বঙ্গবন্ধুকে হত্যার গ্রিন সিগন্যাল দেন জিয়াউর রহমান

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১৬ আগস্ট ২০১৭, ২১:৫৬

চলছে শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তি পাকিস্তান ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী দোসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও মদদে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে এদেশের সেনাবাহিনীরই কিছু বখাটে কর্মকর্তা। এর আগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রেক্ষাপট তৈরি করে একদিকে কিছু সংবাদমাধ্যম আর অন্যদিকে জাসদের গণবাহিনী। সংবাদমাধ্যমের একাংশ লাগাতার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে দেশের মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভয়ংকর নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সংঘটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। খাদ্য সাহায্য দেয়ার কথা বলে শেষ মুহূর্তে বেঈমানি করেছিল এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের সব সাফল্যকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় এই দুর্ভিক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তানের সাথে সরাসরি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় দেশের কিছু সংবাদ মাধ্যম। তখন বাসন্তী নামের এক গ্রাম্য নারীকে মাছ ধরার জাল পড়িয়ে হলুদ সাংবাদিকতার ঘৃণ্য নজির সৃষ্টি করা হয়। পরিস্থিতি ঘোলাটে করে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিতে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালানো হয়।

তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ‘বাঙালির মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক মুজিব’ শীর্ষক এক লেখায় লিখেছেন, ‘ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানা রকমের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা থাকাটা স্বাভাবিক। আর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পোড়ামাটি নীতির কারণে সেটি বাংলাদেশে আরো বেশি হতে দেখা যায়। ফসলের জমিতে চাষ করার মতো কৃষক নেই। কৃষক আছে তো হালের বলদ বা বীজ নেই। গুদামে এক ছটাক চাল নেই। ব্যাংকে নেই এক ডলার পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ভারত থেকে দেশে ফিরে আসছে এক কোটি ছিন্নমূল শরণার্থী। অভ্যন্তরে আছে সমপরিমাণ ভিটাচ্যুত মানুষ। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক হয়ে একদল রোমান্টিক বিপ্লবী গঠন করল হঠকারী রাজনৈতিক দল জাসদ। সেখানে ঠাঁই হলো কিছু স্বাধীনতাবিরোধীর। কিছু গেল মওলানা ভাসানীর ন্যাপে। শুরু হলো দেশের ভেতর অন্তর্ঘাতমূলক তত্পরতা। আজ এই পাটের গুদামে আগুন লাগে তো কাল ভয়ানক বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘোড়াশাল সার কারখানা। পর পর কয়েকবার বন্যার কারণে একাধিক মৌসুমে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়। তখন অন্য দেশগুলোয়ও চলছিল খাদ্য ঘাটতি। যুক্তরাষ্ট্র পিএল-৪৮০ কর্মসূচির আওতায় কিছু খাদ্য সাহায্য বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু কিউবার কাছে বাংলাদেশ পাট বিক্রি করেছে—সেই ঠুনকো অজুহাতে তা তারা মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নেয়। খাদ্যকে তারা একটি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করে। একমাত্র অস্ট্রেলিয়া কয়েক জাহাজ খাদ্য সাহায্য পাঠাতে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু দেশে যোগাযোগব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণে তা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সময়মতো পাঠানো সহজ ছিল না। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ একজন অপ্রকৃতিস্থ নারী বাসন্তীকে মাছ ধরার জাল পরিয়ে তা দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপিয়ে চারদিকে হইচই ফেলে দেন। পরে আফতাব আহমেদ স্বীকার করেন ছবিটি সাজানো ছিল। খালেদা জিয়া ২০০৬ সালে আফতাব আহমেদকে একুশে পদকে ভূষিত করেন।

পুরো পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে দেয় মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। আরবরা তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অজুহাতে তার মূল্য ব্যারেলপ্রতি পাঁচ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৬০ ডলার পর্যন্ত করে দেয়। এতে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাড়তে থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। চালের দাম ৪০ টাকা মণ থেকে ৭০-৮০ টাকায় বৃদ্ধি পেলে দেয়ালে স্লোগান লেখা হয় ‘আশি টাকা চালের দাম, হরে কৃষ্ণ হরে রাম।’ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি দিতে শুরু করে। চীনপন্থী আবদুল মতিন (ভাষাসৈনিক), আলাউদ্দিন, মোহাম্মদ তোহা, আবদুল হক আর সিরাজ সিকদাররা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে পাকিস্তানের ভুট্টো সরকার আর তাদের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আর আওয়ামী লীগের ভেতর কিছু টাউট-বাটপার জুটে যায় জনগণের দৈনন্দিন সমস্যাকে পুঁজি করে আখের গোছাতে’।

এই ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগ নেয় সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী জুনিয়র কর্মকর্তা। এদের পেছনে ছিল পাকিস্তান-ফেরত কিছু সামরিক কর্মকর্তা। তৎকালীন আর্মির সেকেন্ড ইন কমান্ড, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বলেছিলেন, ‘ গো এহেড’। এ বিষয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস। সেখানে কর্নেল ফারুক রহমান এবং কর্নেল আব্দুর রশিদ সাংবাদিক এন্থনিকে দেয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলেন, জিয়াউর রহমান তাদেরকে বঙ্গবন্ধু-হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে ‘এগিয়ে যাওয়ার’ পরামর্শ দিয়েছিলেন। কর্নেল রশিদকে মাসকারেনহাস জিজ্ঞেস করেন আপনারা কি কখনো জাতির পিতা মুজিবকে বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনার দরকার?

এর উত্তরে কর্নেল রশিদ, আমরা কখনো তাকে (শেখ মুজিব) বলতে পারিনি যে, তার শোধরানো উচিত, কারণ আমরা ছিলাম জুনিয়র অফিসার। কর্নেল রশিদকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনারা তাকে (বঙ্গবন্ধু) হত্যা না করে তাকে রিজাইন (পদত্যাগ) করতে বাধ্য করতে পারতেন। তাকে হত্যা করা কি জরুরী ছিল?

এর উত্তরে আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল রশিদ বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে চটিয়ে তুলতে তার (শেখ মুজিব) এর একটা বিশেষ দক্ষতা ছিল। আমরা যদি তাকে হত্যা না করতাম, তাহলে সে হয়ত নতুন করে এমন কিছু করতেন যাতে আবার ক্ষমতায় আসতেন। তাকে (শেখ মুজিব)কে বাঁচিয়ে রাখলে তিনি হয়ত আবার ফিরে আসতেন’। তাই তাকে হত্যা করেছি আমরা’।

মাসকারেনহাস তার ডকুমেন্টারিতে বলেন, মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনায় উপরের সহযোগিতা পেতে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার আশ্রয় দরকার ছিল। তাই হত্যাকারী জুনিয়র কর্মকর্তারা তৎকালীন আর্মির বড় অফিসার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বেছে নেয়। এ বিষয়ে অন্যতম খুনি কর্নেল ফারুক মাসকারেনহাসকে ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ আমাদের এক নম্বর চয়েস ছিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। অনেক চেষ্টা করে আমি ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করতে সক্ষম হই। জেনারেল জিয়া আমাকে বলেন, আমি সিনিয়র অফিসার, আমি এধরনের কাজে সরাসরি ইনভল্ভ হতে পারিনা। যদি তোমরা জুনিয়র অফিসাররা এটা করতে চাও, তাহলে গো এহেড’। এই কথা বলে জেনারেল জিয়া লনে হাঁটা শুরু করলেন। আমি জেনারেল জিয়া বললাম, ‘স্যার পুরো কাজে আপনার সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দরকার’।যে জিয়া জাতির পিতাকে হত্যার গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিলেন, তিনিও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের গুলিতে চট্টগ্রামে ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

লেখকঃ শিক্ষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :