বন্যার ক্ষতি-১

দুই হাজার কোটি টাকা লোকসানের মুখে রংপুরের কৃষকেরা

রফিকুল ইসলাম রফিক, রংপুর
| আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৭, ১২:৫২ | প্রকাশিত : ২৭ আগস্ট ২০১৭, ০৭:৫৭

দুই দফা বন্যায় ক্ষতবিক্ষত করেছে রংপুর বিভাগের কৃষকদের। তারা সবকিছু হারিয়ে অনেকটা পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর আর্তনাদ উঠেছে চারদিক থেকে। দ্রুত এই কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে না দিলে দেশে চরম খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, এবারের ভয়াল বন্যায় এই অঞ্চলের তিন লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর জমির আমন, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ নষ্ট হয়েছে। ফলে কৃষকদের সামনে এখন অনিশ্চিত অন্ধকার।

বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বন্যার পর নতুন করে ধান লাগাতে প্রয়োজন নাভি জাতের চারা। কিন্তু সেই চারা পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও কোথা পাওয়া গেলে তা পর্যাপ্ত নয়। তাই আমন আবাদ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় কৃষক। কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। এখন তাদের চোখে মুখে শুধুই হতাশার ছাপ।

সরকারি বে-সরকারি হিসাব মতে, রংপুর বিভাগের আট জেলায় আমনের আবাদেই ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে শুধুই কৃষকদের ওপর।

তবে আশার আলো দেখাচ্ছে কৃষি বিভাগ, বলছে তাদের কাছে ২২ হেক্টর জমিতে নাভি চারার বীজতলা মজুদ আছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এত চারা কোথাও পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহে রয়েছেন কৃষক।

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঢাকাটাইমসকে জানায়, দ্বিতীয় দফা বন্যায় তিস্তা অববাহিকার ১৫২ কিলোমিটার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল ছাড়াও ঘাঘট, যমুশ্বেরী, ধরলা, দুধকুমরসহ বিভিন্ন নদ নদীর পানিতে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় এক লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির আমনক্ষেত, বীজতলাসহ বিভিন্ন শাকসবজির বাড়ন্ত আবাদ পানিতে তলিয়ে যায়। এরমধ্যে রংপুরে ৩৭ হাজার ৭১৫ হেক্টর, গাইবান্ধায় ২০ হাজার ২২ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ৪৭ হাজার ২৬১ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৩১ হাজার ৪০০ হেক্টর এবং নীলফামারীতে ৩৮ হাজার ৪০২ হেক্টর জমির জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়। বন্যার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এবার এই অঞ্চলে আমনের আবাদ হয়েছিল পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে।

অন্যদিকে দিনাজপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পুনর্ভবা নদীসহ বেশ কিছু নদীর পানির তাণ্ডবে তাদের অধীনে থাকা পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে বন্যায় পানিতে তলিয়ে যায় এক লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমির আমনের উঠতি আবাদ। এই তিন জেলায় বন্যায় পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আবাদ হয়েছিল চার লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে।

এই হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দুই জোন মিলে রংপুর বিভাগের আট জেলায় এবার বন্যার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমনের আবাদ হয়েছিল নয় লাখ ৮৯ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে তিন লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির আমনের আবাদ পানিতে নিমজ্জিত হয়।

কৃষি বিভাগের হিসাবে প্রতি হেক্টর জমিতে ২ দশমিক ৮ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্রায় পানিতে নিমজ্জিত পরিমাণ আমনের জমিতে নয় লাখ ৪৫ হাজার ৮৪০ মেট্রিক টন বা দুই কোটি ৩৬ লাখ ৪৬ হাজার মন ধান উৎপাদন হওয়ার কথা। বর্তমানে কমবেশি ১০০০ টাকা মন হিসেবে এই পরিমাণ ধানের দাম দুই হাজার ৩৬৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা হওয়ার কথা।

সরেজমিনে এই অঞ্চলের বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, বানের পানি নামলেও আমনের আবাদ হয়ে গেছে বিবর্ণ। মাত্র ১৫ দিন আগেও যেসব জমিতে ছিল আমনের সবুজ চারা। এখন সেসব চারা বিবর্ণ। অনেক জমিতে আমনের সেই গাছের চিহ্নটুকুও নেই। সেখানে একহাটু বালুর স্তুপ অথবা কাদার আস্তরণ। মরে গেছে সব চারা। অথবা মরার পথে। সবুজ মাঠ মাত্র ছয় দিনের পানিতে এমন বিবর্ণ হয়ে যাবে ভাবতেই পারছেন না কৃষকরা। এসব জমিতে নতুন করে আবাদ করতে গেলে চারা লাগাতে হবে সেই চারাও নেই তাদের। কিনে লাগাবেন তারও বুদ্ধি নেই। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না চারা।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বালাটারি গ্রামের কৃষক আপতার আলী ঢাকাটাইমসকে জানান, আমাদের পাঁচ দোন মাটির আমন এখন কাদার নিচে। এখন আমরা এসব জমি কীভাবে লাগাবো। আর বীজতলাও নেই যে, গায়ে গতরে খেটে আবার জেতি লাগাবো। বীজ কিনে এনে লাগাবো, সে ধরনের আর্থিক অবস্থাও নেই আমাদের। এই বন্যায় আমরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত।

এই কৃষক বলেন, সরকার যদি আমাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে এবং চারা সরবরাহ করে তাহলে আমরা আংশিকভাবে হলেও ক্ষতি পুষিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবো।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তারাপুর এই ইউনিয়নের সাজু কৃষক সাজু মিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমাদের সব শেষ। আমরা আর আবাদ করতে পারব না। কারণ জমিতে এখন বালুতে ভর্তি। এই বালুতে কিছু হবে না। আবাদ তো হবেই না।

সাজু বলেন, বন্যা হলেই সুন্দরগঞ্জের এই ইউনিয়নে বন্যার পানি আসে কিন্তু এবারের মতো কখনো পানি দেখিনি। ক্ষতিও কখনো হয়নি। কী করবো, কী খাবো, ছেলে-মেয়েদের কীভাবে খাওয়াবো পড়াবো আল্লাহই ভালো জানেন। এভাবে বলতে বলতে কপাল চাপড়িয়ে বলেন, আল্লাহ তুই বাঁচাও আল্লাহ বাঁচাও।

রংপুরের পীরগঞ্জের কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, আমাদের আমল তো দূরের কথা বাপ-দাদার আমলেও কখনো পীরগঞ্জে বন্যা দেখিনি। এবার বন্যায় সব আবাদ নষ্ট করেছে। আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই। তাদের সহযোগিতা না পেলে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবো না।

রংপুরে নোহালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ টিটুল ঢাকাটাইমসকে জানান, বন্যার পর পর একটা জরিপ করেছি। তাতে দেখা গেছে আমার ইউনিয়নে দুই হাজার ৯০ হেক্টর জমির আমনের আবাদ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কৃষি অধিদপ্তরকে আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছি। ডিসি সাহেব এসেছিলেন ওনাকেও জানিয়েছি। তিনি বলেন, এই মুহূর্তেও যদি নাভি জাতের রোপা আমনের চারা সরবরাহ করা হয়, তাহলেও আমি বিশ্বাস করি আমার নোহালীর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ঘুরে দাঁড়াতে জানে। সরকারিভাবে চারা সরবরাহ করা হলে তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারবে। অন্যথায় এখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে এবার।

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহ আলম ঢাকাটাইমসকে জানান, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় বন্যার আগের দিন পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির আমনের আবাদ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর সেসব থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। অনেক জায়গাতেই আবাদ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। একইভাবে দিনাজপুর জোনের তিন জেলায় চার লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমির আমনের মধ্যে এক লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমির আমন ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে যায়। আমরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নাভি জাতের আমনের বীজতলা তৈরি করে রেখেছি। চাহিদা ও তালিকার মাধ্যমে চাষিদের মাঝে বিতরণ করে ক্ষতি পুষিয়ে উঠার চেষ্টা করা হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৭আগস্ট/আরআই/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :