।

বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের বাতাবরণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান ও তাদের দোসররা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশকে যখন ইসলামবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে অপপ্রচার চালাতে শুরু করে, তখন বঙ্গবন্ধু গৌরবের সঙ্গে বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ার পরে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ।’ তিনি সত্য উদঘাটন করে বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদাররা ইসলাম রক্ষার নাম করে আসলে মুসলিম ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করেছে। তারা অসহায় নারীদের নির্যাতন করেছে।’

একটি বিষয় খেয়াল করতে হবে, বঙ্গবন্ধু প্রগতিশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতীক। এগুলো আসলে মানবে মানবে সম্প্রীতির পথ তৈরি করে দেয়। কোনোভাবেই অধার্মিকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন বঙ্গবন্ধু। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে বঙ্গবন্ধু যে বক্তব্য তুলে ধরেন এতে আরবসহ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা সমুন্নত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যার ইঙ্গিত তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে ভারতের দিল্লিতেই দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করার কথা বলেছিলেন। তাদের বিচার চলার মধ্যেই পঁচাত্তরে ঘাতকরা সক্রিয় হয়ে উঠে। ১৫ আগস্ট কালরাতে তারা জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে। সেই দিনটি ‘ফিফটিনথ আগস্ট’ শীর্ষক একটি ইংরেজি কবিতায় আমি তুলে ধরেছি এভাবে:

সিকিং দ্য ইজি কম্পানিয়নশিপ অব হিপোক্রেসি অ্যান্ড হেট,

ইন ওয়ান আওয়ার, দ্যাট নাইট,

হোয়েন জাস্টিস স্লেপট অ্যান্ড সো ডিড দ্য সেইন্টস,

বুচারস রোমড দ্য স্ট্রিটস অব ঢাকা।

দে সুইপট অ্যাসাইড ইননোসেন্স,

দেয়ার আইজ শোয়িং অ্যাস মাচ চ্যারিটি অ্যাজ গ্লাস।

দেয়ার অ্যাসল্ট ওয়াজ ব্রিফ,

দেয়ার সেভেজেরি লেইং ওয়াস্ট টু ট্রাস্ট।

দে ফেসড নো অবস্টেকল ইন দেয়ার মাইন্ড

টু দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট দে কিলড দেয়ার অ’উন কাইন্ড।

দে ভয়েস অব লিবার্টি ওয়াজ স্নাফড আউট

বাই দ্য ভেরি মেন ট্রেইনড টু সেভ, রেদার দেন মাইম।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার

ঢাকাটাইমস/১৪আগস্ট/এমজেড/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :