বঙ্গবন্ধু হত্যা: আমাকে যা বলেছেন সফিউল্লাহ

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
| আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০১৭, ১৩:২৬ | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০১৭, ১০:৫৪

১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে অনেকেই দায়ী করে থাকেন। ওই সময় তিনি তার দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। কথাটা সত্য হলেও এর পেছনে অবশ্যই বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সামরিক বাহিনীর সিনিয়ারিটি অনুযায়ী এই সময় জিয়ার রহমানের সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার কথা। কিন্তু জেনারেল ওসমানীর পরামর্শে মূলত জিয়াকে সেনাপ্রধান না করে করা হয়েছিল সফিউল্লাকে। কিন্তু কেন?

এ প্রসঙ্গে ১৯৮৭ সালে স্টকহল্ম বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত থাকালীন আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সফিউল্লাহ বলেন, ‘৭১ মুক্তিযুদ্ধে জিয়া একসময় জেনারেল ওসমানীকে কমান্ডিং চিফ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেন। এ ব্যাপারে তিনি (জিয়া) আমাকে বলেন, জেনারেল ওসমানী নাকি পুরাতন (বৃদ্ধ ) হয়ে গেছেন। সুতরাং ইয়ংদের মাঝ থেকে দায়িত্ব নিতে হবে।’ আমি এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করি এবং এব্যাপারে আমার সাথে তাকে আর কোনো কথা না বলার জন্য বলি।

সফিউল্লাহ আমাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন এমন আরো অনেক ঘটনা আছে যা প্রমাণ করে তিনি একজন উচ্চকাংক্ষী ক্ষমতালোভী ছিলেন।’

তাহলে কি এই কারণেই জিয়াকে সেনাপ্রধান না বানিয়ে আপনাকে করা হয়েছিল?

১৯৮৭ সালে স্টকহোম দূতাবাসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে সফিউল্লাহ

-‘সিনিয়রদের রেখে আমাকে কেন চিফ অফ স্টাফ বানানো হলো আমি নিজেই বলতে পারব না। তবে আমাকে যেদিন নাকি জেনারেল ওসমানী দায়িত্বভার নেয়ার জন্য ডেকেছিলেন তখন আমি বলেছিলাম, আমি কেন? অন্যরা কোথায়? তখন তিনি (ওসমানী) আমাকে বললেন, ‘অন্যরা কারা?’। আমি বললাম, ‘কর্নেল রেজা কোথায়?’। তিনি বললেন, ‘কর্নেল রেজা রিজাইন করেছে’। তারপর বললাম দত্তর (সি আর দত্ত) কথা। তিনি (ওসমানী) বললেন, ‘ডু ইউ থিঙ্ক হি ইজ কেপেবল?’। এর কোনো উত্তর না দিয়ে আমি তখন জিয়ার কথা বললাম। উনি তখন রেগে গিয়ে বললেন, ইউ আর আর্গুয়িং, গেট আউট ফ্রম মাই অফিস (তুমি তর্ক করছ। আমার অফিস থেকে বের হয়ে যাও)l আমি তখন অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়ে জেনারেল রবের সাথে আলাপ করি। তখন তিনি আমাকে বললেন এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তlতখন আমি বললাম তিনি তো নিজেই থাকতে পারেন।’ জেনারেল রব বললেন, এপ্রিল ওসমানী সাহেব সামরিক বাহিনী ছেড়ে জাতীয় সংসদে যোগ দিচ্ছেন।’

সফিউল্লাহর দেওয়া উপরোক্ত সাক্ষাৎকার ও জিয়াউর রহমানের পরবর্তী কার্যকলাপ প্রমাণ করেছে সেদিন কেন তাকে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয়নি। তার মানে সফিউল্লাহকে ধরে নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে। একমাত্র এই কারণেই জিয়াকে ডিঙ্গিয়ে তাকে করা হয়েছিল সেনাবাহিনী প্রধান। কিন্তু তার প্রতিদান দিতে তিনি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন বলা যেতে পারে।

এদিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আর্মির যে ট্রুপ্স পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল তাদের কৌশলে রশিদ ফারুক ডালিম চক্র আগের দিন পরিবর্তন করে নিজেদের অনুগত সিপাইদের নিয়োজিত করে বলে অভিযোগ রয়েছেl কিন্তু প্রশ্ন হলো সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের চোখের আড়ালে কী করে সম্ভব? তাহলে কি তারাও ছিল জড়িত? জানা যায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যখন আক্রমণ করা হয় তখন এসব সিপাইরা কোনো বাধা দেয়নি, করেছে একমাত্র পুলিশl ফলে সহজেই খুনিরা বাড়ির ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায়। একমাত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল কিছুটা বাধার সৃষ্টি করেছেন বলে শুনা যায়l

১৪ আগস্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গণভবনে এসেছিলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। বঙ্গবন্ধু তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে সাংবাদিক ঠাকুর বলে সম্মোধন করতেন। এই সময় তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রীl আমি তো বলব, সাংবাদিক নয় সাংঘাতিক ঠাকুর। কি ভয়ংকর ব্যক্তি এই ঠাকুর! সন্ধ্যার ঠিক আগে বঙ্গবন্ধু পায়ে হেঁটে হেঁটে যখন তার বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন তাহের উদ্দিন ঠাকুরও ছিলেন। হত্যার সব পরিকল্পনা শেষ করে এখন এসেছেন নেতার সাথে শেষ সাক্ষাৎ করতে। বিশ্বাসঘাতকতার শেষ নেই। তবে সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কী কথা বলেছিলেন তা আজও অজানা রয়ে গেল।

১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে জেনারেল সফিউল্লাহ বলেন, ‘১৫ আগস্টের কথা বলতে গেলে তার আগে আমাকে দুই একটা কথা বলতে হবে। ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযে যাওয়ার কথা। ওখানে ওনার অনুষ্ঠানের জন্য যে মঞ্চ তৈরি করা হয় সেখানে ১৪ আগস্ট কিছু বিস্ফোরণ ঘটে। এ ব্যাপারে আমার কাছে সাহায্য চাইলে আমি সেখানে লোক পাঠাই। ওইদিন আরেকটি ঘটনা ঘটে। ইন্ডিয়ান আর্মির একটি হেলিকপ্টার (আমাদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল) যা নাকি চিটাগং ডিভিশনে ছিল সেটা নরমাল সার্ভিসের জন্য কলকাতা যাওয়ার পথে নোয়াখালীর উপর কয়েকটা পাখির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়তাই ওখানকার লোকজনদের নিয়েও আমরা ব্যস্ত ছিলামl’

একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডগোল অন্যদিকে নোয়াখালীতে দুর্ঘটনা। তবে ওই সময় কখনো ভাবতে পারেনি যে এমন ধরণের কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছেl এখানেই কি তার ব্যর্থতার পরিচয় পাওয়া যায় না? যাকে এতো বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী প্রধান বানিয়েছিলেন তিনি তার দায়িত্বে কেন এত অবহেলা দেখালেন?

কে এম সফিউল্লাহ বলেন, “১৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক ৫-৩০ মিনিটে আমার ডি এম আই সালাউদ্দিন এসে বলেন, ‘স্যার আপনি কি ট্যাংক আর্টিলারিকে শহরে মুভ করার নির্দেশ দিয়েছেন?’। আমি বললাম, ‘না’l তিনি বললেন, ‘কিন্তু তারা ইতিমধ্যে রেডিও স্টেশন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয়েছে।’ আমি বললাম, ‘স্টপ ডেম। শাফায়েত জামিল কোথায়?’। এই বলে সাথে সাথে আমি ফোন করি শাফায়েত জামিলকেকারণ, তিনি ছিলেন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডারতাকে বললাম, ‘আপনি কি জানেন কী হচ্ছে?’।তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার স্যার?’। বললাম, ‘আর্টিলারি না কি মুভ করেছে?’। তিনি বললেন, ‘আমি জানি না স্যার’। আমি বললাম, ‘আপনি যখন জানেন না তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে বন্ধ করুন। ফার্স্ট সেকেন্ড ফোর্থ বেঙ্গলকে যাওয়ার জন্য বলুন’l

সফিউল্লাহ বলেন, ‘তারপর আমি বঙ্গবন্ধুকে ফোন করিl উনার ফোন এনগেজ পাইl এইসময় আমি নেভেল চিফ খান এয়ার চিফ খন্দকার সাহেবের সঙ্গে কথা বলি। ওনারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানালেন। তারপর জিয়াকে ফোন করি। তিনি আমার কথা শুনে বললেন, ‘তাই না কি?’। আমি ওনাকে (জিয়া) আমার এখানে আসতে বললাম। এরপর আমি খালেদ মোশারফকে ফোন করতে তিনি বললেন, তিনিও কিছু জানেন না। পরে আমি শাফায়েত জামিলকে ফোন করলাম। কিন্তু কোনো জবাব পাইনি। এমন করতে করতে বেশ কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল।’

“এরমধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে লাইন পাই।তিনি আমাকে বললেন, ‘সফিউল্লাহ, আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে মনে হয় মেরেই ফেলেছে। তুমি ফোর্স পাঠাও’। আমি ওনাকে তখন শুধু এতটুকুই বলতে পেরেছি, ‘স্যার কেন ইউ গেট আউট? আই এম ডুইং সামথিং (আপনি কি বাড়ি থেকে বের হতে পারবেন? আমি কিছু করছি’। ব্যাস, তখনি শুনতে পেলাম টেলিফোনে গুলির আওয়াজ। আর এটাই ছিল ওনার সাথে আমার শেষ কথা।’

পরবর্তী ঘটনা কী জানতে চাইলে জেনারেল সফিউল্লাহ বলেন, “২০-২৫মিনিট পর জিয়া সম্পূর্ণ সামরিক পোশাকে অফিসিয়াল কারে আমার বাসায় আসেন যা না কি ড্রাইভ করছিল তার অফিসিয়াল ড্রাইভার। অন্যদিকে খালেদ মোশারফ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় তার প্রাইভেট করে পায়জামা সেন্ডেল পরে আমার এখানে আসেন। এইসময় আমার পরনেও ছিল পায়জামা। এখানে দেরি না করে অফিসে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার অফিস ট্যাংক দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই সময় আমি চেষ্টা করছিলাম শাফায়েত জামিল বাহিনীর কি হলো তা বের করার জন্য। জিয়া তখন আমাকে বললেন, এ ব্যাপারে আমি যেন খালেদ মোশারফকে না পাঠাই। তবুও আমি খালেদকে পাঠাই। খালেদ ওখানে গিয়ে বলেন, ‘স্যার ওরা তো আমাকে আসতে দিচ্ছে না।’ আমি বললাম, ‘তারা কারা?’। খালেদ বললেন, ‘এখানে আমাকে কিছু বলতে দিচ্ছে না, আসতেও দিচ্ছে না।’ আমি বললাম, ‘আই ডোন্ট কেয়ার। ইউ কম এলোন’। এরপর খালেদ বললেন, ‘ওকে, দে আর এলাউয়িং মি ফর ফিফটিন মিনিটস’।”

‘কিছু সময়ের মধ্যে খালেদ মোশারফ এলেন এবং বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু ইজ ডেড অ্যান্ড ফুল আর্মি হ্যাজ রিভলটেড অ্যান্ড এন্টায়ার আর্মি হ্যাজ সেলিব্রেটেড (বঙ্গবন্ধু এখন মৃত এবং গোটা সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করেছে, তারা সবাই উৎফুল্ল’। আমি বললাম, ‘আই ডোন্ট টেক ইট।’

এখানে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি (সফিউল্লাহ) বলেন, ‘জিয়াকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি সবকিছুতেই রেডি ছিলেন। তাই হয়তো তিনি ১৫ আগস্ট এত সকালে সম্পূর্ণ সামরিক পোশাকে ফিটফাট এমনকি ক্লিন সেভ অবস্থায় প্রস্তুত ছিলেন। তাই আমার মনে প্রশ্ন জাগলো তাহলে কি তিনি কারো আদেশের অপেক্ষা করছিলেন?’।

তারমানে কি আপনি বলতে চান যে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের খবর জিয়াউর রহমান আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন?

উত্তরে জেনারেল সফিউল্লাহ বলেন, ‘শুধু অনুমানই নয়, তিনি সব কিছুই জানতেন বলে আমি মনে করি।’

সমালোচকেরা বলেন সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে এখানে জেনারেল সফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যে আস্থার উপর নির্ভর করে তাকে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয়েছিল সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রমাণ করে তিনি এখানে কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছেন। এখানে খালেদ মোশারফ কিংবা সমতুল্য অন্য কাউকে (জিয়া নয় ) সেনা প্রধানের দায়িত্ব দিলে হয়তোবা এমন ঘটনা না ঘটতেও পারত।

অন্যদিকে একথা সত্য যে, কে এম সফিউল্লাহ আসলেই বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত অনুগত ও নেতৃত্বে বিশ্বাসী একজন ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব তাকে অবহেলা করলেও তিনি ডক্টর কামাল, কাদের সিদ্দিকীর মতো দলে ছেড়ে চলে যাননি। এখনও এই বয়সে সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই কাজ করে যাচ্ছেন।

লেখক: কাউন্টি কাউন্সিলার স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিল, সুইডিশ লেফট পার্টি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :