রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইউনূস ও সু চি চুপ থাকেন কেন?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৭ আগস্ট ২০১৭, ১৭:২৬

শান্তির নোবেলে ভূষিত ‘বড়’ মানুষগণ পৃথিবীর সবখানে মজলুম মানুষের পক্ষে আওয়াজ তুলবেন, এটাই সাধারণ প্রত্যাশা। ভারত থেকে আসা জলে সৃষ্ট সর্বনাশা বন্যায় বাংলাদেশে মানুষ কত কষ্ট পাচ্ছে। ওদিকে মিয়ানমারে নতুন করে শুরু হয়েছে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান। কিন্তু, না ড. মুহম্মদ ইউনূস, না অং সান সু চি, কেউই প্রাসঙ্গিক বিষয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করছেন না। প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট-কোনো দুর্যোগেই এই ‘শান্তি’ পদক প্রাপ্তদের বিপদাপন্ন মানুষ পাশে পায় না। কেন?

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এর নেতৃত্বাধীন কমিশন যখন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে জোর সুপারিশ করল, তখনই নতুন করে সহিংসতা শুরু। মিয়ানমারের পুলিশের উপর ‘সন্ত্রাসী’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের উপর সশস্ত্র হামলা চলছে। রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে গুলি করতে করতে আমাদের সীমান্তে চলে আসার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্ত লক্ষ্য করে মর্টার শেল পর্যন্ত নিক্ষেপ করেছে। শত শত রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের সীমান্তে এনে জড়ো করছে। আসতে না চাইলে গুলি করছে।

বুলেটে আহত এক রোহিঙ্গাকে মানবতার খাতিরে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিয়ে তাকে চিকিৎসা দিয়েও বাঁচানো যায়নি। কদিন পরপরই রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে মিয়ানমারের পুলিশ, সেনাবাহিনী আর কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের নিষ্ঠুর পন্থায় তৎপর হতে দেখা যায়। আগুনে পুড়িয়ে, দা দিয়ে কুপিয়ে, গুলি করে, রাতের অন্ধকারে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করে। জানের ভয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ডে পালিয়ে বাঁচতে চায়। যারা আসতে পারে তারা আশ্রয় শিবিরে কোনোমতে বেঁচে থাকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। আজ পর্যন্ত কত রোহিঙ্গাকে মিয়ানামারের রাষ্ট্র হত্যা করেছে তার কোনো হিসাব কারো কাছে নেই।

অথচ রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে মিয়ানমারে সম্মান ও অধিকার নিয়ে বসবাস করার। তারা সেখানকারই ভূমিপুত্র। শুধুমাত্র জাত আর ধর্মের কারণে মিয়ানমারের সরকার ও মঙ্গোলয়েড ধারার জনগণ রোহিঙ্গাদের সহ্য করতে পারে না। শিক্ষা-দীক্ষা আর সুযোগ সুবিধার দিক থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এতটাই পিছিয়ে পড়েছে যে, ঠিকঠাক মত নিজেদের অধিকার নিয়ে আওয়াজ তোলার সামর্থ্যটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে।

রোহিঙ্গা একেবারেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হলেও সেদেশের সরকারের নির্মম নীতির ফলে বাংলাদেশকে ভুগতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সাথে তারা মিশে যাচ্ছে। মিশে গিয়ে নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল অঞ্চলের প্রাকৃতিক ও মানবীয় পরিবেশ নষ্ট করছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে নেই কোনো আন্তরিক উদ্যোগ। বছর দুয়েক আগে সীমান্তে গুলিতে এক বিজিবি সদস্যের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।

দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে পরিচালিত মিয়ানমারের রাষ্ট্রযন্ত্র যে বর্বরতা অর্জন করেছে, সেখানে ক্ষীণ আশার আলো হয়ে ছিলেন ‘গণতন্ত্রের নেত্রী’ বলে পরিচিত নোবেলে শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু চি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অং সান সুচির সমস্ত আন্দোলন সংগ্রাম যেন মিয়ানমারের বৌদ্ধদের জন্যই সীমাবদ্ধ। অথচ তিনি নোবেল শান্তি বিজয়ী একজন নেতা। তাঁর কাছ থেকে সামান্যতম সহানুভূতিও পাচ্ছে না রোহিঙ্গারা। এদিকে সীমান্তে গুলিতে বিজিবি সদস্য নিহত হলেও, লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য হলেও, এদেশের জন্য বড় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হলেও আমাদের নোবেল বিজয়ী ‘বড়’ মানুষ ড. ইউনূসেরও কোনো শক্ত অবস্থান লক্ষ্য করা যায় না। সামাজিক ব্যবসার ধারণার বিশ্বায়ন ঘটানোর কাজ নিয়ে মহাব্যস্ত আন্তর্জাতিক তারকা ব্যক্তিত্ব কেন নিজ দেশের সমস্যা নিয়ে সরব হন না, সেটিও দেশের মানুষের কাছে এক বড় রহস্য। ২০১৩-২০১৫ সালে দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসে শত শত মানুষ হতাহত যখন হয়, তখনও এই নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রাপ্ত ‘বড়’ মানুষকে একটা কথা বলতে দেখা যায়নি।

তবে গত বছরের ডিসেম্বরে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হলে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অন্যান্য কয়েকজন ব্যক্তিত্বের সাথে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন ড. ইউনূস। সেখানে তারা অং সান সুচির কিঞ্চিৎ সমালোচনা করেছিলেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় ১৩ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীসহ মোট ২৩ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সু চির ভূমিকার সমালোচনা করেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে তাঁরা বলেন, বার বার আবেদন জানানোর পরও সু চি যেভাবে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ ও সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তা হতাশাজনক। তাঁরা আরও বলেছেন, সু চি মিয়ানমারের নেত্রী এবং এক্ষেত্রে সাহসিকতা, মানবিকতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টি মোকাবেলার প্রাথমিক দায়িত্বটি তারই কাঁধে ছিল।

এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানকারী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব তিমুরের হোসে রামোস হোর্তা, উত্তর আয়ারল্যান্ডের মেইরিড মগুইয়ের, দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, কোস্টারিকার অস্কার আরিয়াস, যুক্তরাষ্ট্রের জডি উইলিয়ামস, ইরানের শিরিন এবাদি, ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান, লাইবেরিয়ার লেমাহ জিবোইয়ি, বাংলাদেশের ড. ইউনূস ও পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই। এ ছাড়াও ওই বিবৃতিতে সই করেছেন ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রোদি, হাফিংটন পোস্টের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক আরিয়ানা হাফিংটন, ব্রিটিশ ব্যবসায়ী স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে করতে ড. ইউনূস কয়েক কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর সঙ্গে যারা ব্যক্তিগত কারণে দেখা করেছেন, তাঁদের বেশিরভাগই হিলারির পারিবারিক দাতব্য সংস্থা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়েছেন। এসব ব্যক্তির মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ড. ইউনূসের নামও রয়েছে।

অন্যদিকে ইউনূসকে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নোবেল কমিটির ওপর চাপ দেন বলেও গণমাধ্যমে খবর এসেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন প্রভাব খাটিয়ে ইউনূসকে অন্তত ১৩ মিলিয়ন ডলারের (বাংলাদেশি মূদ্রায় ১ ডলার সমমান ৭৮.৮৫ টাকা হিসেবে প্রায় ৮০ কোটি টাকা) তহবিল পাইয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ২০০৯ সালে ড. ইউনূসকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানেও ভূষিত করা হয়।

চির প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের মদদপুষ্ট মিয়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম সহযোগী হিসেবে সু চি দীর্ঘদিন থেকে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘মানবাধিকার’ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের হাত ধরে জগত জুড়ে ‘গণতন্ত্র কন্যা’ হিসেবে পরিচিত পাওয়া রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আসলেই নীরবতা পালন করেন।

অনেকে আছেন, রোহিঙ্গাদের বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খোলে দিতে বলেন। এটাই তো চায় মিয়ানমারের সরকার। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য একটা বড় দ্বীপ বা চরাঞ্চল বরাদ্দ করে দিতে চায় বলে শোনা গিয়েছিল। খুবই আত্মঘাতী হবে এই প্রক্রিয়া। রোহিঙ্গা সমস্যা একান্তই মিয়ানমারের নিজস্ব হলেও রাষ্ট্রটি গায়ে পড়ে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করেছে। জাতিসংঘে নালিশ দিয়ে, বুলেটের জবাবে বুলেট ছুঁড়ে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করে সমস্যা সমাধানে অগ্রবর্তী হতে পারে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে দুই নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস ও অং সান সু চি মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :