কুবিতে শিক্ষক-ছাত্রলীগ দ্বন্দ্বে ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

মাহফুজ কিশোর, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৮ আগস্ট ২০১৭, ২১:১৪

জাতীয় শোক দিবসে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ক্লাস নেয়ার অভিযোগ এনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের টানা দুই দিনের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে সর্বমোট ২০টি পূর্বনির্ধারিত চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এতে করে সেশনজটের আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের ভাষ্য, বন্ধের দিনে ক্লাস নেয়া যদি অন্যায় হয় তবে কার্যদিবসে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখার যৌক্তিকতা কোথায়? তবে শাখা ছাত্রলীগ আন্দোলন প্রত্যাহার করায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন তারা।

এদিকে শোক দিবসে ক্লাস নেয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেয়া এক মাসের বাধ্যতামূলক ছুটির প্রতিবাদে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া (তারেক) বলেন, ‘আমি অথবা আমার কোনো শিক্ষার্থীর সাথে কোন ধরনের আলোচনা বা যোগাযোগ না করে আমার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং ষড়যন্ত্রমূলক। আমি যদি অন্যায় করেও থাকি (যদিও আদতে আমরা কোন অন্যায় ছিল না) তাহলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আগে একবার অন্তত আমার সাথে প্রশাসনের কথা বলা দরকার ছিল। আমি ক্লাস নিয়েছি কী না সে বিষয়ে আমার শিক্ষার্থীদের সাথেও কথা বলা যেতো। আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তো দিতে পারতো! এটা না করে আমার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি অন্যায্য ও ষড়যন্ত্রমূলক।’

বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য জানান, ক্লাস নেয়ার বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হওয়ায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই শিক্ষককে ছুটি দেয়া হয়েছে। তার ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে পুরো বিষয়ে তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি ক্লাস নিয়েছেন কী না, কোনো অন্যায় করেছেন কী না তা তদন্ত সাপেক্ষেই প্রমাণিত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, এটা পূর্বনির্ধারিত কোনো ক্লাস ছিল না। আমাদের কিছু বিষয়ে জটিলতা ছিল বলেই আমরা স্যারের কাছে বুঝতে গিয়েছিলাম। তবে শিক্ষার্থীদের এই বক্তব্যকে ‘শিখানো বুলি’ বলে অভিযোগ করছে শাখা ছাত্রলীগ।

জানা যায়, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভা চলমান অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া (তারেক) শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন- এই অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে এবং প্রশাসনিক ভবনসহ সবকটি অনুষদ ভবনে তালা দেয়। এছাড়াও অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেয় শাখা ছাত্রলীগ। একই দাবিতে পরদিন থেকে টানা দুই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেয় তারা।

ঘটনার সূত্রপাত হয় জাতীয় শোক দিবসে ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়। এরপর সঞ্চালক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর শুভ ব্রত সাহার ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান বিভক্ত বঙ্গবন্ধু পরিষদের একাংশ (দুলাল-কামাল প্যানেল) পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। এসময় বঙ্গবন্ধু পরিষদের অপরাংশ (আইনুল-জিয়া প্যানেল) তাদেরকে ফুল দিতে না দেয়ায় ক্ষোভ জানায় এবং এর প্রতিবাদে পরবর্তী আলোচনা সভা বয়কট করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. আবু তাহের। আলোচনা সভা চলাকালে বিশ^বিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ১০৬নং রুমে ক্লাস হচ্ছে-এমন অভিযোগ পেয়ে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে যায় এবং ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া ও শিক্ষার্থীদেরকে ভিডিও চিত্রে ধারণ করে। ভিডিও চিত্রে সেই শ্রেণিকক্ষে ২০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল বলে সত্যতা পাওয়া যায়। এসময় শাখা ছাত্রলীগ নেতারা উপস্থিত শিক্ষকের কাছে এ বিষয়ের জবাবদিহিতা চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ক্লাস নিচ্ছি না। তাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। নির্ধারিত ক্লাস তাদের আগেই শেষ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কিছু বিষয় আমার কাছে বুঝতে এসেছিল এবং তারা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় আমি তাদেরকে নিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য ক্লাসরুমে বসেছি।’

এসময় শাখা ছাত্রলীগ নেতারা সেখান থেকে চলে আসেন এবং ক্যাম্পাসে ‘শোকের দিনে ক্লাস কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগানে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপর তারা প্রশাসন বরাবর সংশ্লিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষকের বহিষ্কার দাবি করে আন্দোলন চলমান রাখার ঘোষণা দেন।

শাখা ছাত্রলীগের দাবি, অভিযুক্ত শিক্ষক ১৫ আগস্ট শোক দিবসে কোনো ধরনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাস নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তারা শোক দিবসের বিভিন্ন ছবি আপলোড দিয়ে প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করছেন যে, কোনো ছবিতেই অভিযুক্ত শিক্ষকের উপস্থিতি নেই।

এ বিষয়ে শিক্ষক তারেক জানান, ছবির ফ্রেমে সবাইকে আসতে হবে এটা কেমন কথা। শিক্ষক সমিতি যখন ফুল দেয় তখন আমি পাশেই ছিলাম। ছবিতে আসিনি বলে আমি ওখানে ছিলাম না এটা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই না।

এ ঘটনাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ ও অতি উৎসাহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায় বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ (আইনুল-জিয়া প্যানেল)।

শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষক জাতীয় শোক দিবসে ক্লাস নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন সেই অপরাধে আমরা আরও বেশি শাস্তির দাবি করেছিলাম। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষার কথা বিবেচনা করে আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছি।

এছাড়াও তিনি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু পরিষদ (আইনুল-জিয়া প্যানেল) এর ২৩ জনের মধ্যে ডিজিএফআই ও এনএসআই দিয়ে তদন্ত করে দেখলে ৫০% এর বেশি জামায়াত-শিবির এর লোক বের হবে। যদি তা না হয় তাহলে আমি স্বেচ্ছায় কুবি শাখা ছাত্রলীগ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করবো।

শিক্ষক মাহবুবুল হকের বিরুদ্ধে এক মাসের ছুটির নিন্দা জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবিতে বুধবার বিকাল থেকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয় শিক্ষক সমিতি। অফিস সময় শেষে উপাচার্য তার বাংলোতে যেতে চাইলে তার গাড়ির সামনে অবস্থান নেয় তারা। ‘কোন যৌক্তিকতায় শিক্ষক তারেককে ছুটি দেওয়া হলো? জানতে চেয়ে উপাচার্যকে রাত নয়টা নাগাদ অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু পরিষদ (আইনুল-জিয়া প্যানেল)। এসময় উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরিয়াল বডির সাথে তুমুল বাকবিতণ্ডা হয় তাদের। এরপর প্রক্টরিয়াল বডি এবং কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার ওসি নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ পাহারায় পায়ে হেঁটে নিজ বাংলোতে যান উপাচার্য।

এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে আগামী রবিবার সাধারণ সভার আহ্বান করেছে শিক্ষক সমিতি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান জানান, একটি শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা চলমান থাকা অবস্থায় কোনোভাবেই ক্লাস নেয়ার প্রসঙ্গ আসতে পারে না। শিক্ষক মাহবুবুল হক কোনো ধরনের ক্লাস নেননি। হয়রানিমূলকভাবে বিশ্ববিদ্যলয় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছে আমরা তার নিন্দা জানাই। এর প্রতিবাদে গণতান্ত্রিকভাবে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণেই আগামী রবিবার শিক্ষক সমিতির সভা আহ্বান করা হয়েছে।

ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার মতো কোনো কর্মসূচি থাকবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করবো ক্লাস-পরীক্ষা চালু রেখেই আমাদের কর্মসূচি চালিয়ে নিতে।’

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অভিযুক্ত শিক্ষককে এক মাসের ছুটি দেয়া হয়েছে। এর মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধই থাকবে ১৫ দিন (ঈদুল আজহা)। এটা কোনো শাস্তি নয়। আর গুটিকয়েক শিক্ষক মিলে গতকাল আমাকে অন্যায়ভাবে অফিস সময়ের পর তিন ঘণ্টা আটকে রেখেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-মর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

(ঢাকাটাইমস/১৮আগস্ট/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :