বানভাসিদের পাশে একজন মুজিব প্রয়োজন

মো. রেজাউল করিম
| আপডেট : ২১ আগস্ট ২০১৭, ১০:৫৬ | প্রকাশিত : ২১ আগস্ট ২০১৭, ১০:৫২

বর্ষা না বন্যা এ নিয়ে কথা বাড়ানোর সময় এখন না। তবে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চল অতঃপর দক্ষিণাঞ্চল প্লাবিতের খবর কারো অজানা থাকার কথা নয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষের মানবেতর জীবন কাটছে। রেহাই পাচ্ছে না অবুঝ গবাদি পশুগুলো। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেকে যেতে হয়েছে স্থানীয় বন্যাকবলিত এলাকায়। দেশের সার্বিক অবস্থা জানতে বর্তমানে অনেকটা সময়ই চোখ রাখতে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যমে। অভিজ্ঞতা হলো, অসহায় মানুষদের জন্য ভাবছে এরকম লোকের পরিমাণ হাতে গোনা। কেউ নৌকা ভ্রমণ করছে, কেউবা সেলফি তুলছে। সাহায্য? সেতো প্রয়োজনের তুলনায় যতসামান্য। এসব এলাকায় গাড়ি দেখলেই ছুটে আসে বানভাসিরা। ভাবে, এই বুঝি সাহায্যের বার্তা নিয়ে কেউ আসছে।

পাঁচ টাকার ব্যাগে ত্রাণ। তারপরও মাঝে বাধা। কতুটুকু সামগ্রিই বা ওর ভেতর থাকতে পারে? টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে গাবাসারা ইউনিয়নে এক বৃদ্ধা মহিলা বললেন, আমাগো ত্রাণ লাগবো না স্যার। একটু খাবার পানি দেন। কতোটা অসহায় হলে মানুষ এভাবে হাত বাড়ায়। তখন ভাবলাম পানি বাড়লো না কমলো এটা কোনো লেখার বিষয় না। লিখতে হবে এদের সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিয়ে। ওদের প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসাসেবা। একটু মানবতা, একটু ভালোবাসা আর একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে ওদের জন্য অনেক কিছুই করা সম্ভব। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ জেনেও আমরা ওদের পাশে কতটা সময় দিতে পেরেছি। সাহায্যে হাতটাই বা কতটা বাড়িয়ে দিতে পেরেছি।

ওদের জীবনযাত্রা দেখে মনে হচ্ছে, এই সময়ে বানবাসিদের পাশে একজন শেখ মুজিবুর রহমান প্রয়োজন। যাকে খবর দিতে হতো না। তিনিই নিজেই খবর নিতেন। তার একটি ভাষণে একাত্তরের মতো দেশের সিংহভাগ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। দেশের ১০ শতাংশ বানভাসি মানুষের পাশে ৯০ শতাংশ মানুষ দাঁড়ালে তখন আর দুর্যোগ মোকাবেলা করাটা খুব কঠিন হতো না। কিন্তু কে দেবে সেই ঐক্যের ডাক? নিজেকে নিয়েই আমরা বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।

শৈশব থেকেই মুজিবুর রহমান অধিকার আর দায়িত্বের প্রতি সচেতন ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হামিদ মাস্টার ছিলেন তাঁর গৃহ শিক্ষক। তাঁর এক স্যার তখন গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন সেই সংগঠনের প্রধান কর্মী। শৈশবেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান চাল সংগ্রহ করে ছাত্রদের সাহায্য করেছেন তিনি।

শৈশবেই যে খোকা (মুজিব) নিজের ছাতা গরিব বন্ধুকে দিয়ে ভিজে বাড়ি ফিরতেন, নিজের গায়ের চাদর অপরিচিত বৃদ্ধাকে জড়িয়ে দিয়ে খালি শরীরে বাড়ি ফিরতেন, খোকার বন্ধু গোপালের বাসিতে সুর নাই কেন? উত্তরে যখন জানলেন চারদিকে আনন্দ নাই বলে। ওই বয়সে দেশের মানুষ নিয়ে ভাবতে খোকা। সেই খোকার প্রয়োজন এখন বানভাসির পাশে দাঁড়াতে।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে ৭ জুন মার্শাল ল’তে এদেশের বেশ কিছু মানুষ গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। অধিবেশন নিয়ে কথা চলছিল। ১৯৬৯ সালের ২৫ জানুয়ারি অধিবেশন বসার আহ্বান জানালে মুজিব তখন বলেছিলেন আমার ছেলেদের রক্তের দাগ শুকায়নি। আমার ছেলেদের রক্তের দাগ পাড়িয়ে মুজিবুর রহমান আরটিসির অধিবেশনে যাবেন না। যে মুজিবুর রহমানের ভেতর জাতির জন্য এই দরদ ছিল সে বেঁচে থাকলে দেশের এই দুর্যোগে কেউ ঘরে বসে থাকার সুযোগ পেত না। কেউ জন্ম দিনের কেক কাটতে পারতেন না। জাতির জনকের মৃত্যুবার্ষিকীর জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ হলো। তিনি বেঁচে থাকলে কারো মৃত্যু দিবসে দেশের এই অবস্থা দেখে বড় অংকের অর্থটা বানভাসিদের জন্যই হয়ত বিলিয়ে দিতেন তিনি। সাত কোটি মানুষের জন্য কম্বল কিনেও নিজের বা স্বজনদের জন্য একটি কম্বলের কথা ভাবেননি তিনি। এই সময়ে সেই মুজিবের দরকার ছিল। যিনি নিজের জন্য না ভেবে ওদের পাশে দাঁড়াতেন।

৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে বলেছিলেন, শত্রু বাহিনী ঢুকে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে কলহ করবে। প্রত্যেক গ্রামে মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। মনে রাখবে রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব।এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেছিলেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান করছি, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিতেও দ্বিধা করেনি। এখন জীবন দিতে হবে না, শুধু একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ঐক্যের ডাক দেয়ার কেউ নেই। প্রয়োজন আবার সেই মুজিবের। আরেকটি ভাষণের মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষা দেয়া। কীভাবে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়।

দেশের এই দুর্যোগময় সময়ে ওদের পাশে দাঁড়াতে পারতো স্থানীয় বিত্তবানরা। পাশে আসতে পারতো শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, গার্মেন্টস, ঔষধ কোম্পানি, এনজিও, বিভিন্ন সংগঠন, ক্যাবল ব্যবসায়ী, প্রাইভেট ফোন কোম্পানি। সাহায্য করা যেত কোরবানির টাকার একটি অংশ দিয়েও। দেশে প্রায় পাঁচ কোটি ফোন গ্রাহক রয়েছে। প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে কর্তন করলে ২৫ কোটি টাকা এসে যেত। প্রবাসীদের কাছ থেকেও ছোট্ট একটি অংক করে যোগ করলে মোটের ওপর বড় একটি অংকে দাঁড়াতো। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতটিও বাড়িয়ে দিতে চোখে পড়ছে না। ঈদের পূর্বে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা সাড়ে ৫২ হাজার টাকা পাচ্ছেন। ইচ্ছে করলে আমাদের আরেকটা ভাইকে বাঁচাতে ছোট্ট একটা অংক তারা ইচ্ছে করেই দিতে পারতেন। কিন্তু কই? কাউকে তো এভাবে ভাবতে দেখা যায়নি। শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে একটি ভাষণে এদেরকে সাহায্যের হাত বাড়াতে আগ্রহ জন্মাতো। তাকে দেখিনি। টিভিতে তার ভাষণ দেখে তার অভাবটা অনুভব করছি।

এদিকে সরকার বসে নেই। সাধ্যমত বানভাসিদের পাশে দাঁড়ানো চেষ্টা করছে। ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে। জানি না, কতটা ত্রাণ সামগ্রী দেশে মজুদ আছে। তবে বানভাসিরা যা পাচ্ছে তা যথেষ্ট না। এক প্লেট খিচুরি। সেতো একবারের খাবার। পাঁচ কেজি চাউল সেতো দু-দিনের খাবার। পত্রিকায় দিনাজপুরে খবর পড়লাম। সেখানে ৪৮৫ মেট্রিকটন চাল আর নগদ পাঁচ লাখ টাকা বানবাসিদের জন্য বরাদ্দ হয়। এটা কম নয়। কিন্তু ওখানে পানিবন্দি লোকের পরিমাণ প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। প্রতিজনে গড়ে পেয়েছেন এক কেজি চাউল আর নগদ তিন টাকা। যা দিয়ে একদিন চলা যাবে না। এটা শুধু দিনাজপুরের চিত্র না। বানভাসি অধিকাংশ এলাকার একই চিত্র। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোকেও ঐক্যবদ্ধ দেখা যাচ্ছে না। এরা নিজে কী করছে তা না ভেবে অন্যের কী করা দরকার ছিল এনিয়েই বেশি বলছেন। একটু সহযোগিতার ছবি কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করতে ব্যস্ত।

তাই বলছি এই মুহূর্তে আরেকটিবার শেখ মুজিবুর রহমানের প্রয়োজন ছিল। অন্তত আমাদের ঐক্যের শিক্ষা দিতে। অন্তত ওদের পাশে দাঁড় করিয়ে দিতে।

লেখক: সংবাদকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :