সংবিধান: সংশোধন, বাতিল এবং পক্ষ-বিপক্ষ

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ২৮ আগস্ট ২০১৭, ০৮:৩৪

সংবিধানের সংশোধন নতুন কিছু নয়। সংবিধান থাকলে তা সংশোধিত হবেই। পৃথিবীর এমন কোনো সংবিধান নেই যা কখনো পরিবর্তন বা সংশোধন হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান আয়তনে খুবই ছোট, ১২-১৩ পৃষ্ঠার। ছোট্ট এই সংবিধানটি এ পর্যন্ত ২৭ বার সংশোধন হয়েছে, নতুন নতুন বিষয় এতে যোগ হয়েছে। কোনো কোনো সংশোধন আনতে তাদেরকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, আইন প্রণেতাদের নানা স্তরে বিতর্কে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। কিন্তু সংশোধন একবার হয়ে গেলে তা নিয়ে আর মারামারি-কাটাকাটি হয়নি।

একটা উদাহরণ দেয়া যায়। বছর কয়েক আগে, তখন ওবামা সরকার। যুক্তরাষ্ট্রে বেসরকারি পর্যায়ে অস্ত্রের অপব্যবহার মারাত্মক পর্যায়ে বেড়ে যায়। অস্ত্রধারীরা যেখানে-সেখানে বেপরোয়া হত্যা করতে থাকে। একবার এক ব্যক্তি বাচ্চাদের স্কুলে গিয়ে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে গুলি করে। তখন ওবামা প্রশাসন খুব চেষ্টা করেছিল তাদের সংবিধানে একটা সংশোধন আনতে। যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের অস্ত্র বহন করার অধিকার দিয়েছে, এ অধিকারের বিষয়টি তাদের সংবিধানেই লেখা রয়েছে। ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল সংবিধানের এই ধারাটিতে পরিবর্তন আনতে। সকল নাগরিক অস্ত্র বহন করতে পারার কারণেই যে ওই অঘটনগুলো ঘটছেÑ এ বিষয়ে কারও তেমন কোনো দ্বিমত না থাকলেও সাংবিধানিক ওই অধিকারটি রদ করার ক্ষেত্রে সবাই একমত হতে পারেনি। ওবামা তার দলের লোকদেরকেই রাজি করাতে পারেননি। ফলে তাদের সংবিধানে অস্ত্র বহনের সেই অধিকারটি রয়েই গেছে। অথচ এই যে নাগরিকদের অস্ত্র বহনের অধিকার, এটা কিন্তু তাদের সংবিধানে একেবারে শুরুতে ছিল না। ১৭৯১ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে এটি যুক্ত হয়। এটি ছিল তাদের সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী।

আজকের দিনে অস্ত্র বহনের অধিকারকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে গেলে যেকোনো দেশেই আইনপ্রণেতাদের দারুণ বেগ পেতে হবে। অনেকে এটাকে বর্বর আইনও বলতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এটা রয়ে গেছে। ওবামার ডেমোক্রেট সরকার সেটাকে চেষ্টা করেও সরাতে পারেনি। এখন রিপাবলিকানরা সরকারে। তারা চেষ্টা করলেও হয়তো পারবে না। ওখানে সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া যতটা না জটিল, তার চেয়ে বেশি কষ্টসাধ্য হচ্ছে এমপি সিনেটরদের সমর্থন আদায়। প্রেসিডেন্ট চাইলেই হয়ে যায় না। সংসদে ভোটাভুটির সময় তার নিজের দলের সদস্যরাই এর বিরোধিতা করে। এরকম বিরোধিতার মুখোমুখি বর্তমান ট্রাম্প সরকার প্রায়ই হচ্ছে। যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই সব প্রতিশ্রুতিই তিনি বাস্তবায়ন করতে পারছেন না তার দলের এমপি সিনেটরদের প্রতিরোধের কারণেই। আবার এই যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধাচরণ, এজন্য তাদের পদও কিন্তু চলে যাচ্ছে না।

পার্থক্যটা এখানেই। আমাদের জাতীয় সংসদে যদি কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে, তাহলে সেই দলের শীর্ষ ব্যক্তি যদি সংবিধানের কোনো পরিবর্তন আনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাহলে সেটাকে প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। তার দলের কোনো এমপি যদি আনুষ্ঠানিকভাবে এর বিরোধিতা করেন, তাহলে তার সংসদ সদস্যের পদই খারিজ হয়ে যাবে। এই জায়গাতেই ওবামা কিংবা ট্রাম্পের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান আমাদের সরকারপ্রধানরা।

এই দেশে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যেমন সংবিধান সংশোধন হয়, তেমনিভাবে ব্যক্তির ইচ্ছাতেও হয়। এমনকি অনেক সময় একজন মাত্র ব্যক্তির জন্যও সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের একাদশ সংশোধনীতে যা ঘটেছে তেমন উদাহরণ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আদৌ আছে কি না সন্দেহ। এটা ঘটেছিল ১৯৯১ সালে, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের সময়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য নিরপেক্ষ ব্যক্তি খোঁজা হচ্ছিল। সব দল মিলে বললো- সেই সময়ে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদই হলেন সেই নিরপেক্ষ ব্যক্তি। অতএব তাকেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হোক। কিন্তু তিনি বেঁকে বসলেন, প্রধান বিচারপতির পদ ছেড়ে আসবেন না। কারণ একবার রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলে আবার তিনি বিচারপতির পদে ফিরবেন কিভাবে? তার এই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এরশাদ পতনের পর নতুন যে গণতান্ত্রিক ধারা চালু হয়, সেই গণতান্ত্রিক সংসদই ঐক্যবদ্ধভাবে সংবিধানকে সংশোধন করলো। সাহাবুদ্দীন আহমেদ যাতে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যেতে পারেন, সে লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সবাই একজোট হয়ে সংবিধানকে সংশোধন করলো। সেবার এই সংশোধনীর পক্ষে ২৭৮টি ভোট পরেছিল, বিপক্ষে কেউই ভোট দেয়নি।

‘নিরপেক্ষ’ বিষয়টাই একটা দুর্লভ ব্যাপার। সাহাবুদ্দীন আহমেদকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ সবাই নিরপেক্ষ হিসেবে এতটাই স্বীকৃতি দিয়েছিল যে, তার জন্য সংবিধান পর্যন্ত সংশোধন করেছিল। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এর ঠিক এক দশকের মধ্যেই দেশের প্রধানতম দল আওয়ামী লীগ এই সাহাবুদ্দীন আহমেদকে ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবেও আখ্যায়িত করতে দ্বিধা করেনি। আমাদের রাজনীতি এমনই।

এই যে একাদশ সংশোধন, এটা নিয়ে কিন্তু পরবর্তীকালে তেমন কোনো বিতর্ক হয়নি। বরং বিতর্ক বেশি হয়েছে চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, পঞ্চদশ ও ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে। এর মধ্যে তিনটি সংশোধনীকে আবার সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। আর একটি সংশোধনী বাতিল হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে। আলোচিত এই চারটি সংশোধনী হলো পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ এবং ষোড়শ। কেন, কি প্রেক্ষিতে বাতিল করা হলো এই চারটি সংশোধনী সে বিষয়ে আলোচনার আগে বরং একবার চোখ বুলানো যেতে পারে ওই সংশোধনীগুলোর দিকে।

পঞ্চম সংশোধনীটি হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতায়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে প্রধান যে দুটি পরিবর্তন আনা হয়েছিল তা হচ্ছে ইনডেমনিটি এবং বিসমিল্লাহ সংযোজন। ইনডেমনিটি বলতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকা-কে বৈধতা দান। সাংবিধানিকভাবে এই বৈধতা প্রদানের ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। এই সংশোধনীতে দ্বিতীয় যে কাজটি করা হয়, তা হলো সংবিধানের প্রস্তাবনায়, একেবারে শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনীকে বাতিল করে দেয়।

জাতীয় সংসদে সংবিধান প্রণীত এবং সংশোধিত হলেও সুপ্রিম কোর্টকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে। তাই সংবিধানে যদি এমন কিছু যুক্ত হয়, কিংবা পরিবর্তন হয়, যার ফলে মূল সংবিধানের চরিত্রটিই পাল্টে যাবে, তখন সুপ্রিম কোর্ট সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই এটা হয়ে থাকে। সেই ক্ষমতা বলেই সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেয় পঞ্চম সংশোধনীকে। এই বাতিলের ঘোষণায় একটা অদ্ভুত বিষয় কিন্তু লক্ষণীয়। সামরিক সরকারের সকল বিধি, নির্দেশ, দ-াদেশ বাতিল করা হলেও সংবিধানের শুরুতে যে বিসমিল্লাহ সংযোজন করা হয়েছিল, সেটা কিন্তু আর বাতিল করা হয়নি। ফলে শীর্ষ আদালতের রায় পুরো পঞ্চম সংশোধনীকে বাতিল করেছিল- এমনটি হয়তো বলা যাবে না।

সপ্তম সংশোধনীটি হয়েছিল আর এক সামরিক সরকার এরশাদের আমলে। সেটা ১৯৮৬ সালের কথা। সেটিও আসলে এক ধরনের ইনডেমনিটিই। ১৯৮২ সালে এরশাদ সেনাপ্রধানের পদে থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এরপর নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি গঠন। সেই জাতীয় পার্টি নির্বাচন করে পার্লামেন্টে আসার পর এই সপ্তম সংশোধনীটি পাস হয়। এরশাদ এই সংশোধনীটি এমনভাবে পাস করিয়ে নেন, যাতে ১৯৮২ থেকে ’৮৬ সালের মধ্যে তার সামরিক সরকারের সময়কালে সংঘটিত কোনো কর্মকা-কে কেউ চ্যালেঞ্জ না করতে পারে। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বাতিল হয়ে যায় সপ্তম সংশোধনী। এরশাদ সরকারের হাত দিয়ে সংবিধানের চারটি সংশোধনী হয়েছিল। আদালত কেবল একটিকে বাতিল করে। এরশাদের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমেই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সেই সংশোধনীটি কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে আমাদের সংবিধানে।

আদালত কর্তৃক বাতিল হওয়া অপর সংশোধনীটি হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী। নানা কারণেই এই সংশোধনীটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাসে এটি হচ্ছে একমাত্র সংশোধনী যা কি না বিরোধী দলের চাপে পড়ে সরকারকে করতে হয়েছে। এই সংশোধনীর মাধ্যমেই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাটি চালু হয়। ১৯৯৬ সালের মার্চে এই সংশোধনীটি হয়। ক্ষমতায় তখন বিএনপি সরকার। একটা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে মাত্রই তারা ক্ষমতায় এসেছে। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপি অনায়াসেই জাতীয় সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। আওয়ামী লীগের দাবি ছিল- নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এ নিয়ে তারা আন্দোলন করছিল। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার সে দাবিকে পাত্তা না দিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করলে আওয়ামী লীগ তা বর্জন করে। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সেই নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে আসে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ তখনও রাজপথে, তাদের ওই এক দাবি নিয়ে। রাজপথে থেকেই তারা এমন আন্দোলন গড়ে তোলে যে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি বাধ্য হয় বিরোধীদের দাবি মেনে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে।

এই যে এত আন্দোলনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনে বিএনপিকে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধি চালু করা, এই পদ্ধতির মৃত্যু কিন্তু হলো আবার সেই আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার সময়। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্তি ঘটায় তারা ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির। এর আগে অবশ্য সর্বোচ্চ আদালত এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সরকার অপ্রয়োজনীয় বলে সিদ্ধান্ত দেয়। আর তার আলোকেই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলোপ ঘটানো হয় এই পদ্ধতির। পঞ্চদশ সংশোধনীতে অবশ্য অনেক বিষয় পরিবর্তন করা হয়। বলা যায়, এই সংশোধনীটিই করা হয় সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি নিয়ে। শুরুতে বলা হয়েছিল, ’৭২ এর সংবিধানের মূল চেতনাকে ফিরিয়ে আনতেই এই সংশোধনী করা হচ্ছে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সঙ্গে একাধিক সংলাপের আয়োজন করা হয়। এসবের পর শেষ পর্যন্ত যে সংশোধনীটি করা হয় তার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থেকে যাওয়াসহ কিছু বিষয় অনেককেই অবাক করে। বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল নিয়ে আপত্তি তুলে, আন্দোলনের চেষ্টা করে।

এরপর আসে ষোড়শ সংশোধনী। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করা হয়। এর ফলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার জাতীয় সংসদের হাতে চলে আসে। এই সংশোধনী পাস হওয়ার দু বছরের মধ্যে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট এটিকে বাতিল করে দেয়। সে বিচারে এই ষোড়শ সংশোধনীর আয়ু সবচেয়ে কম বলে বিবেচনা করা যায়। অথচ সবচেয়ে বেশি আলোচনা, বিতর্ক, বিক্ষোভ সম্ভবত এই সংশোধনী এবং একে বাতিল করে দেয়া নিয়েই হয়েছে এবং হচ্ছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে তুলকালাম কা-। দেশের শীর্ষ আদালত, এত এত সংসদ সদস্যের ভোটে পাস হওয়া সংশোধনী বাতিল করতে পারে কি নাÑ সে প্রশ্ন যেমন উঠছে, তেমনি তীব্র আপত্তি উঠছে এই রায় লিখতে গিয়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়েও।

অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, রায় নাকি পর্যবেক্ষণের মন্তব্য- কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষতিকর হলে কোনটা বেশি ক্ষতিকর, সে সব নিয়েই জাতির মধ্যে একটা দ্বিধা তৈরি হয়ে গেছে। নির্বাহী বিভাগ আর বিচার বিভাগ যেন এখন দাঁড়িয়ে গেছে মুখোমুখি অবস্থানে। নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তি এমন ভাষায় কথা বলছেন, তাদের কথাগুলোকে টুইস্ট করে এমনভাবে নানা মুখে উচ্চারিত হচ্ছে যে, মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। যেন গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত।

আলোচনা সমালোচনা বেশি হচ্ছে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি যে পর্যবেক্ষণ লিখেছেন, সেটা নিয়ে। রায় ঘোষণার প্রায় মাসখানেক পর পূর্ণাঙ্গ রায় যখন প্রকাশিত হলো তখনই জানা গেল পর্যবেক্ষণগুলো। আর এরপর পর্যবেক্ষণ নিয়ে এমন রাজনৈতিক কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল, মনে হলো যেন রায়ের চেয়ে পর্যবেক্ষণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতেই বুঝি সরকারি দলের বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে। রাজনৈতিক এসব মাঠগরম করা কথার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতিও কিছু কথা বলেছেন। তাতে পরিস্থিতি ঠা-া হওয়ার পরিবর্তে যেন আগুনে ঘি পড়লো।

তবে এত এত আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে সংযত মনে হয়েছে রাষ্ট্রের প্রধান আইনজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যটি। তিনি বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি পুরো না পড়ে বা আংশিক পড়ে যেন কেউ কোনো মন্তব্য না করেন। তার এই বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য। কারণ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, সরকারি কিংবা বিরোধীদল, যার যে রকম সুবিধা সেভাবেই তারা কথা বলছে। নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রীর বক্তব্য খ-িতভাবে উদ্ধৃত করছে। কেবল করছেই না, চেষ্টা করছে এসব বলে বলে জনমত তৈরিরও। এসব প্রত্যাশিত নয়, গণতন্ত্রের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের।

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :