সবাই জাকসু চায় কিন্তু নির্বাচন হয় না

রাইয়ান বিন আমিন, জাবি প্রতিনিধি
| আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৩৩ | প্রকাশিত : ২০ আগস্ট ২০১৭, ০৮:০৯

নব্বইয়ের দশকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে খুশি রেখে চলছে প্রশাসন পরিচালনা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনগুলোসহ সবাই চায় জাকসু নির্বাচন হোক। কিন্তু ২৫ বছর ধরে নির্বাচন হচ্ছে না ছাত্রদের অধিকার আদায়ের এই মঞ্চের।

গত ২৭ মে সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ^বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্ভূত আন্দোলন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন ৫৬ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা করার পর নতুন করে আলোচনায় আসে জাকসু নির্বাচন।

বিগত ২৫ বছরে প্রায় সব উপাচার্য জাকসু নির্বাচন দেওয়ার স্বপ্ন দেখালেও কেউই তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি বা বাস্তবায়ন হতে দেননি। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম নির্বাচন হবে বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও এ বিষয়ে এখনো উদ্যোগ নেননি তিনিও। ফলে আদৌ জাকসু নির্বাচন হবে কি না তা নিয়েই দেখা দিয়েছে সংশয়।

জাকসু নির্বাচন না হওয়ার জন্য প্রশাসনের চেয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর অসহিষ্ণুতাকে দায়ী করেন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা তো নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। নির্বাচন হলে তা আমাদের জন্য ভালো। ছাত্রদের সাথে যেকোনো বিষয়ে আলোচনা করতে সুবিধা হয়, আমরা তাদের মতামত জানতে পারি। কিন্তু নির্বাচনের জন্য যে ধরনের সহনশীল পরিবেশ দরকার তা ছাত্রসংগঠনগুলো তৈরি করতে পারছে না।’

নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা তো প্রশাসনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে- এমন প্রশ্নে উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের একার পক্ষে তো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তার জন্য ছাত্রসংগঠগুলোরও সহযোগিতা করতে হবে।’

একটা সময় জাকসু ছিল রাজনীতির প্রাথমিক চর্চাকেন্দ্র। ছাত্রনেতৃত্ব তৈরির সেই রিহার্সেল হাউসের ঐতিহ্য আজ নেই বললেই চলে। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নির্বাচনে হারার আশঙ্কা ও বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর নিরপেক্ষতার অভিযোগ তুলে অংশগ্রহণে অনীহার কারণে কোনো প্রশাসনই জাকসু নির্বাচনে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। অন্যদিকে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা যেমন দায়ী করছেন শিক্ষকদের, তেমনি শিক্ষকরা মনে করেন এর পেছনে ছাত্রসংগঠনগুলোর আধিপত্য দায়ী।

জাকসু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের অনিচ্ছাকেও দায়ী করছেন অনেকে। তারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দল ও তার ছাত্রসংগঠনই বিশ^বিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। জাকসু নির্বাচন হলে সেখানে সব সংগঠনের নেতৃত্ব আসতে পারে। এতে ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা আছে তাদের।

আবার প্রশাসনেরও জাকসু নির্বাচন নিয়ে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখছেন তারা। নির্বাচিত কমিটির সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনকেও মেনে নেয়ার চাপ তৈরি হয়। তাই প্রশাসন চায় না ছাত্রপ্রতিনিধি তাদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করুক। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন নির্বাচনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেও ক্ষমতার পালাবদলের ফলে বিপক্ষ ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠবে। এসব কারণেও হয়তো রাষ্ট্র ও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন কেউই ঝুঁকির মধ্যে যেতে চায় না।

এই ঝুঁকির কথা বলে গত ২০১৩ সালের নভেম্বরে জাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ বাতিল করা হয়েছিল। সে সময়কার বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাকসু নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নেওয়া হলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায় জাকসু নির্বাচন স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। কারণ হিসেবে কমিশন বলেছিল, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে জাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা কিছুটা সমস্যা হতে পারে। এ জন্য দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।’ কিন্তু পরে তা আর হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্যের বিষয়টি স্বীকার করে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, তারা চেষ্টা করছেন সবার সঙ্গে সমঝোতা করে চলার।

জুয়েল বলেন, ‘সব ক্ষমতাসীন দলই চেষ্টা করে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে। আমরা চেষ্টা করছি সব ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করতে। ঈদের পর আমরা সবার সঙ্গে বসব।’ তবে এটি চালু করতে একটু সময় লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের এই মেয়াদে সম্ভব না হলেও আগামী মেয়াদের প্রথম বছরেই জাকসু নির্বাচন দেওয়া সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বললেও তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে এড়িয়ে যেতে চান। বর্তমানে ছাত্রদল ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছে, আলোচনায় তাদের আহ্বান জানানো হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জুয়েল রানা বলেন, ‘আমরা বৈধ ছাত্রনেতাদের (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) সঙ্গে আলোচনায় বসব। আর তাদের (ছাত্রদল) নেতাদের তো ছাত্রত্বই নেই।’

জাকসু নির্বাচন না হওয়ার জন্য উপাচার্য ছাত্রসংগঠনগুলোর দায় দেখলেও ছাত্রদল মনে করে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনকেই। জাবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম সৈকত বলেন, ‘জাকসু নির্বাচনে আমাদের শতভাগ সমর্থন রয়েছে। কিন্তু তা হতে হবে সরকারি ছাত্রসংগঠনের একক প্রভাবমুক্ত। সেই সঙ্গে হলগুলোতে সব মতের ছাত্রদের সহাবস্থান নিশ্চিত করে ক্লাস, পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে জাকসু নির্বাচন স্বপ্নই থেকে যাবে।’

একই কথা বলেন ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক নাজির আমিন চৌধুরী জয়। তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা বা মতামতের কোনো প্রতিফলন হচ্ছে না প্রশাসনের। ফলে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের দূরত্ব বাড়ছে। আর নির্বাচনের ক্ষেত্রে সব ধরনের উদ্যোগ প্রশাসনকেই নিতে হবে। আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।’

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর ওই বছরই গঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (জাকসু) এবং প্রথম জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম নির্বাচনে ভিপি হন গোলাম মোর্শেদ এবং জিএস নির্বাচিত হন রোকন উদ্দিন।

এরপর ৭৪, ৭৯, ৮০, ৮১, ৮৯, ৯০, ৯১ ও ৯২ সালসহ মোট নয়বার জাকসু নির্বাচন হয়। সর্বশেষ ১৯৯২ সালের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মাসুম হাসান তালুকদার এবং জিএস শামসুল তাবরীজ। ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই এক ছাত্রের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে তৎকালীন প্রশাসন জাকসু ও হল সংসদ বাতিল করে।

এরপর গত ২৫ বছরে ধরে নেই জাকসু নির্বাচন। ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বের জাকসু নির্বাচন না হলেও এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনসহ সব সংগঠনের নির্বাচন নিয়মিতই হয়েছে।

সূত্রমতে, ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯৭৩ অনুযায়ী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি পর্ষদ সিনেট। সেই সিনেটে অন্যান্য প্রতিনিধির সঙ্গে অধ্যাদেশের ১৯(১) এর (কে) ও ১৯(২) ধারা মেনে জাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সিনেটে ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধির বিষয়টি গত ২৫ বছর নিশ্চিত করা হয়নি। দীর্ঘ সময় ছাত্র-প্রতিনিধিদের মনোনীত সদস্য ছাড়াই সিনেটের অধিবেশন বসেছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটেনি।

(ঢাকাটাইমস/২০আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :