‘হামাক কিচু দেন বারে, সকাল থেকে না খায়া আচি’

প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০১৭, ১১:০২ | আপডেট: ২০ আগস্ট ২০১৭, ১৫:২২

প্রতীক ওমর, উত্তরাঞ্চল ঘুরে

আছির উদ্দিন বেপারী। বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার দুর্গম চরে বসবাস তার। বন্যায় আয়ের পথ বন্ধ। তাই খাবারের জন্য সাহায্যের অপেক্ষায়। কাছে যেতেই বলে উঠলেন, ‘হামাক কিচু দেন বারে, সকাল থেকে না খায়া আচি’।

‘কামলা দিয়ে খাই, সকটি পানি কুনটি কাম করমু কন। বেকার হয়ে বসে আচি। কাম না করলে কি দিয়ে চাল কিনমু কন’।

চোখে মুখে হতাশা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চলতি বছরই এর আগের দুই বারের বন্যায় মোট ২০ কেজি চাল পেয়েছিলেন। তার পর ত্রাণের কোন বরাদ্দ তার ভাঙাঘর অবধি পর্যন্ত পৌঁছেনি।

এক মাসের ব্যবধানে আবার আছির উদ্দিনের ছোট্ট কুটির পানির নিচে ডুবে গেছে। কোন রকমে আশ্রয় নিয়ে আছেন বাঁধের এক কোনায়। শরীরের ভারে নুয়ে পড়া এই বৃদ্ধ এখন অধীর অপেক্ষায় ত্রাণের প্যাকেটের জন্য। কেউ খেতে দিলে খাচ্ছেন, না দিলে অভুক্তই থাকছেন। এরকম অসংখ্য বানভাসী মানুষ এখন উত্তরের নদীপাড়ে দৃশ্যমান।

শুক্র ও শনিবার উত্তরের গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটা, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, বগুড়ার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, ধুনট উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে বানভাসি মানুষের কষ্টের চিত্র মেলে। এসব এলাকায় এখন নৌকায় অচেনা মানুষের দল দেখলেই বানভাসিরা ছুটে আসে ত্রাণের আশায়।

শহুরে কিছু তরুণ, হৃদয়বান ব্যক্তি, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো বরাবরের মতো তাদের পাশে দাঁড়ায়। এবারও দাঁড়িয়েছে। হাফ কেজি, এক কেজি চিরা, গুড়, মুড়ি, বিস্কুট এসবের বেশি কিছু থাকে না ত্রাণের প্যাকেটগুলোতে। তারপরও ক্ষুধার্ত মানুষগুলো ছুটে আসে এসবের একটি প্যাকেট পাওয়ার আশায়।

এদিকে প্রথম দফা বন্যায় বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হলেও এবারের বন্যায় বেসরকারি উদ্যোগে ভাটা পড়েছে।
তবে সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা ইউনিয়নের দুর্গত মানুষের নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন বগুড়া জেলা বিএনপি শিশু বিষয়ক সম্পাদক মোশারফ হোসেন। তিনি নৌকাযোগে পাকুল্যা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে গিয়ে খাটিয়ামারি চর, পাকুল্যা, পূর্বসুজাতপুর চর, রাধাকান্তপুর চরের পাঁচ শতাধিক দুর্গত মানুষের প্রত্যেককে নগদ টাকা দেন।

বগুড়াসহ উত্তরের সাত জেলার বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও এখনও প্রায় প্রত্যেক পয়েন্টেই বিপদসীমার বেশ উপর দিয়ে বইছে নদী।  
বন্যা দুর্গত ইউনিয়নগুলো হচ্ছে সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ও কর্ণিবাড়ি, সোনাতলা উপজেলার মধুপর, তেকানি চুকাইনগর, পাকুল্লা, ধুনটের ভান্ডারবাড়ী, গোসাইবাড়ী।

তিন উপজেলার এসব ইউনিয়নগুলোর ৩৩ হাজার ৫২৭ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলো। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ৪৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এতে অনেকেই গৃহহারা হয়েছে। দুর্গত অনেক পরিবার এখনো বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে আছে। বাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও ঘরগুলো মেরামত ছাড়া বসবাস করা যাচ্ছে না।

লোকালয় থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও এখনো বিশুদ্ধপানি, খাবার এবং তিব্র জ্বালনি সংকটে আছে বন্যার্তরা। যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকের হাতেই ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি।

কথা হয় সারিয়াকান্দির বোহাইল ইউনিয়নের ৫৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ আজিমুদ্দির সাথে। তিনি বলেন, এবারের বন্যায় তার দুই ঘরের একটি ঘর একেবারেই ভেঙে গেছে। আরেকটি ঘরও যে কোন সময় ভেঙে যাবে। পাঁচ বিঘা জমিতে ফসল লাগিয়ে ছিলেন সেই ফসলসহ জমি এখন নদী গর্ভে। এতো কিছুর পরেও সরকারের ত্রাণ কার্যক্রমের কোন অংশই তিনি পাননি। এমন অভিযোগ করলেন ৫৫ বছর বয়সী খোতেজা বেগমও।

ত্রাণ কার্যক্রমে ধীরগতি

চলতি বন্যায় বগুড়ার চার উপজেলায় এখন পর্যন্ত ২৬০ মেট্রিক টন চাল এবং আট লাখ টাকা বিতরণ করেছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস। নন্দিগ্রাম উপজেলায় দুই ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হলেও সেখানে সরকারি ত্রাণের কোন কিছুই বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অথচ বগুড়ার বন্যার্তদের জন্য বরাদ্দ ৫০০ মেটিক টন চাল, সারে ১৪ লাখ  নগদ টাকা এখনো ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসে মজুদ আছে। কর্মকর্তারা বলছে পর্যায়ক্রমে বন্যার্তদের মাঝে এসব ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে।  

প্রথম বন্যায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট, সোনাতলা উপজেলায় ঘরবাড়ি, রাস্তা ঘাট, পুকুরের মাছ, মাঠের ফসলসহ বিভিন্ন ভাবে ৬৩ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার চারশত  টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতি মোকাবেলায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস বন্যা দুর্গতদের মাঝে ৩৩৫ মেট্রিক টন চাল, চার লাখ টাকা, ৪০০ বান্ডেল ঢেউ টিন বিতরণ করা হয়েছিল।

প্রথম বন্যার চেয়ে চলমান বন্যায় এসব এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ বেশি। অথচ ত্রাণ বিতরণ সেই তুলনায় অনেক কম। এর পরেও দুর্গত মানুষের তুলনায় এই ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়। বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষ এখনও ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। স্থানীয় চেয়ারম্যানও স্বীকার করলেন ত্রাণ স্বল্পতার কথা।

সারিয়াকান্দি উপজেলার বোহাইল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, সরকার চলতি বন্যায় কয়েক দফা ত্রাণ সামগ্রী দিলেও দুর্গত মানুষের তুলানায় অনেক কম। যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে আরো ত্রাণের প্রয়োজন বলে তিনি জানান।

বগুড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শাহারুল ইসলাম মো. আবু হেনা জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, নন্দিগ্রাম এবং ধুনট উপজেলার ৩৩ হাজার ৫২৭ পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। এসব বানভাসী মানুষ সারিয়াকান্দি আশ্রয় প্রকল্প, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মাধ্যে পর্যায় ক্রমে ত্রাণ এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে।

ঢাকাটাইমস/২০আগস্ট/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি