সৌদিতে মিজানুরদের দুঃসহ জীবন

আমীর চারু, সৌদি আরব
 | প্রকাশিত : ১৯ আগস্ট ২০১৭, ০৯:৫৩
ফাইল ছবি

সৌদি আরবে নতুন আসা বাংলাদেশিরা ভালো নেই। কাজ নেই, অনেকের নেই আশ্রয়ের ঠিকানা। অনাহারে পথে পথে ঠোক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ। নানাবিধ সংকটে দিন কাটাচ্ছে নতুন আসা বাংলাদেশিরা।

সৌদিতে কয়েক বছর থেকে চলাছে অর্থনৈতিক মন্দা, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়া, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনে, সেই সঙ্গে জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলার ফলে সৌদি আরবে কর্মসংস্থান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে, আর্থিক সংকটের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বড় বড় কোম্পানি, তার সাথে সৌদিকরণ নীতি প্রবাসীদের সংকট আরো ঘনীভূত করে তুলেছে।

এমন ঘোর সংকটকালীন সময় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দ্বার খুলেছে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির। শর্তসাপেক্ষে ভিসা উন্মুক্ত হলেও পেশাভিত্তিক খুবই নিন্মমানের কাজের ভিসা যা পেশা পরিবর্তন অযোগ্য।

ভাষা না জানা, অদক্ষ শ্রমিকদের কষ্টের যেন শেষ নেই। ফ্রি ভিসার নামে নতুনদের সঙ্গে একধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে অনেক দালাল।

সাধারণত নিয়োগ দাতার সঙ্গে অলিখিত চুক্তির ভিত্তিতে বার্ষিক বা মাসে টাকার বিনিময়ে বাইরে কাজ করাই ফ্রি ভিসা নামে পরিচিত । এই ভিসায় আয় বেশি এমনই লোভনীয় অফারে- কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশের মাটিতে পা রেখেই চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নতুন প্রবাসীদের অনেকেই।

এমনই প্রতারণার শিকার এক প্রবাসীর নাম মিজানুর রহমান। ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার ডিগ্রিরচরের মিজান, দালালের খপ্পরে পড়ে সাড়ে ছয় লক্ষ টাকার বিনিময়ে আট মাস আগে সৌদি আরবে আসেন। জমি বিক্রি আর এনজিও থেকে কয়েক ঋণ করে সৌদিতে এসে এখন ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে মিজান, ডিগ্রি পাস করে একটি সিগারেট কোম্পানির মাঠ পর্যায়ে বিক্রয় কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেলেও কোটা পূরণ না করতে পারায় ঠিক মত বেতন পেতেন না। সিগারেট কোম্পানির কাজের সময় পরিচয় হয় আবদুল হালিম নামের সৌদি আরব থেকে দেশে যাওয়া এক জনের সঙ্গে। পত্র পত্রিকায় সৌদি আরবের অর্থনৈতিক মন্দার কথা জানলেও হালিম শোনান ভিন্ন গল্প। দালালের গল্প শুনেই সিদ্ধান্ত নেন সৌদি আসার। পরে দর কষাকষি করে সাড়ে ছয় লক্ষ টাকার বিনিময়ে সৌদি আসেন মিজান। নিজের কোন নিকট আত্মীয় না থাকায় হালিমের দেওয়া ঠিকানায় এসে উঠেন। তারপর থেকে কাজের খোঁজে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করলেও কাজের কোন সন্ধান না পেয়ে দুই মাস পর হতাশ হয়ে এক বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন মিজান।

প্রচণ্ড তাপদাহ, খোলা আকাশের নিচে ৫০ ডিগ্রি গা ঝলসানো তাপমাত্রায় এক মাস কাজ করেও বেতন না পেয়ে রাগে ক্ষোভে সে কাজটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। একদিকে রুম ভাড়া, খাবারের খরচ, মাস গেলে মালিকের চুক্তি অনুযায়ী অর্থ প্রদান, আর দেশ থেকে পরিবারের সদস্যদের মিনতি- যে ভাবেই হোক ঋণের টাকা শোধের তাগিদ, এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন মিজান। এলাকার এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় এক পাকিস্তানি মোবাল্লাত (টাইলস মিস্ত্রি) এর সাথে দৈনিক হিসেবে কাজ শুরু করলেও সপ্তাহে তিন চারদিন কাজ থাকে না, আবার কাজ থাকলেও ভাষা না বোঝার কারণে ভুল হয়, বেশি কথা শুনতে হয়।

পড়ালেখা জানা মিজান অনেকটাই অসহায়, শরীর মন না টানলেও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে বলে জানান এই প্রতিবেদককে।

সৌদি আরবের আভা থেকে সাংবাদিক ফারুক আহমেদ জানান, আরেক প্রবাসীর গল্প - প্রায় নয় লাখ টাকার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে সৌদি আরব প্রবাসী মোহাম্মদ মাসুদ। দেশের দালালদের খপ্পরে পড়ে চরম এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত আর চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সৌদি আরবে কাটছে তার প্রতিটি দিন।

জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার বাগলেরগড গ্রামের আইনাল হকের ছেলে মাসুদ। জামালপুরের সিরাজুল হক ডিগ্রি কলেজে এইচএসসি পড়াশুনা বাদ দিয়ে সৌদি আরব চলে আসেন প্রায় ১৪ মাস আগে। গ্রামের দালালদের দেখানো লোভ সামলাতে না পেরে ঢাকার বনানী চেয়ারম্যান বাড়ির কবির ব্রাদার্স ট্রাভেল এজেন্সিকে নয় লাখ টাকা পরিশোধ করে সৌদি আরবের রিয়াদে মাফাহিম কোম্পানিতে ক্লিনার হিসেবে চলে আসে। দৈনিক ১০ ঘন্টা কাজ। বেতন বকেয়া থাকে দুই/তিন মাস।

মাসুদ বলেন, ‘নয় লাখ টাকা ঋণ করে সৌদি এসে সুদের টাকা পরিশোধ করতে পারছি না। দুই লাখ টাকা অনেক কষ্ট করে দেশে পাঠিয়েছি। যা বেতন পাই তা দিয়ে সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে কোন মতে। আমার মতো ভুল যেন কেউ না করে। পারলে দেশে কিছু একটা করার চেষ্টা করতে বিদেশ গমন ইচ্ছুক বেকারদের অনুরোধ জানান মাসুদ।

নাম,ঠিকানা ও ছবি প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার এক তরুণ দুই মাস হলো শয্যাশায়ী। চার মাস আগে সৌদি আরব আসেন তিনি। প্রথম মাসে কোন কাজ না পেয়ে দ্বিতীয় মাসে এলাকার এক পেন্টার এর সঙ্গে রঙের কাজে যোগ দেন, ১৫ দিন কাজের পর কাজের সাইডের সিগালার (লোহার সিঁড়ি) উপর কাজ করতে গিয়ে, অসতর্ক অবস্থায় প্রায় ১০ মিটার উপর থেকে নিচে পড়ে পা ভেঙে যায়। আকামা (রেসিডেন্সিয়াল পারমিট) না থাকায় প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করতে পারেনি, একদিন পর এক সৌদি পুলিশের সহায়তায় বন্ডেজ করালেও এক্সরে ও অন্যান্য চেকআপে পোহাতে হয় ঝামেলা। এর ওর কাছ থেকে ধার দেনা করে চিকিৎসা চালালেও সুস্থ হয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না তিনি।

এমন শত শত ভাষা না জানা নতুন প্রবাসী সৌদি আরবের পথে পথে ঠোক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছে। নিজে ভালো থাকা আর পরিবার কে ভালো রাখার স্বপ্ন বুকে নিয়ে মরুভূমির দেশে এসে ভাল নেই মিজানরা।

ঢাকাটাইমস/১৯আগস্ট/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :