তাঁর শার্দূল মুখে ছিল আগামীর বাংলাদেশ

শাহান সাহাবুদ্দিন
 | প্রকাশিত : ১৬ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৫২

তিনি যখন বিকেলের ছায়া মাড়িয়ে দাঁড়ালেন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে, মনে হলো তাঁর শাহাদৎ আঙ্গুলের ঠিক মাথায় শোভা পাচ্ছে লাল সবুজের উজ্জ্বল পতাকা। মনে হলো তাঁর বুকের জমিন ধারণ করে আছে ৫৬ হাজার বর্গ মাইল। তাঁর দু’চোখে তখন আবহমান বাংলার শাশ্বত নিস্বর্গ-অপরুপ দৃশ্যপট। তাঁর শার্দূল মুখচ্ছবিতে স্পষ্ট দেখা গেলো তাঁর স্বপ্ন ও আকাঙক্ষার সমান বড় আগামী দিন- আগামী বাংলাদেশের ছবি। তখনো তিনি অবিচল কিংবদন্তি, একজন জ্যোতির্ময় মানুষ, উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং অসম সাহসী বাঙালির একমাত্র মহত্তম ইতিহাস। হিন্দু-মুসলিম, জাতি-উপজাতি বলে যে বিভেদের পাহাড়, তা তিনি নিমিষেই ভেঙে দিলেন মানবতাবাদের অপার আকাশ মাথায় নিয়ে। তাঁর কণ্ঠস্বর তখন তাঁকে ছাপিয়ে হয়ে উঠলো মুণি ঋষিদের কোমল কণ্ঠস্বর। বিভেদের পাহাড়ে জন্ম নিলো স্রোতস্বিনী নদী, সে নদীতে স্নান সেরে বাঙালি যথার্থই বাঙালি হলো।

১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ কতোদূর, সে নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করবে ইতহাসবেত্তাগণ। আমি শুধু বলে যেতে চাই আজকের বাংলাদশের, আজকের পৃথিবীর অগ্নিপুত্রদের কাছে একজন প্রত্যয়দীপ্ত দৃঢ়চেতা পুরুষের কথা, যাঁর আপাদমস্তকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে দিগ্বিজয়ী সম্রাটের উজ্জ্বলতা। যাঁর ধ্বমণীর রক্তস্রোতে সদা ধাবমান পদ্মা মেঘনা যমুনা। যাঁর উদাত্ত কণ্ঠস্বরে কেঁপে ওঠে আকাশ-বাতাস দশ দিক। যিনি হয়ে উঠেছিলেন সাত কোটি বাঙালির একজন। ৬৬, ৬৯, ৭০ ও ১৯৭১ এর মতো সংবেদনশীল ও আগুন ঝরা সময়ে হয়ে উঠেছিলেন অনন্য একজন, সেই ইতিহাস মহানায়কের কথা!

প্রিয় প্রমিথিউস কি ঘুমাননি কৈশোরোত্তর কালে? দু’দণ্ড শান্তি নিয়ে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত পাননি কি তিনি কখনো? নাকি ধর্মপাল, মহিপাল, তিতুমীর, হাজী শরীয়ত, শমসের গাজী, ঈসা খাঁ ও সূর্যসেনের রক্ত শরীরে ধারণ করে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন আশ্চর্য সংগ্রামী ইতিহাস, রাজপথকে বেছে নিয়েছিলেন সাবলীল বেঁচে থাকার পথ হিসেবে?

ইতিহাসের দীর্ঘ পথ ধরে হেঁটে যখন তিনি জাতির দাসত্বের কাল শেষ করেছেন ইস্পাত দৃঢ় মনোবল হিমালয়ের মতো অটুট ব্যক্তিত্ব আর দুপুরের জ্বলজ্বলে সূর্য্যর মতো প্রজ্ঞাকে পুঁজি করে। যখন লিংকন গ্রেট ম্যান্ডেলা হুচি মিনদের পথ ধরে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিলেন মহত্বম বিপ্লবের অবিনাশি গান। যখন তাঁর শাহাদৎ অঙ্গুলির ইঙ্গিত ও বজ্র নিনাদ কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়লো হিমালয় থেকে সুন্দর বন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়। যখন শালপ্রাংশু দেহের নির্ভিক দীর্ঘতর ছায়া ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের বাংলাকে পতাকার ন্যায় পরম স্নেহে ও ভালোবাসায় আগলে রাখলেন তিনি। যখন মহাকবির মতো বাতাসে স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে উচ্চারণ করলেন ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক...প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো...মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্...।’ তখন পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-সুরমা-কুশিয়ারা-কর্ণফুলি-আড়িয়াল খাঁর জল উঠলো ফুঁসে। আল্পসও কেঁপে উঠলো খানিকটা। শেখ মুজিব অগ্নি-বলয়ের ভেতর তখনো। তখনো তিনি ভিসুবিয়াসের একেবারে কাছাকাছি জায়গায় দাঁড়িয়ে। সেখানে দাঁড়িয়েই তর্জনির ইঙ্গিতে বাতলে দিলেন তিনি আমাদের পথ। মহাকবির মতো তিনি শুনালেন বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ কবিতা- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অন্যবদ্য কবিতার ক্লাইমেক্সে এসে তিনি বলছেন,‘এই দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’

আমরা দেখলাম ৬৬, ৬৯, ১৯৭০ এর বহুমাত্রিক নেতা, যিনি দাসত্বের কাল শেষ করে আগামী সকাল ছিনিয়ে আনার লক্ষ্যে তাঁর দল আওয়ামী লীগসহ তিন জন ভারতবর্ষের ইতিহাস খ্যাত নায়কদের ছায়া নিজের মধ্যে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন হিমালয়ের উচ্চতা ও দৃঢ়তা নিয়ে। কখনো সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো জ্বলে উঠছেন আপন মহিমায় স্ফূলিঙ্গের মতো। কখনো বা চিত্তরঞ্জন দাশের মতো এক আকাশ উদার মানসিকতা লালন করছেন। যা কিনা বাঙালিয়ানার পরিচয়কে বিশেষত্ব দিয়ে থাকে। কখনো বা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু হয়ে ওঠেন তাঁর চিন্তা ও আদর্শ সঙ্গী। সমাজতন্ত্র ঘেষা উদারনৈতিক ধ্যান ধারণাকে বেছে নেন যৌক্তিক পথ ও তত্ত্ব হিসেবে। আব্রাহাম লিঙ্কন মার্কিনিদের যে আবেগ অনুভূতি ও দেশপ্রেমে একটি নতুন জাতির কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন ‘অ্য নিউ বার্থ অব ফ্রিডম’-এর কথা। স্যার উইনস্টন চার্চিল হিটলারের ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে ‘শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারচে বেশি সুদূর প্রসারি ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য নিয়ে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন সাত কোটি বাঙালিকে, জাগিয়ে তুলেছিলেন আগ্নেয় ভূমিপুত্রদের। ইস্রাফিলের শিঙ্গার ফুঁক শুনে যেনো জেগে উঠলাম আমরা।

তাঁর অসামান্য ভূমিকা ও নেতৃত্বে আমরা পেলাম একটি পতাকা। লাল সবুজে উজ্জ্বল উদ্ধার। আমরা পেলাম আমাদের ঠিকানা দেশ- মানচিত্র।

বাঙালির চোখে তখন অপার স্বপ্ন। বাঙালি তখন তাঁর উদ্দেশে নিবেদন করছে যথার্থই তাঁর যতোটুকু পাওনা-‘ইস্পাত গড়া শানিত সূর্যের মতো/ অভিশপ্ত বাংলার যন্ত্রণার অন্ধকার ফুঁড়ে/ তুমি বেরিয়ে এলে মুজিবর/ তোমার জ্বলন্ত আবির্ভাবের আলোয়/ আমরা স্তম্ভিত।’

কিন্তু হায়, যুদ্ধত্তোরকালে এ কী করলেন প্রমিথিউস? কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে যখন বললেন-আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ-এসব পেশাজীবীকে সরকারি প্রশাসনে সম্পৃক্ত করুন। এরা ভুল করবে, এক সময় সঠিক শিক্ষাও গ্রহণ করবে। কিন্তু এরা ষড়যন্ত্র করবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব দিন।’ তিনি তাঁকে দৃঢ়তার সঙ্গেই জানিয়েছিলেন-‘পৃথিবীর কোথাও পরাজিত প্রশাসনের পদস্থদের নতুন প্রশাসনে দায়িত্ব দেয়া হয়না।’ এক্ষেত্রে তিনি তাঁকে উদাহরণ হিসেবে কিউবার মহান বিপ্লবের পর কমরেড চেগুয়েভারা যিনি কিউবার পরাজিত প্রশাসনকে সমূলে উৎপাটন করে কিউবা প্রশাসনকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তাও জানালেন। এমনকি চিনের মাও সে তুং, কম্পুচিয়ার বিপ্লবী সরকার ও এই কাজটিই করেছিলেন। সবশেষে তিনি তাঁর দরিয়ার সমান বড় ও সরল হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে কমরেড আলেন্দের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন-‘ইউ আর অলসো গোয়িং টু বি ফিনিসড কমরেড মুজিব!’

ইতিহাসের মহাপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে ক্যাস্ট্রোর কথাগুলো হয়তো ঐ ভাবে নাড়া দেয়নি, আর দিবেইবা কি করে? তিনি নিজেইতো বিদেশী সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন -‘আমার শক্তি ও দূর্বলতা হচ্ছে দেশের মানুষকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসা।’ এইক্ষণে আমার মনে পড়ছে কালোত্তীর্ণ কথাশিল্পী শওকত ওসমানের অনবদ্য এ পঙতিগুলো-‘ইতিহাস নয়/ অদৃশ্যের পরিহাস,/ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,/ তোমার ঘাতকেরা আজ নিজেদের সেবক রুপে জাহির করে।’...শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার‘ নাটকে সিজার-হত্যার পর মার্ক অ্যান্টনির উক্তিটিও মনে পড়ছে আমার-‘এই এক শোকাতুর রোম, বিপজ্জনক রোম।’ স্বাধীনতা উত্তরকালে জুলিয়াস সিজারের রোম আর গোটা বাংলা যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিলো। অদ্ভুত আঁধার এক ঢুকিয়ে দিয়েছিলো এদেশে পরাজিত শক্তি ও বিপথগামীরা।

প্রমিথিউসকে তাঁর এনে দেয়া স্বাধীন দেশেও ঘুমোতে দেয়া হলো না। তাঁর ডাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সাড়া দিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করলেও, অস্ত্র সমর্পণ করলেন না মাওবাদী, গণবাহিণীর সদস্যগণ ও রাজাকাররা। মাত্র ছয় মাসের মাথায় যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশকে তারা করে তুললো অস্থিতীশীল। চীন ও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদে নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের সমচিন্তার জারজ সন্তানেরা তাদেরই উদ্ভাবিত তত্ত্ব ও নির্দেশনা অনুসরন করে কখনো ‘শ্রেণী শত্রু’ কখনো ‘সর্বহারা’ ইত্যাদি অভিধায় দেশ জুড়ে শুরু করে গুপ্ত হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ। চরমপন্থিদের সঙ্গে যোগ দেয় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধ ফেরত একদল উগ্রপন্থি। এরা নানা গ্রপে বিভক্ত হয়ে দেশজুড়ে থানা, ফাঁড়ি লুট ইত্যাদির মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করে সারা বাঙলায় রক্তের নহরে লাশের স্তুপ ভাসিয়ে দিয়ে অট্রহাসি হাসছিলো। নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি ও গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে এরা হাসছিলো নেকড়ের হাসি। এর সঙ্গে যোগ হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয় দূর্ভিক্ষ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে হটকারী করে বাংলাদেশের জন্য পিএল-৪৮০ চুক্তির অধীনে খাদ্যবাহী জাহাজ তারা ফিরিয়ে নিয়েছিলো। দেশে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতার জন্য যতো রকম আয়োজন তার সবই করেছিলো এরা। পশু মোশতাক-ফারুক-রশিদ চক্রকে মদদ দিয়েছিলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। কৃত্রিম দূর্ভিক্ষ সৃষ্টির পাশাপাশি বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেনো নাজুক হয়ে পড়ে, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর দৃশ্যমান বিরোধ যেনো আরো প্রকট হয়ে উঠে তার জন্য ও গোপনে ইন্ধন যোগাচ্ছিলো সা¤্রাজ্যবাদী অশুভ শক্তি। উদ্দেশ্য শেখ মুজিবকে অজনপ্রিয় করে তোলা। উদ্দেশ্য পাকিস্তানি চেতনা পুনরায় প্রতিষ্ঠা।

তার সুষ্পষ্ট প্রমাণ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন তৎকালীন অতি ক্ষমতাধর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে ১২ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে পাঠানো ‘হোয়াট অ্যাওয়েটস দ্য সেক্রেটারি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গোপন প্রতিবেদন। যা পাঠিয়েছিলেন ওই সময়ের ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার। গোপন বার্তায় বোস্টার লিখেছেন- এটা প্রায় স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমান যদি তার কর্তৃত্ব বাড়াতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাহলে পরিণতিতে তিনি সম্ভবত তার নিজ দলের অনেকের সমর্থন হারাবেন এবং সম্ভবত আর ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিরোধীরা হাত মেলানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। বার্তায় এটাও বলা হয়, আগামী দেড় মাসে বাংলাদেশ সরকার চরম হুমকির মুখে পড়বেনা, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হবে। বিশেষ করে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়তে থাকায় আওয়ামী লীগের ভেতরের একটি অংশ নিজেদের শেখ মুজিবের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইবে। এ অবস্থায় বিরোধীরা সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়ার চেষ্টা করবে। ‘ক্যু’র গুজব নিশ্চিত ভাবেই আর ও বেশি করে শোনা যাবে।

হিতাকাঙক্ষীরূপি তোষামুদে সেবকদের কারণে ও বঙ্গবন্ধু ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি তাঁকে ঘিরে কিভাবে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছিলো। বাংলাকে বানানো হচ্ছিলো কাশিম বাজার কুঠি। তাঁর অনুরাগী অপগ্রহেরা কিভাবে একে একে রিহার্সেল সেরে নিচ্ছিলো ঘসেটি বেগমের অন্দর মহলের ষড়যন্ত্রের নাটকের, সকলেই পড়ে নিচ্ছিল মীর জাফর মোহাম্মদী বেগ ও রায়দূর্লভের পোশাক তিনি তখনো আঁচ করতে পারেননি। পারবেনই বা কেনো? ওই যে তিনি বলেছিলেন, তাঁর শক্তি ও দূর্বলতা হচ্ছে দেশের মানুষকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসা। তিনি পড়ে গেলেন ষড়যন্ত্রের ফাঁদে। ব্যর্থ হলেন মোহন লাল ও মীর জাফরের মধ্যকার পার্থক্যটা বুঝে উঠতে। অপগ্রহরা অষ্ট প্রহর বিষ ঢালতে থাকলো তাঁর কানে। অবশেষে বাংলার দ্বিতীয় মোহন লাল, যিনি দীর্ঘ নয় মাস বীরত্ব ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে সফলতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিলেন, সেই বঙ্গ তাজ তাজউদ্দিন আহমেদকে সুকৌশলে তাঁর পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রথম সফলতার পর্বটি শেষ করলো। বিশ্বাস ঘাতক মোশতাক, তাহের ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী গংদের জন্য উৎসবমূখর তারিখটি ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে থাকলো ২৭ অক্টোবর ১৯৭৪। এদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে অপগ্রহদের কুমন্ত্রণার ফাঁদে পড়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন, অব্যাহতি দিয়েছিলেন নিজের দ্বিতীয় বিশ্বস্ত ছায়াকে। বিনিময়ে কিনে এনেছিলেন বাংলার ইতিহাসের করুণতম অধ্যায়কে। ষড়যন্ত্র নাটকের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্বের সমাপ্তি ঘটলো ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫- এ। ওসমান (রা.), দ্বিতীয় নিকোলা, সিরাজউদ্দৌলা, লিঙ্কন, কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, বন্দর নায়েক, প্রেমাদাসা, আনোয়ার সাদাত, আলেন্দে ও পুয়েতারার মতো অসময়ে অশুভ শক্তির হাতে বাংলার আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতর নক্ষত্রের শোক স্তব্দ বিদায়ের পর। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলা ও ফ্রান্সের বীর কৃষককন্যা জোয়ান অব আর্ক আর বঙ্গবন্ধুর নিয়তি ও জীবন আখ্যান যেন একই ইপিসোড ও সুতোয় গেঁথে রেখেছিলেন মহান ইতিহাস নির্মাতা।

মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবুর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনা ও করা যায়না।’ বঙ্গবন্ধুর শারীরিক মৃত্যুর এতো বছর পর ইতিহাস কথা বলছে। কথা বলছে সময়। কথা বলছে মানুষের ইতিহাস বিবেক। একই সঙ্গে আহমদ ছফার বক্তব্যটি চূড়ান্ত প্রাসঙ্গিকতাকে সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। নিহতের মধ্য দিয়ে তিনি বরং পরাক্রমশালী হয়ে জীবিত বঙ্গবন্ধুকে চ্যালেঞ্জ করছেন।

শাহান সাহাবুদ্দিন: কবি, গল্পকার ও সাংবাদিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :