ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচারপতির শপথ ভঙ্গ?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৫১ | প্রকাশিত : ১৯ আগস্ট ২০১৭, ১৪:২৪
ফাইল ছবি

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ে বিচারপতির শপথ ভঙ্গের মত ঘটনা ঘটেছে কি না তা বিবেচনা করে দেখতে বলেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি জানান, সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে সংসদ বাধ্য নয়। আর সংসদকে নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতাও সুপ্রিম কোর্টের নেই।

শনিবার রাজধানীতে এক আলোচনায় খায়রুল হক এ কথা বলেন। তিনি কেন ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের সমালোচনা করেছেন, সে কারণও ব্যাখ্যা করেন তিনি। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে অযাচিত কথা বলা হয়েছে মন্তব্য করে সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন,‘ সাধারণত প্রত্যেকটা জিনিসের একটা গ্রামার থাকে। আমাদের রায় লেখার মধ্যেও একটা গ্রামার আছে। যা আমরা ফলো করি। সাধারণত যে ইস্যুগুলা থাকে ওই ইস্যুর বাইরে যাওয়ার স্কোপ (সুযোগ) থাকে না। গেলেও সেটার খুব কাছাকাছি থাকতে হয়। কাছাকাছি কিছু হয়ত বলা যায়। ইস্যুর বাইরে গিয়ে কিছু বলা উচিত নয়।’

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে এনে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনে সরকার। এটি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিতি পায়। পরের বছর হাইকোর্টে এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল গত ৩ জুলাই নাকচ করে দেয় আপিল বিভাগ। আর ১ আগস্ট প্রকাশ হয় পূর্ণাঙ্গ রায়। এই রায়ে ৯৬ অনুচ্ছেদের বাইরে গিয়ে সংসদ, শাসন ব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করা হয়, যা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সরকার। এই রায়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবমাননা করা হয়েছে অভিযোগ করে তিন দিনের কর্মসূচিও পালন করেছেন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা।

এই রায় রিভিউয়ের আবেদন করার কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এই আবেদনের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংসদকে অপরিপক্ক, সংসদকে অকার্যকর বলা হয়েছে। দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করে এসব শব্দ ব্যবহারের সমালোচনা করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক।

শনিবারের আলোচনায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এই শব্দগুলো উল্লেখ করে বলেন, “‘পার্লামেন্ট ইজ ইমম্যাচিওর’, ‘ডেমোক্রেসি ইজ ইমম্যাচিওর’, ‘পার্লামেন্ট আমাদের ডাইরেকশন শোনেনি’, এই কথাগুলো যদি অনুরাগ বিরাগের মধ্যে চলে আসে তাহলে সেই জজ সাহেবের পজিশনটাই বা কী হবে?”

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার প্রতি ইঙ্গিত করে খায়রুল হক বলেন, ‘তিনি ওথ বাউন্ড থাকছেন কি না, সেটাও আপনারা বিচার- বিবেচনা করে দেখুন। আমি পয়েন্ট আউট করে দিলাম। ওথ ভঙ্গ হলে কি হতে পারে? আপনারা জানেন কী হতে পারে।’

‘জজ সাহেবরা একটা ওয়থ (শপথ) নেন’ মন্তব্য করে খায়রুল হক বলেন, “শপথে বলা হয়, ‘অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে আমি কিছু করব না।’ কিন্তু রায়ের পর্যবেক্ষণে যা বলা হয়েছে তাতে অনুরাগ না হোক, বিরাগ তো বহন করছে। যদিও দেশের লোক মনে করে যে ওনার এই বক্তব্যগুলো বিরাগের বর্শবর্তী হয়ে বলে থাকেন তাহলে সে রায়ের কী অবস্থা হবে। তা আপনারাই বিবেচনা করবেন।”

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দ্বৈত শাসনই হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। কারণ বিচারপতিরা ফেরেস্তা না। তারাও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে।’

সংসদ নিয়ে মন্তব্যের সমালোচনা

রায়ে সংসদকে অপরিপক্ক বলার সমালোচনা করেন খায়রুল হক। তিনি বলেন, ‘ওনি (প্রধান বিচারপতি) বলেছেন, ১৫২ জন ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আসেনি। তাহলে ওনারা (বিচারপতিরা) ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন নাকি। এক জায়গায় ওনি বলেছেন, আমরা সংসদকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলাম সে নির্দেশনা সংসদ মানেনি। সংসদকে নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের নেই। সেই নির্দেশ যদি দিয়েও থাকে তাহলে তা মানতে সংসদ বাধ্য নয়। সংসদ হলো সার্বভৌম। সংসদ দেশের সমগ্র প্রতিষ্ঠানের মালিক ।’

‘তিনি (প্রধান বিচারপতি) সবচেয়ে আপত্তিকর কথা বলেছেন সংসদকে অকার্যকর বলে। সংসদকে অকার্যকর বলা একজন জজের ভাষা হতে পারে না। জুডিশিয়ারির ভাষা হতে পারে না। সুপ্রিমকোর্টের ভাষা হতে পারে না।

খায়রুল হক বলেন, প্রধান বিচারপতি সংসদকে বলেছেন ‘ইমম্যাচিউরড’। এটা শকিং (দুঃখজনক)। কোনটা ম্যাচিউরড সেটা ওনি (প্রধান বিচারপতি) বলার কে? কোনটা কী হবে, না হবে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক হলো সংসদ সদস্যরা। জুডিশিয়ারির নয়। এ বিষয়ে একজন বিচারপতি বলতে পারেন না।’

‘সংসদ সদস্যদের আগে বিবেচনা করা উচিত তারা সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য কি না’- রায়ের এমন মন্তব্যেরও সমালোচনা করেন খায়রুল হক। তিনি বলেন, ‘সাংসদ সদস্যরা আর কিছু না হোক তারা জনগণের প্রতিনিধি। সেটাই তাদের প্রথম যোগ্যতা। এটাই তাদের সব থেকে বড় পরিচয়, সম্মানের পরিচয়। তারাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেটা যিনিই হোন না কেন। সবাইকে যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী হতে হবে এমনতো কোন বাধ্যবাধকতা নেই। অবশ্য অনেকে সংসদ সদস্যই পিএইচডি ডিগ্রিধারী আছেন। ইংল্যান্ড আমেরিকাতেও সব সময় অত বড় শিক্ষিত পার্লামেন্টারিয়েন পাওয়া যায় না। যদিও এটা অবাক লাগতে পারে। কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট।’

‘একজন সংসদ সদস্যের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা কোন ক্রাইটেরিয়া হতে পারে না’ মন্তব্য করে খায়রুল হক বলেন, ‘জন মেকার্স গ্রেট বিটেনের প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন। ওনার তো এ লেভেল ও লেভেল পাস ছিল না। কিন্তু ওনিতো ছিলেন স্কিল (দক্ষ) লিডার।’

‘একজন সংসদ সদস্যের ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে আপনি দেশের মানুষকে ভালবাসেন কিনা বা জনগণ আপনাকে ভালবাসে কিনা সেটাই হলো ক্রাইটেরিয়া। আর অন্য কোন কিছু নয়।’

রায়ের সমালোচনার ব্যাখ্যা

ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে বক্তব্য দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে খায়রুল হক বলেন, ‘রায়ে ভুল কিছু থাকলে সেটা আইন কমিশনের কাজ। রায় নিয়ে কথা বলা আমাদের কর্তব্য। ’

‘তিনি (প্রধান বিচারপতি) তার রায়ের মধ্যে সংসদকে অকার্যকর বলেছেন এটাই সব্যনাসী ব্যাপার। সে কারণে এটাতো আমাদের মনিটরিং করতে হবে সেটা কারো পছন্দ হোক বা না হোক। ল কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব।’

খায়রুল হক বলেন, ‘আরেকটি কথা প্রায়ই উঠে আমি ল কমিশনের চাকুরি করি। এখানে বসে এত কথা বলা উচিত কিনা। তাদের হয়তো ল কমিশন সম্পর্কে কোন আইডিয়া না থাকারই কথা। ল কমিশন কিন্তু এমন একটা প্রতিষ্ঠান। যেখানে আইন নিয়েই আমাদের গবেষণা। আইনকে মনিটর করাও আমাদের আরেকটা কাজ। সরকার কোন আইন কখন করছে, কোন আইনে কী সমস্যা আছে সেটা পয়েন্ট আউট করা। সরকারকে জানানো, প্রয়োজনে মন্ত্রীকে সরাসরি জানানো এবং নতুন আইন তৈরি করা। বিদ্যমান আইন সময়োপযোগী করা। উচ্চ আদালতের একটি রায় কিন্তু আইন। সেটা দেশের জন্য আইন। প্রধান বিচারপতি রায়ের মধ্যে যে সব কথা বলেছেন সেটা যদি বাহিরে বলতেন তাহলে হয়তো এত কথা উঠতো না। কিন্তু রায়ের মধ্যে বলেছেন, তখন সেটা আইনের অংশ হয়ে গিয়েছে এ কারণেই এত আপত্তি।’

ঢাকাটাইমস/১৯আগস্ট/এমবি/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :