অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৩৯

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ০৮:৪৮

নজরুল ইসলাম রাজনের জন্য আমি যতটা জোর দিয়ে তদবির করেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে আমার ব্যাপারে শওকত মাহমুদের কাছে সুপারিশ করেছিলেন পূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস; আমার সামনেই। তখন বৈশাখী টেলিভিশনে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। ফোন রেখে একজনকে ক্যাম্প অফিসের ঠিকানা লিখে দিতে বললেন মির্জা আব্বাস; আমাকে বললেন, পরদিন সকাল ১১টার মধ্যে সিভি নিয়ে শওকত মাহমুদের সঙ্গে দেখা করতে।

নির্ধারিত সময়ে গেলাম বৈশাখী টেলিভিশনের ক্যাম্প অফিসে। যতটুকু মনে পড়ে, অফিস ছিলো বনানী ব্রিজের দক্ষিণ দিকে লেকের পাশে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো, মির্জা আব্বাস যতই জোর দিয়ে বলুক; আমার আসলে হবে না। মালিক পক্ষের তদবির সাধারণত সাংবাদিকরা এড়িয়ে চলে। এ ক্ষেত্রে নানান বাস্তব-অবাস্তব ইকোয়েশন কাজ করে। এ খাসিলত আমারও ছিলো। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লোক নিয়োগের বিষয়ে সৈয়দ মোয়াজ্জমের কোন সুপারিশই রাখিনি। তবে তিনি যে খুব বেশি ভালো কোন সুপারিশ করেছেন তাও কিন্তু নয়। আসলে এও এক রকম বাস্তবতা। মালিকদের কাছ থেকে যে সুপারিশ আসে তা সাধারণত রাখার মতো হয় না। আর মালিকরা সুপারিশ করেই কুল্লে খালাস; রাখা না রাখা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। সব মিলিয়ে মালিকদের সুপারিশ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় না নেয়াই প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অতি অন্ধ হয়ে গেলে তা বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটাতে পারে। এমনটি আমার ক্ষেত্রে একবার ঘটেছে।

সিরাজগঞ্জের শ্রী রাম কৃষ্ণ সাহা নামে একজন জ্যেষ্ঠ লেখকের সঙ্গে নির্মম আচরণ করেছিলাম সুগন্ধায় থাকাকালে। তিনি তার লেখার সম্মানী বৃদ্ধি করার জন্য মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম সাহেবের কাছে দীর্ঘ এক চিঠি লিখেছিলেন। টাকা বৃদ্ধির কারণও ব্যাখ্যা করেছিলেন চিঠিতে, যা মানবিক বিবেচনায়ই পূরণ করা উচিত ছিল। তাছাড়া তার দাবি মোটেই অযৌক্তিক ছিলো না। তার লেখার পাঠকও ছিলো। কিন্তু যেহেতু মালিকের কাছে চিঠি লিখেছে তাই মজ্জাগত ইগো থেকে বিষয়টি অন্যভাবে নিলাম। ‘ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়ার অপরাধে’ তার লেখা ছাপা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অনেক পরে বুঝেছি, খুবই অন্যায় ও নিষ্ঠুর আচরণ করেছি আমি, যা প্রকৃতির বিচারে ক্ষমার অযোগ্য। অনেক বছর পর এ বিষয়টি আমার বড় রকম মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার আর কিছু করার ছিলো না তার কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া। তার কাছে মনে মনে অনেক বার ক্ষমা চেয়েছি; আজ চাচ্ছি প্রকাশ্যে। জানি না, আজ তিনি আছেন স্বর্গে না মর্তে। তবে মর্তে থাকার সম্ভাবনা কম।

বৈশাখী টেলিভিশনের ক্যাম্প অফিসে গিয়ে দেখি আরো কয়েকজন অপেক্ষা করছেন। তবে আমাকে ডাকা হলো সবার আগে। মন্ত্রী কাম মালিকের রেফারেন্স বলে কথা। এরপরও আমার মনে হচ্ছিল, ইন্টারভিউই সার; কাজের কাজ কিছুই হবে না। ইন্টারভিউ নেবার জন্য দু’জন ছিলেন। একজন শওকত মাহমুদ; অন্যজন অপরিচিত। আমি প্রবেশ করার পর একটি সিগারেট বের করে ম্যাচ হাতে ধুমপানের জন্য বাইরে গেলেন শওকত মাহমুদ। ফলে সাক্ষাৎকার নেবার কাজ শুরু করলেন অপরিচিত ব্যক্তিটি। সেটিই ছিলো আমার জীবনের আনুষ্ঠানিক একমাত্র ইন্টারভিউর ঘটনা। সেই অদ্ভূত অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীতে আমি নিজে ইন্টারভিউ বোর্ডে যতবার থেকেছি প্রতিবারই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেছি যাতে অবস্থানের দাপটে অবান্তর প্রশ্ন না করে ফেলি। কিন্তু অন্য সদস্যদের যেসব প্রশ্ন করতে দেখেছি তাতে কখনো মনে হয়েছে, ধরনী দ্বিধা হলে ভালো হয়। এ ব্যাপারে মাইটিভি’র মোস্তাফিজুর রহমানের একটি রসিকতা আছে, “ধরনী তুমি দ্বিধা হও, আমি গাছে উঠি!”

শুরুতেই বুঝলাম, মিডিয়া সংক্রান্ত কোন ধারণা বৈশাখী টেলিভিশনের মহাজ্ঞানী রত্নটির নেই। নাটক সিনেমায় যে নমুনা দেখানো হয় অনেকটা সেই গোছেন ইন্টারভিউ শুরু হলো আমার। সে সমানে প্রশ্ন করছে; আমি জবাব দিচ্ছি ফ্রিস্টাইলে। এভাবে চললো প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। তার শেষ প্রশ্ন ছিলো, “আমরা আপনাকে নিলে কতদিন চাকরি করবেন।” কি ভেবেই যেনো জবাব দিলাম, দুই বছর। তিনি বললেন, “আপনার সিভি তেমনই প্রমাণ করে।” এরপর তিনি চুপ হয়ে গেলেন। প্রায় পাঁচ মিনিট আমরা দুজনেই বসে ছিলাম নিশ্চুপ। সে এক অস্বস্তিকর নীরবতা। অবশ্য চাইলে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতোও ভাবা যেতো, “আমাদের স্তব্ধতা, আমাদের শান্তি।”

আমার অশান্তি কাটলো রহস্যজনক ‘ধুমপান’ শেষ করে শওকত মাহমুদ রুমে ঢোকার পর। নীরবতা ভঙ্গ হলো। এতক্ষণ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী রত্নটি বললেন, চাকরি হলে উনি তো দুই বছর করবেন। ভাবখানা এই, তিনি একশ’ বছরের জন্য লোক নিয়োগের পরিকল্পনা করেছেন। শওকত মাহমুদ কোন কথা বললেন না; পুরো সময়টা তিনি মুখে কুলুপ এটেছিলেন। চাকরি প্রার্থীর কৃষ্ণ বিনয় রক্ষা করে বিদায় নিলাম। দোতলা থেকে নামতে নামতে নিশ্চিত হলাম, আমার হবে না। আসলেও হয়নি। কেন হয়নি সে অনুসন্ধান আমি করিনি। এদিকে মিডিয়া সিন্ডিকেটের উদাহরণ বিবেচনায় মনে হচ্ছিলো, বৈশাখী টেলিভিশন অর্গানাইজ করার ক্ষেত্রে শওকত মাহমুদ সফল হবেন না। এ ধারনার সাথে যুক্ত হলো লোক নিয়োগে বালখিল্য প্রক্রিয়ার বিষয়টি। ফলে আমার চাকরি হলো কি হলো না, কি কারণে হলো না- এসব নিয়ে আমার মোটেই মাথা ব্যথা ছিলো না।

পরে শুনেছি মির্জা আব্বাসের জোরালো তদবিরের কারণে শওকত মাহমুদ ধনুকের মতো বেঁকে বসেছিলেন। তবে তার হাতে তীর-ধনুকের নিয়ন্ত্রণ বেশি দিন থাকেনি। সম্ভবত আনুষ্ঠানিক অনএয়ারের আগেই শওকত মাহমুদকে বৈশাখী টেলিভিশন ছাড়তে হয়েছে।

ইচ্ছার বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার মালিক লাইনে হেটেছিলাম দৈনিক যুগান্তরে। পাকিস্তান বিরোধী উত্তাল রাজনীতির সময় ছাত্রলীগের সভাপতি, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ এবং নানান বিতর্কিত ভূমিকার জন্য আলোচিত-সামালোচিত রাজনীতিক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের এক সময় মনে হলো, আমার জন্য তার কিছু করা দরকার। এক দিন গুলশানের বাসায় ডেকে নিয়ে বললেন, “বাবুলকে বলে দিচ্ছি; তুমি যুগান্তরে জয়েন করো।” বিপদে পড়লাম। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, মালিক চাইলেই কাউকে পত্রিকায় ঢুকাতে পারে না; আর সিনিয়র লেবেলে তো অসম্ভব। আমার কথা শুনে তিনি চটে গেলেন। বললেন, “তুমি কি মনে করো; বাবুল আমাকে বাবার মতো মানে।” এই বলে তিনি নূরুল ইসলাম বাবুলকে ফোন করলেন। এবং এমনভাবে কথা বললেন, যেনো পত্রিকার তিনিই মালিক, আর নূরুল ইসলাম বাবুল কেয়ারটেকারের একটু উপরে মাত্র। প্রায় একই রকমের আচরণ করতে দেখেছি জেনারেল এরশাদের ১৮ দফার রূপকার এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানকে এসএ টিভি’র মালিক সালাউদ্দিন আহমদের সঙ্গে ইন্টারভিউ বোর্ডে।

শাহ মোয়াজ্জমের কথা রাখতে গিয়ে পন্ডশ্রম করলাম। পরদিন দেখা করলাম নূরুল ইসলাম বাবুলের সঙ্গে। বুঝলাম শাহ মোয়াজ্জেম খুব বেশি বাগারম্বড় করেননি। নূরুল ইসলাম বাবুল আমার সামনেই শাজাহান সর্দারকে ফোন করলেন। মির্জা আব্বাসের মতো প্রথমেই বললেন, “আলম রায়হানকে চেনেন?” ওপারের উত্তর আমার জানার সুযোগ ছিলো না। যেমন সুযোগ ছিলো না, আমাকে শাজাহান সর্দার না চেনার। বরং তিনি আমাকে শওকত মাহমুদের চেয়ে বেশি চিনতেন। আমি তার লেখা দীর্ঘ সময় সুগন্ধায় ছেপেছি এবং প্রতি লেখার জন্য পাঁচশ’ টাকা করে সম্মানী দিয়েছি; লেখার সম্মানী হিসেবে ২৭ বছর আগে পাঁচ টাকা বেশ সন্মানজনকই ছিলো। তিনি সাজু সর্দার নামে লিখতেন।

নূরুল ইসলাম বাবুল জোর দিয়েই শাজাহান সর্দারের কাছে আমার ব্যাপারে বলেছিলেন। এরপরও আমি নিশ্চিত ছিলাম, পুরোটাই হবে পন্ডশ্রম। সেনাকল্যাণ সংস্থা ভবনে জনাব বাবুলের অফিস থেকে বেরিয়ে কাছেই দৈনিক যুগান্তর অফিসে শাজাহান সর্দারের রুমে গেলাম। সম্ভবত তিনি ব্যস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। তিনি বেশি সময় নষ্ট করেননি। এমনকি তার ব্যবহারে লেশমাত্র বোঝার উপায় ছিলো না, আমরা পূর্বপরিচিত। তিনি নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলমকে ফোন করে আমার বিষয়টি দেখার জন্য বললেন। তার শেষ কথা ছিলো, “চেয়ারম্যান সাহেব পাঠিয়েছে।” শেষ বাক্যটি কোন ম্যাসেজের ‘কোড’ কিনা জানি না। তবে আমার সন্দেহ হলো। তবু গেলাম সাইফুল আলমের কাছে। তার রুমে সিলেটের পত্রিকার এজেন্ট মোহাম্মদ ইসমাইল আগে থেকে ছিলো। সাপ্তাহিক সুগন্ধা সূত্রে সে আমার পূর্ব পরিচিত। বহুদিন পর দেখা হওয়ায় আবেগের আতিশয্যে ইসমাইল এমনভাবে আমার প্রশংসা শুরু করলো যেনো আমি এক বিখ্যাত সম্পাদক। এমনকি, তার মূল্যায়নে সাইফুল আলমের চেয়েও আমি বড় সাংবাদিক! বুঝলাম, ১৫ আগস্টের খুনিচক্রের বিরুদ্ধে ৩ নভেম্বর পাল্টা ক্যুর পর জেনারেল খালেদ মোশাররফের মায়ের নেতৃত্বে মিছিল বের করার মতো আত্মঘাতি হয়ে গেলো বিষয়টি।

ব্যবসায়িক কারণে সিলেটে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী কুমিল্লার মানুষ ইসমাইলের উল্লেখিত প্রশংসার সুনামীতে অন্য কেউ হলে চটে যেতেন। কিন্তু সাইফুল আলম মোটেই চটলেন না। প্রশংসাকারীকে থামাবারও চেষ্টা করেননি। বরং খুবই ধীরস্থিরভাবে আমাকে বললেন, ‘যুগান্তরে জনবল বেশি আছে; টেলিভিশন আসবে; পত্রিকা থেকে কিছু লোক সেখানে যাবে; তখন অপনাকে যুগান্তরে নেবো।’ সেসময় টেলিভিশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমি নিশ্চিত ছিলাম, পত্রিকা থেকে টেলিভিশনে লোকবল যাবার তেমন সুযোগ থাকে না এবং যুগান্তরেও আমার হবে না। আসলে হয়ওনি। মাঝখানে আমার কয়েক ঘন্টার শ্রম মাঠেমারা গেলো।

এরপর প্রায় দুই বছর আমি আর শাহ মোয়াজ্জমেন কাছে যাইনি। তার সুপারিশ কাজে আসেনি- নিশ্চয়ই তিনি তা মানতে চাইতেন না। যেমন জেনারেল এরশাদের পতনের শেষ মুহুর্তেও বাস্তবতা মানতে চাননি বলেই তিনি দম্ভোক্তি করেছিলেন, “পদত্যাগ কি জিরো পয়েন্টে উড়িয়ে দেবে!” অনেকে মনে করেন, পরিস্থিতি বুঝে কৌশলগত পশ্চাদাপসরণের ইনবিল্ড অক্ষমতার কারণেই শাহ মোয়াজ্জমেন হোসেন জেলহত্যা মামলার আসামি হয়েছেন। একই কারণে দলীয় রাজনীতিতেও তেমন সুবিধা করতে পারেননি তিনি।

আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :