ময়মনসিংহের একজন টুক্কু দা

মনোনেশ দাস, ময়মনসিংহ
 | প্রকাশিত : ১৬ আগস্ট ২০১৭, ০৮:৩৭

জন্ম তার ১৩৫০ সালে। নাম নিরঞ্জন ভৌমিক। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় সবাই ডাকেন টুক্কু দা নামে। শরতের আকাশে যখন সাদা মেঘ আর মুহুর্মুহু হাওয়া তখন টুক্কু দাকে দেখা যায় আটানি জমিদার বাড়ির নির্জন রাস্তা দিয়ে একলা হাঁটছেন। তাঁর কাশবনের মতো সাদা চুলে হাওয়া খেলে। তাঁর ভেতরে খেলে অন্যকিছু। আশপাশের মানুষজন তাঁর এই উদ্দেশ্যহীন হাঁটা দীর্ঘদিন ধরেই দেখে। দেখতে দেখতে তাদের চোখ সওয়া হয়ে যায়। আবার বর্ষাকালে আকাশ যখন কৃষ্ণবর্ণ আর টানা বর্ষণ তখন তাকে দেখা যায় কীর্ত্তনের মাঠের মন্দিরের সিঁড়িতে একলা বসে থাকতে।

তখন তাঁর হাতে তার প্রিয় বেহালাটা দেখা যায়। বেহালাটা তাঁর বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। বাবার কাছেই বেহালার হাতেখড়ি।

বাবা নৃপেন্দ্র ভৌমিক ছিলেন জমিদার বাড়ির সংগীত শিক্ষক। জমিদার তয়নাদের পদাবলী কীর্ত্তন শিখাতেন আবার উৎসব, পার্বনে বেহালায় সুর তুলতেন। জমিদার বাড়িতে ছিল ভূপেন্দ্র রঙ্গপীঠ। ঘূর্ণায়মান নাট্যমঞ্চ। সেই নাট্যমঞ্চে জমিদারদের সাথে নাটকের পাঠ গাইতেন টুক্কুদার বাবা আবার নাটকে সংগীত পরিচালনাও করতেন। বাবার হাত ধরে শৈশবে জমিদার বাড়িতে যাওয়ার স্মৃতি কুয়াশার মতো ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে তার। মনে পড়ে মন্ডা খাওয়ার আনন্দের স্মৃতি। বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার স্পর্শ মাখা, ইতিহাস হয়ে থাকা বেহালাটা হাতে তুলে নেন টুক্কু দা। সময়টা ১৯৭০। মুক্তিযুদ্ধে সবকিছুর সাথে অনেক বাদ্যযন্ত্রও লুটপাট হয়ে যায় কিন্তু বেহালাটা হাতছাড়া করেননি তিনি।

৩৫ বছর শহীদ স্মৃতি কলেজের লাইব্রেরিয়ান পদে থেকে ২০০৬ সালে অবসর নেন টুক্কু দা। তিনি খেলা পাগল মানুষ। যতটা না মাঠে খেলতে তার থেকে বেশি পছন্দ করতেন মাঠের বাইরে থেকে মাইকে ধারাভাষ্য দিতে। বাংলা ও ইংরেজিতে খেলার ধারাভাষ্য দিতেন অনর্গল। রেডিওতে খেলা শুনতে শুনতে ধারাভাষ্যের শখটা জেগে ওঠে সেই স্কুল লাইফ থেকে।

দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে ঢাকায় চাকরি করেন। বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন ছেলে, কিন্তু টুক্কু দা রাজি হন না। এই মুক্তাগাছার জল, বাতাস, দুর্বাঘাস, জমিদার বাড়ির রাস্তা, কীর্ত্তনের মাঠ, কালিবাড়ি পুকুর ঘাট ছেড়ে তিনি কোথাও গিয়ে শান্তি পাবেন না। প্রাচীন এই শহরের সাথে সাথে তিনিও প্রাচীন হতে থাকেন। কলেজের পাশ ঘেষে প্রাচীন জমিদার বাড়ি। কলেজ তাঁর কর্মস্থল, জমিদার বাড়ি তাঁর বাবার কর্মস্থল। আলোর অহমিকা এই রাস্তাটিকে গ্রাস করতে পারেনি এখনো। এখনো আঁধার তার রহস্যের ঝাঁপি খুলে দিতে পারে এখানে। ভগ্ন জমিদার বাড়ি হাজারো স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌনব্রতে। টুক্কু দা সেইসব রাস্তা দিয়ে একলা হাঁটেন। মাঝেমাঝে ভগ্ন প্রাচীরে হাত বুলান। হয়তো তাঁর বাবার বেহালার সুর ধরার চেষ্টা করেন। যে সুরে তাঁর বাবা মুগ্ধ করেছিলেন জমিদার জগৎকিশোর আচার্য্য চৌধুরীকে। টুক্কু দার মনে হয় ভগ্ন জমিদার বাড়ির দেয়ালে, শ্যাওলায় সেই সুর হয়তো লেগে আছে।

টুক্কু দা মনেপ্রাণে একজন ভালো বেহালাবাদক হতে চেয়েছেন। তাঁর একমাত্র স্বপ্ন ছিল টিভিতে বেহালা বাজানো। সেই স্বপ্ন তার পূরণ হয়েছে।

নিজের হাতে লাগানো একটি গাছ অনেক বড় হয়েছে কলেজ প্রাঙ্গণে। কখনো কখনো হাঁটতে হাঁটতে কলেজে আসেন। বিকালটা বসে থাকেন মাঠে। বিকালের বাতাস তার সাদা চুলে লাগে। জমিদার বাড়ির প্রাচীন রাস্তায় আবারো তিনি একা হয়ে যান হাঁটতে হাঁটতে। রাগ বাগেশ্রী ও মালকোষ তাঁর বুকের ভেতর বাজতে থাকে নিরন্তর। আশপাশের মানুষজনের মনে হয়, তিনি উদ্দেশ্যহীন হাঁটেন এবং দেখতে দেখতে তা তাদের চোখ সওয়া হয়ে যায়। মনে হয়, এরকম উদ্দেশ্যহীন হাঁটার মানুষ আশপাশ থেকে কমে যাচ্ছে ক্রমেই।

(ঢাকাটাইমস/১৬আগস্ট/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :