এ যুগের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০১৭, ১৪:১১

তৌহিদ এলাহী
ছবিতে বায়ে লেখক তৌহিদ এলাহী এবং ডানে সাইফুল ইসলাম

স্বপ্ন দেখার মানুষের অভাব নেই। কিন্তু কয়জনের তা পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে ? ব্যতিক্রম যারা তারা সকল প্রতিকূলতা ছাঁপিয়ে চলেন সোজা পথে। ছুটে চলে তাদের স্বপ্নপানে। সমাজ ও পরিবারের দেয়া প্রচলিত সফলতার সংজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে নিজ স্বপ্নের পেছনে ছুটেন। আজ এমন এক স্বপ্ন সারথীর কথা বলব। অতি সৌভাগ্যক্রমে সে আমার বন্ধু।

আমরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিষয়ে পড়েছি। আমরা দুজনই ওটা হতে বের হয়ে এসেছি। সে তার স্বপ্নপূরণে বহুদূর এগিয়ে যাচ্ছে। দূর্ভাগা আমি বেছে নিয়েছি সমাজের দেয়া ক্লাসিক্যাল সফলতার পথ। যেখানে নিজের স্বপ্নের ঠাঁই খুব কম।

যার কথা বলছি তার বহু মাত্রিক পরিচয়। সে একাধারে কবি, লেখক, অনুবাদক এবং সত্যিকারের বহুভাষাবিদ জ্ঞানসাধক। এক বিস্ময়। আমার দেখা একজন প্রডিজি।

আচ্ছা ভেবে বলুনতো। একজন ৩০-৩২ বছর বয়সী লোকের পক্ষে কয়টি ভাষা বিস্তারিত জানা সম্ভব? ৪/৫টি বললেই যে কারো চোখ কপালে উঠবে। আমি যার কথা বলছি তিনি জানেন পঞ্চাশাধিক। আবার পড়ুন পঞ্চাশাধিক। পঞ্চাশাধিক অর্থ পঞ্চাশ এর কিছু বেশি।

এর মধ্যে ১৫/২০টিতে সে অনর্গল বলতে পড়তে ও লিখতে পারেন। বাকিগুলো লিখতে ও পড়তে পারেন। সে মারাত্বক চোস্ত বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি, জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষায়। বলা, পড়ায় ও লেখায় দক্ষতা আছে ডাচ, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, অহমিয়া, উড়িয়া, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি ও নেপালের নেওয়ারি, চীনা, রুশ ও জার্মান ভাষায়।

পড়তে, লিখতে পারে ও শতকরা ৮০ ভাগ দক্ষতা আছে সংস্কৃত, ল্যাটিন, বার্মিজ, তিব্বতি, গোরখা, গ্রিক, কাজাখ, মংগোলিয়ান, তুর্কি, জর্জিয়ান ও আর্মেনিয়ান ভাষায়।

বর্তমানে প্রচলিত না এমন কিছু ভাষা ও লিপিতে তার কর্তৃত্ব ঈর্ষণীয়। এসব ভাষায় তার দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে বিভিন্ন প্রাচীন ভাষার উপর গবেষণায়। সে পাঠোদ্ধার করতে পারে ব্রাহ্মী লিপি, ইরানের পাহলভি, আভেস্তা, আশুরিয়া (Assyrian), সিংহলি লিপি, ইন্দোনেশিয়ার জাভা লিপি, কম্বোডিয়ার খমের লিপি, থাই লিপির। তার দক্ষতার ঝুলিতে আছে নেপালের রঞ্জন লিপি, প্রচলিত লিপি, পশতু, বালুচ, উইঘের (Sogdi), খরোষ্ট্রি লিপি, জাপানিজ ও কোরিয়ান ইত্যাদি ভাষা ও ভাষালিপির উপর আশ্চার্য দক্ষতা। এমন কেউ ইউরোপ আমেরিকায় থাকতে পারে দু একজন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ এমনকি পুরো এশিয়াতে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

তার সবচেয়ে বড় পরিচয় সে একজন কবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া অবস্থায় প্রকাশ করেছিল প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আরেক অহনা'। প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতার অভাবে যুতসই হয়নি। ২০১৬ সালে কোলকাতা বইমেলায় কলকাতার প্রতিভাষ প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ 'তন্দ্রাভিভূত বিমর্ষ মৌতাত'।

কবিতার বিষয় প্রেম-দ্রোহ , চাওয়া-না পাওয়া জীবনের নৈর্ব্যক্তিক ও দার্শনিক অভিব্যক্তি। কবিতা প্রকাশের মত দুই-তিনটি পান্ডুলিপি তার হাতে আছে এখন। দু-তিনটি কাব্যোপন্যাস লিখার কাজে বেশ এগিয়েছেন। আরবি, ফারসী ও উর্দু ভাষায় প্রায় ৫০/৬০টি মৌলিক কবিতা লিখা আছে তার। ভাল আবৃত্তি করে সে।

তার সবচেয়ে শক্তির জায়গা অনুবাদ। সে অনুবাদ করেছে আরবি ভাষার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস সুদানী সাহিত্যিক তাইয়্যেব সালিহ রচিত পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্যকর্ম 'মাত্তাসিমুল হিজরাত ইলাসসিমাত'। বাংলা নাম দেয়া হয়েছে 'উত্তরে খেপের মৌসুম' (অপ্রকাশিত)। অনুবাদকর্মটি করা হয়েছে নোয়াখালী ও ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায়।

দ্বাদশ শতাব্দীতে অমর আরবি সাহিত্যিক ইবনে তোফায়েল রচিত বিশ্বের প্রথম ফিলসফিক্যাল উপন্যাস 'হাই ইবনে ইয়াকজান' অনুবাদ করেছে সে( অপ্রকাশিত)।

শিশু সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল রুডিয়ার্ড কিপলিং, ডেনিয়েল ডিফোরা এই বইটি দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত বলে জানা যায়। আরো বাংলায় অনুবাদ করেছে নবম শতাব্দীতে রচিত ইবনে খুরাদাদবিহ রচিত ভৌগলিক ও ভ্রমণ বিষয়ক বই Kitāb al-Masālik wa l-Mamālik এর (অপ্রকাশিত)। তৎকালীন মুসলিম বিশ্ব ও মুসলিম বিশ্বের সাথে এশিয়ার সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের গতিপথ, প্রশাসনিক সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে এ বইটিতে।

ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের 'ম্যুরাল বা দেয়ালচিত্রের' ও সুফিতাত্বিক কাব্যগ্রন্থ 'পাকা খেলুড়ে' অনুবাদ করেছে সে। এছাড়াও দারবিশের বেশ কিছু বড় কবিতা আনুবাদ করা আছে তার কাছে। (সবগুলো অপ্রকাশিত)। সে অনুবাদ করেছে আরবি নাগরিক প্রেমের আধুনিক কবি মিজর কাব্বানির একটি কাব্যগ্রন্থ।

ব্যক্তিগতভাবে উপর্যুক্ত আলোচিত ব্যক্তিটি খুব সহজ সরল ভালো মানুষ। যোগাযোগে সাবলীল না। মিডিয়া ফেসবুকে উপস্থিতি তেমন নাই। বই বা লেখা প্রকাশে খুব বেশি আগ্রহী বলে মনে হয় না। নিজে নিজে সাধনা করতেই বেশি আগ্রহ। নটরডেম কলেজ হতে বিদায় নিয়ে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা কলেজে। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে ঢাবির অনুজীববিদ্যায়। এ বিদ্যাতেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারেন নি। কোনভাবে ঠেলেঠুলে সম্মানের বৈতরণী পার হলেও মাস্টার্স আর করা হয় নি। জার্মান দেশে পড়তে গিয়েছিল বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সে। অবস্থা তথৈবচ। ঐটা আর শেষ হয় নি। তার বদলে পড়ে এসেছে উচ্চতর জার্মান, ফ্রেঞ্চ ও বিভিন্ন ইয়োরুপীয় ভাষা।

দেশে জার্মান, ফ্রেঞ্চ ও চীনা ভাষা শিখিয়েছে কয়েকটি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রে। তবে পারিবারিকভাবে তেমন সমর্থন পেয়েছে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছল পরিবারের বাবা মায়ের কাছে এসব কোনকালেই পাগলামীর বাইরে কিছু মনে হয় নি। ঝামেলা ভালই হয়েছে।

আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, নজরুল সুকান্তের ক্ষণজন্মা অভিশাপের ছায়া তার উপর যেন না পড়ে। সে পাক রবীন্দ্রনাথের মত দীর্ঘ সাহিত্য ও জ্ঞান সাধনার জীবন। হয়ে উঠুক বাংলা সাহিত্যের আরেকজন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ । এটা হওয়ার প্রত্যেকটি যোগ্যতাই তার মধ্যে প্রবলভাবে আছে। আমার বিশ্বাস সে তা পারবে। কারণ স্বপ্নকে ছুয়ে দিতে সে ঝুঁকি নিজে জানে।

নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটে। নিজের গন্তব্য তার জানা। 'তন্দ্রাভিভূত বিমর্ষ মৌতাত' কাব্যগ্রন্থটির ফ্ল্যাপ হতে কবি পরিচয়ের কয়েক ছত্র তুলে দিচ্ছি। এতে লিখা ' বহুপ্রাচীন সে পরিচয়, সেই যে জাদুর মায়ায় আটকে থাকা সময়-ভাষা, কবিতা , গজল, শায়েরি, কড়চা কেচ্ছা আজও ছাড়তে পারেননি। হয়তো পারবেনও না। কারণ, সে তো মরুতৃষা। কারণ, তার নিয়ত আওড়ানো ফারসিতে সেই বুলি- বে সুয়ে সার-ব দাভীদান অ-দাতে এনসান আস্ত। মরুতৃষার দিকেই ধাবমানতাই ইনসানের আদত'।

অনেক পথ ঘুরে সে এখন কিছুটা থিতু হয়েছে বাংলা একাডেমিতে। জাতির পিতার বঙ্গবন্ধুর জীবন কাহিনি ও ঘটনাবলী আরবীতে লিখেছিলেন একজন মিসরীয় সাংবাদিক । সেটার অনুবাদ সূত্রেই বাংলা একাডেমিতে চাকরি নেয়া। বর্তমান পদবী সহকারী পরিচালক।

তার নাম ফেসবুকে দেয়া Izfandior Arion । লেখালেখি করে এ নামেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় সাইফুল ইসলাম লেখা থাকায় তাকে সাইফ বলে ডাকি। ডাকনাম জুয়েল। থাকে খিঁলগাওতে।

লেখক : নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট, ঢাকা জেলা প্রশাসন।