বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনিকে ফেরাতে ‘আইনি জটিলতা’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০১৭, ১১:২২ | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০১৭, ০০:০৫

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পলাতক ছয় খুনিকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকরের ছয় বছরেও। উচ্চ আদালতে দণ্ডিত ১২ জনের মধ্যে একজন এরই মধ্যে বিদেশে মারা গেছেন। বাকি ছয় জনের মধ্যে চার জনের অবস্থান সম্পর্কে সরকার নিশ্চিত। আর সরকার নানামুখি চেষ্টা চালিয়ে গেলেও এদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবে-সেটা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলেও কিছু আইনি জটিলতার কারণে সেটি চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। আবার কারও অবস্থানই এখনো শনাক্ত করা যায়নি। এসব কারণে খুব সহসাই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এই হত্যার বিচার শুরু করে। ওই সরকারের আমলে বিচার কাজ শেষ করা যায়নি। আর ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় ফেরার এক বছরের মধ্যে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বজলুল হুদা, মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং মহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর হয়।

বাকি সাত জনের মধ্যে আজিজ পাশা মারা গেছেন বিদেশে। আর আবদুর রশিদ, মোসলেম উদ্দিন, শরীফুল হক ডালিম, রাশেদ চৌধুরী, নুর চৌধুরী এবং আবদুল মাজেদের দণ্ড এখনও কার্যকর করা যায়নি।

পলাতক অবস্থায় ২০০১ সালের ২ জুন জিম্বাবুয়েতে মারা যান খুনি আজিজ পাশা। বাকি পলাতক ছয় খুনিকে ফিরিয়ে আনতে তখন গঠন করা হয় আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স। এই টাস্কফোর্সের সভাপতি আইনমন্ত্রী স্বয়ং। এই আপনারা কী করছেন, জানতে চাইলে ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তবে ‍কিছু আইনি জটিলতা রয়েছে।’

কী ধরনের আইনি জটিলতা রয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে রাশেদ চৌধুরী ওই দেশের সকল আইনে হেরেছেন। কানাডায় নূর চৌধুরীও সকল আইনি প্রক্রিয়ায় হেরেছেন। কিন্তু নূর চৌধুরী সবশেষ যে যুক্তি সেদেশের আদালতে দেখিয়েছেন সেটা হচ্ছে- আমাকে বাংলাদেশে পাঠালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। ওই দেশে আইন আছে- তারা মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না। সেকারণে তারা পাঠাবে না। কিন্তু তারপরেও আমরা হাল ছাড়িনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় আমরা ল ফার্ম নিয়োগ করেছি। তারা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’

চার খুনির অবস্থান জানে সরকার

ছয় বছরের চেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর চার খুনির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে টাস্কফোর্স। এদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

কয়েক বছর লিবিয়ায় পলাতক থাকার পর শরিফুল হক ডালিমের অবস্থান স্পেনে বলে জানিয়েছেন পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক। সে দেশে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনৈক মিজানুর রহমানের সহায়তায় রয়েছেন তিনি। এরপর তাঁকে ফিরিয়ে আনতে স্পেনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে বাংলাদেশ।

আর মোসলেম উদ্দিন জার্মানিতে অবস্থান করছেন বলে জানতে পেরেছে সরকার। তাকে ফেরত আনার ব্যাপারে দুই দেশের সঙ্গে সরকার যোগাযোগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে নূর চৌধুরীকে নিয়ে। তার অবস্থান সবার আগে শনাক্ত হয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থানের কারণে ফেরত দেবে না বলে জানিয়ে যাচ্ছে কানাডা।

পলাতক অন্য দুই খুনি খন্দকার আবদুর রশীদ ও আবদুল মাজেদ কোথায় আছেন, সেটা বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে জানে না।

তবে এই দুই জনের মধ্যে আবদুর রশীদ সর্বশেষ পাকিস্তানে আছেন অসমর্থিত সূত্রে এমন তথ্য পাওয়ার পর গত ডিসেম্বরে তাঁর সম্পর্কে জানতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ওই চিঠির কোনো জবাব দেয়নি পাকিস্তান। আর আবদুল মাজেদ সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে অবস্থানের কথা শুনলেও এখনো তা নিশ্চিত করতে পারেনি বাংলাদেশ।

দুই জনকে ফেরানোর চেষ্টা

রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটন সফরের সময় অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর তিন মাস পর অর্থাৎ ২৭ মে মার্কিন আইনি পরামর্শক সংস্থা স্কাডেন এলএলপিকে রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত আনার কাজে যুক্ত করা হয়। সংস্থাটির পক্ষে মামলার তদারক করছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাবেক আইনি পরামর্শক গ্রেগরি ক্রেইগ। ইতিমধ্যে গ্রেগরি ক্রেইগ ও স্কাডেন এলএলপিতে তাঁর সহকর্মীরা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, আইন দপ্তর, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও অভিবাসন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা আলোচনা করেছেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে তাঁরা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জন স্টুয়ার্ট ব্রুসের সঙ্গে।

রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে গত বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী মার্কিন আইন দপ্তরে অনুরোধ জানান। মার্কিন আইন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে স্কাডেন এলএলপি ঢাকায় জানিয়েছে, রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। গত জুনে পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপসহকারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক লিসা কার্টিসের সঙ্গে বৈঠকে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিতে পুনরায় অনুরোধ জানান।

বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি নূর চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন ২০০৭ সালে কানাডার উচ্চ আদালত খারিজ করে দিলেও তাঁর নিজের দেশে ফেরতের আগে ঝুঁকি মূল্যায়নের প্রক্রিয়া বা প্রি রিস্ক রিমুভাল অ্যাসেসমেন্ট (পিআরআরএ) এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই আইনি সংস্থা টরি এলএলপি বিষয়টি কানাডা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁকে ফেরত পাঠাতে একটি টাস্কফোর্স বা কমিশন গঠনের বিষয়ে গত এপ্রিলে বাংলাদেশের তিন সদস্যের এক প্রতিনিধিদল কানাডায় আলোচনা করেছে। আগামী ডিসেম্বরে এ নিয়ে আবার দুই পক্ষের আলোচনার কথা রয়েছে।

২১ বছর পর মামলা, ১৩ বছর পর সাজা

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে পদে পদে বাধা আসে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিলের পর ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন হাইকোর্ট। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেয়। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচার-প্রক্রিয়া।

ছয় বছর পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।

এরও দুই বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করে। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এর মধ্য দিয়ে ১৩ বছর ধরে চলা এ মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শেষ হয়।

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/এমএম/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

সিজারিয়ান প্রসবের ওপর বিধিনিষেধ আরোপে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ চায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

মিয়ানমার সংকট সমাধানে একজনের খুশির জন্য বাকিদের নারাজ করবে না বাংলাদেশ: সেনা প্রধান

বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়ল ৪ টাকা, কমেছে খোলা তেলের

কর ব্যবস্থা সংস্কার করলে ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান ছাড়তে উৎসাহিত হবে

অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা দেশের মানুষের জন্য কোনো কাজ করেনি: প্রধানমন্ত্রী

বৃষ্টিতেও কমছে না তাপপ্রবাহ

ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল, আলোচনায় যা থাকবে

ছয় জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ, কিছু অঞ্চলে বৃষ্টির আভাস

টাইমের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় বাংলাদেশের স্থপতি মেরিনা

দুই অঞ্চলে সর্বোচ্চ ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের আশঙ্কা, নদীবন্দরে ২ নম্বর হুঁশিয়ারি

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :