পুলিশ বলেছিল আমার কিছুই হবে না: জজ মিয়া

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২১ আগস্ট ২০১৭, ২২:১৫ | প্রকাশিত : ২১ আগস্ট ২০১৭, ১০:৫৯

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ধামাচাপা দিতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পুলিশ যাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছিল, সেই জজ মিয়া এখন ভাড়ায় গাড়ি চালান। ঢাকাটাইমসকে তিনি জানান, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাকে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়। তবে তার মানে জবানবন্দির কিছুই তিনি বলেননি, পুলিশ যেভাবে বলেছে, বিচারক সেভাবেই সব লিপিবদ্ধ করেছেন। আবার পুলিশ তখন এমনও বলেছিল, এই জবানবন্দি দিলেও তার কিছু হবে না। তাকে কৌশলে মুক্ত করে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হবে।

রাষ্ট্রীয় সংস্থার ‘নির্যাতনের’ শিকার জজ মিয়া আশা করেছিলেন সরকার তার পাশে দাঁড়াবে, একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন, কিন্তু তা হলো না।

আলোচিত সেই জজ মিয়ার প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জালাল। তিনি এখন থাকেন ঢাকার উপকণ্ঠে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়। ভাড়া করা প্রাইভেটকার চালিয়ে জীবন যাপন করেছেন।

জোট সরকারের আমলে বিনা দোষে ১৭ দিন রিমান্ডের যন্ত্রণা সহ্য করে চাপের মুখে আদালতে ‘আজগুবি’ স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন জজ মিয়া। যে কথা তিনি সেদিন বলেছিলেন, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাও ছিল না। পরে অবশ্য পুলিশের এই নাটক ফাঁস হয়ে যায়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড জামলার ১০ মাস পর ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে আটকের কথা জানায় সিআইডি। তারা দাবি করে এই জজ মিয়াই হামলাকারীদের একজন এবং তিনিই মূল হোতা।

ঢাকাটাইমসকে জজ মিয়া বলেন, ‘নোয়াখালীতে বাসা থেকে আমাকে ধরা হয় সন্ধ্যার সময়। পুলিশ বলে তুমি ফেনসিডিল বিক্রি কর, তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।’

জজ মিয়া বলেন, ‘আমি তাদের বলেছি, আমি যদি ফেনসিডিল বিক্রি করি, আপনারা এলাকার মানুষদের জিজ্ঞাস করেন, চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে জানতে চান তারা কী বলে।’

পরে তারা কী বলেছে?- জানতে চাইলে জজ মিয়া বলেন, ‘তারা আমারে থানায় (সেনবাগ) নিয়ে যায়। পরে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।’

জজ মিয়া জানান, হামলার দিন তিনি নোয়াখালীতেই ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো বাড়িতেই ছিলাম। আমি তো কিছুই জানি না। আমার মত মানুষের এইসব জানার কথা?’

তাহলে কেন আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছেন?- জানতে চাইলে জজ মিয়া বলেন, ‘ঢাকায় আনার পর আমাকে চোখে বেঁধে তিন থেকে চারটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, ক্রসফায়ারে দিবে বলে। পরে বলে আমাদের কথামত যদি তুমি জবানদন্দি না দাও, তাহলে তোমাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলব। পরে আমি তাদের কথামত আদালতে যাই।’

জজ মিয়া জানান, জবানবন্দি দিতে রাজি হলে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা মুন্সি আতিকুল ইসলাম, আবদুর রশিদ ও রুহুল আমিন তার সঙ্গে আদালতে যান। তারাই বিচারককে বলে দেন কীভাবে জবানবন্দি লিখতে হবে জজ মিয়ার নামে।

জজ মিয়া বলেন, ‘জবানবন্দি দেয়ার আগে আমি বলেছি, স্যার এই মামলায় তো তাইলে আমার জেল, ফাঁসি হয়ে যাবে। আমার সংসার কে দেখবে?’।

-তারা কী বলেছেন?

‘তখন তারা বলছে, ‘না, তোর কোনো চিন্তা নাই, তোকে আমরা বের করে বিদেশে পাঠিয়ে দেব, তোর কোনো ভয় নেই।’

-এরপর?

“এরপর প্রত্যেক মাসে পুলিশ আমার বাড়িতে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পৌঁছে দিত। তারা বলেছেন, ‘যতদিন দুই বেঁচে থাকবি, তোর পরিবারের টাকা পয়সা আমরা দিব’।”

-এখন আপনি কী চাইছেন?

‘আমারে যেন একটা চাকরি দেয় বা একট গাড়ি কিনে দেয়, যাতে আমি ফ্যামিলি নিয়ে ভালভাবে চলতে পারি।’

জজ মিয়ার নামে জবানবন্দিতে যা লিখা হয়েছিল

১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়া ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেন বলে দাবি করে সে সময়ের সরকার। এতে লেখা হয়, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি। গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। কিন্তু পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড মারতে এসেছেন।

কারা এই বড় ভাই? সে প্রশ্নেরও একটি জবাব জজ মিয়া আদালতে দেন। জানান, এই বড় ভাইরা হলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ।

এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালে জজ মিয়ার এই জবানবন্দি যে সাজানো, তা প্রকাশ করে দেন তার মা জোবেদা খাতুন। একটি পত্রিকাকে তিনি বলেন, জজ মিয়া গ্রেপ্তারের পর থেকে সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে খোরপোষের টাকা দিয়ে আসত। জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও বলেন জোবেদা।

এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই মামলা থেকে মুক্তি মেলে জজ মিয়ার।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মামলাটির পুনরায় তদন্ত হলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বেরিয়ে পড়ে থলের বিড়াল। তদন্তে দেখা যায়, বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুর সহযোগিতায় জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ওই হামলা চালিয়েছিল। মূলত তাদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে। চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সরাসরি মদদে তদন্তের নামে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল।

মামলা থেকে মুক্তি মিললেও জটিলতা

২০০৮ সালের ১১ জুন আদালতে সিআইডির দাখিল করা অভিযোগপত্রে ২২ জনকে আসামি করা হলেও অব্যাহতি দেওয়া হয় জজ মিয়াকে। তারপরও জজ মিয়ার মুক্তির বিষয়টি আটকে যায় ঢাকার সূত্রাপুর থানায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা (১০৮, তাং ২৭-১২-৯৮) মামলায়। এ মামলায় কোনদিন জজ মিয়াকে আদালতে হাজির না করা হলেও জোট সরকারের আমলেই ২০০৫ সালের ২ নভেম্বর ঢাকার বিচারিক আদালত তাকে সাত বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়।

পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্তি মেলে জজ মিয়ার। আর কারামুক্তির পর ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নিজ গ্রাম বীরকোটে এসে আত্মীয়দের ঘরে ওঠেন তিনি। কিন্তু মামলায় পড়ে ভিটেমাটিসহ সবকিছুই হারাতে হয় তাকে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে জজ মিয়ার বা জোবেদা খাতুনকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়।

এরপর জজ মিয়া ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের গাড়ি চালানোর চাকরি পান। পরে সে চাকরি ছেড়ে এখন নিজেই ভাড়ায় গাড়ি চালান শুরু করেন।

ঢাকাটাইমসের সঙ্গে আলাপকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে থাকেন জানালেন সুনির্দিষ্ট ঠিকানা বলতে চাননি জজ মিয়া। স্ত্রী সন্তানের ব্যাপারেও কোন কথা বলতে চাননি তিনি নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়ে।

জজ মিয়া বলেন, ‘অনেকে আমারে চাকরির আশ্বাস দিছিলেন। কিন্তু এখন কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলে দেখা করেন না। কেউই তাদের কোন কথা রাখেনি।’

‘আপনাদের মাধ্যমে আমি আমি সরকারকে বলব, চাকরি পেলে পরিবার নিয়ে বাকি জীবন সুন্দরভাবে কাটাতে পারব’-বলেন জজ মিয়া।

ঢাকাটাইমস/২১আগস্ট/এএ/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :