একজন যুদ্ধাহত বীর ও আমাদের প্রেরণা

নেয়ামাত উল্লাহ তাসনীম
| আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০১৭, ০৮:৩৫ | প্রকাশিত : ২৯ আগস্ট ২০১৭, ০৮:১২

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায়। তিন ছেলে আর দুই মেয়ের জনক হামিদ খুব খুশির সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ৭৫ বছর বয়সে এসে ও ব্যাংকের দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি যেন প্রমাণ করে যাচ্ছেন, দেশের সেবা করতে চাইলে বয়স কোনো বাধা নয়, যেকোনো বয়সে যেকোনো অবস্থায় মাতৃভূমির সেবা করা যায়।

এবার আসি মূল কথায়। পেশাগত কাজে প্রায়ই ব্যাংকে যেতে হয়। কাজের জন্য যাই, কাজ শেষে আবার ফিরে আসি, কিন্তু কখনো খেয়াল করে দেখিনি এই সম্মুখ সমরের যোদ্ধা এখানে কাজ করছেন। দিনটি ছিল আগস্টের ২৭ তারিখ। আমি ব্যাংকে লাইনে বেশি ভিড় দেখে সোফায় বসে কিছুটা জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। খুব করে খেয়াল করলাম পাশের বসা মুরব্বি আর ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ড আব্দুল হামিদ দুজনে কী যেন টাকা পয়সার ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মাঝে কথা বলছিলেন। আমি একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতেই বুঝলাম উনারা দুইজনই মুক্তিযোদ্ধা। সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলাম, সালাম দিলাম গার্ড চাচাকে; ততক্ষণে অপরজন চলে গিয়েছেন। আরও খেয়াল করলাম উনার বুকে লাগানো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ডের লোগো।

শুরু হলো আমার সাহসীর গল্প শোনা। তিনি একাধারে বলে যাচ্ছিলেন, আর আমি বিমোহিত হয়ে তাঁর কথাগুলো গিলছিলাম। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রায় শেষের পথে। তিনি আর তাঁর সহযোদ্ধারা সম্মুখ সমরে প্রবলবেগে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য। ৭নং সেক্টরে তাঁদের দায়িত্ব পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চাকঢালা গ্রামের গোদাগাড়ি এলাকা। তাঁদের কোম্পানিতে নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে তিনি তাঁর বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করে দুই দিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন আর নিজেই একভাগের নেতৃত্ব নিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করে যাচ্ছেন।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ। সময় আনুমানিক বেলা সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মতো হবে। যথারীতি তাঁরা পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে উপনীত হয়েছেন এবং তাদেরকে পরাভূত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সবাই।

ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ও তাঁর অন্য সহযোদ্ধারা সবাই মিলে মহানন্দা নদীর এই প্রান্তে পজিশন নিয়েছেন শত্রুদের খতম করার পণ নিয়ে। নদীর অপর প্রান্তে অবস্থান নিয়েছিল শত্রুপক্ষের বিশাল বাহিনী, যারা ছিল পাক হানাদার এবং তারা সবধরনের অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দিয়ে সুসজ্জিত। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুমান ছিল না যে তাঁদের কাছে ঠিক কী পরিমাণ অস্ত্র/গোলাবারুদ ছিল। বীর বাংলার সাহসী সন্তানেরা কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে তাদেরকে পিছু হটানোর পরিকল্পনা নিয়ে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ঠিক যেইমাত্র তিনি বাংকার থেকে বেরিয়ে দূরবীণ নিয়ে নদীর অপর প্রান্তে শত্রুদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার জন্য নদীর কিনারে উঠেছেন এবং একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছেন তেমনি অন্য বাংকার থেকে ঘাতক দলের গুলি এসে ছিন্নভিন্ন করে দেয় তাঁর দেহ। শহীদ হলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ঠিক তাঁর এক-দেড় ফুট পেছনেই ছিলেন আব্দুল হামিদ, যিনি সামনে থেকে দেখেছেন তাঁর বীরত্ব এবং দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ।

এরপর তিনি সাহস করে নদীর কিনারা থেকে তাঁর লাশ তুলে আনার জন্য মনস্থির করলেন এবং নেমে পড়লেন। লাশ নিয়ে তিনি নদীর কিনারা পর্যন্ত উঠে ও এসেছেন আর তেমনি শুরু হলো এলোপাতাড়ি গুলিরবর্ষণ আর ব্রাশফায়ার। আব্দুল হামিদ আর কিছু জানেন না, লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। সন্ধ্যা বেলায় গ্রামের লোকেরা গরু আনতে মাঠে গিয়ে তাঁদের দেখতে পান এবং শাহজাহান আলির (যিনি ও পরে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন) সাহায্যে তাঁদের দুইজনকে ক্যাম্পে নিয়ে আসেন।

বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের লাশ পাঠানো হয় ক্যাম্পে এবং আব্দুল হামিদকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ভারতের কলকাতায়। সেখানে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ দেখে ডাক্তাররা তাকে পাঠিয়ে দেন দিল্লির শিরাক হাসপাতালে। সেখানে তাকে দেখতে আসেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তাঁর শারীরিক অবস্থার সার্বিক খোঁজখবর নেন এবং দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। পরম ভালোবাসায় এবং স্নেহ করে তিনি এই বীরের কপালে চুমু ও খেয়েছেন।

আমি ৭১ দেখিনি, কিন্তু সেদিন ৭১ যেন আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছিল। আমি বীরপ্রতীক আব্দুল হামিদের বুকে বুলেটের দাগও দেখেছি।

লেখক: সহ-প্রতিষ্ঠাতা, মমোদা ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :