ঈদ আনন্দ নেই বন্যার্তদের

রফিকুল ইসলাম রফিক, রংপুর
 | প্রকাশিত : ৩১ আগস্ট ২০১৭, ১৯:৩৩

দ্বিতীয় দফা বন্যায় কৃষিভিত্তিক অঞ্চল বলে খ্যাত রংপুর অঞ্চলে বিধবস্ত মানুষের মুখে ঈদের হাসি নেই। হাসি কেড়ে নিয়েছে এবারের রাক্ষুসে বন্যা। তাই ঈদের আনন্দ নয়, ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধে নতুন করে কোমড় বেধে আবাদ লাগানোসহ বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় বিভিন্নজন দু’চার কেজি শুকনো খাবার আর দু-চারশ টাকা দিচ্ছে এতে কোন কোন পরিবারে একদিনের খাবার হচ্ছে না। তাই সাময়িক দিয়েই হাত গুটিয়ে থাকা নয়, ক্ষতিগ্রস্তদের আবার স্বপ্ন বাস্তবায়নে স্থায়ী সমাধানের জন্য অনুরোধ তাদের।

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের তথ্য কর্মকর্তা ও উদ্যান বিশেষজ্ঞ মো. ফয়েজ উদ্দিন বলেন, বন্যায় ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ হেক্টর আমন, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে। ফলে এই পরিবারগুলো এখন নতুন করে আবাদ লাগানোর চেষ্টা করছেন। তারা যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সে জন্য প্রয়োজনীয় সব চেষ্টা আমরা করছি। বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করা হচ্ছে নাভি জাতের চারা।

কৃষি বিভাগের মতে, কৃষকরা ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে এবার আমন আবাদে লক্ষমাত্রার চেয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন ধান কম উৎপাদন হবে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১ হাজার ২৩৬ কোটি ৬০ লাখ টাকার ওপরে।

অন্যদিকে, দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে মৎস চাষের দিকে ঝুঁকছিলেন রংপুর বিভাগের মানুষ। কিন্তু বন্যায় কৃষকের পাশাপাশি কোমড় ভেঙে গেছে শিক্ষিত তরুণসহ বিভিন্ন বয়সের উদ্যোক্তার। যারা দেশের বিভিন্ন বিশ্বিবিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে চাকরির পেছনে না ঘুরে চেষ্টা করেছেন ঘুরে দাঁড়াতে, চাকরি দিতে। কিন্তু চোখের সামনে সব ভেসে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে সব স্বপ্ন, সব আশা।

রংপুর মৎস বিভাগের উপ-পরিচালক রকিব উদ্দিন বিশ্বাস এর মতে, এবারের বন্যায় আট জেলায় ভেসে গেছে ৮৯ হাজার ৫৫৬টি পুকুর, দীঘি, খামার, বিলের পোনা ও মাছ। যার বাজার মূল্য ৩০০ কোটি টাকা। তাই ঈদ আনন্দ বা উৎসব নয় নতুন করে বাঁচার জন্য জীবিকা নির্বাহের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন তারা। হয়েছেন দিশেহারাও। তাদের দাবি সরকারের সহযোগিতা।

শুধু কী তাই? চরাঞ্চলের অনেক পরিবারেই এখনো দু বেলা খাবার জুটছে না। আবার যারা সরকারি এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে বিনামূল্যে গুরু ছাগল পেয়েছেন, অতি যত্মে লালন-পালন মোটা তাজা করেছেন দীর্ঘদিন থেকে। ঈদে বিক্রি করে ছেলে-মেয়ের আবদার মেটাবে কিন্তু বানের পানিতে ভেসে গেছে সেই আনন্দ টুকু। রক্ষা করতে পারেনি ওই সব শেষ সম্বলটুকু।

আবার যারা সাঁতরে এসব গরু-ছাগল রক্ষা করেছেন দাম কম হওয়ায় বিক্রি করতে পারেনি।

রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তর এর উপ-পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে ব্যক্তি পর্যায়ে ৫ লাখ ৬০ হাজার গরু এবং ২০৯টি খামারের ১ হাজার ২৫১টি গরু দ্বিতীয় দফার বন্যার কবলে পরেছে। এতে ২০ টন দানাদার খাবার, ৬ হাজার ২১ টন খড়, ৪ হাজার ৬২৪ টন ঘাস এবং ৩ হাজার ৬৫৯ টন চারন ভূমিও নষ্ট হয়।

বিভিন্ন গরুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, একদিকে বন্যা অন্যদিকে ভারত থেকে আসা গরুর কারণে বড় অংকের লোকসানের মুখে পড়েছেন রংপুর বিভাগের গরু খামারিরা। ফড়িয়া, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় পাইকাররাও তুলতে পারছেন না তাদের লগ্নি।

প্রাণিসম্পদ দপ্তর এর উপ-পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান এর দাবি, যে পরিমাণ গুরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে তাতে অর্ধলাখ গরু উদ্বৃত্ত থাকবে।

কুড়িগ্রামের কচাকাটা এলাকার চঞ্চল খান নামের এক ব্যক্তি তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে কষ্টগাঁথা কথাগুলো বলেছেন এভাবে- ‘বন্যা, নদী ভাঙন চির সাথী আমাদের। কোন কিছুতেই মন আর ভাঙে না এখন। নদীতে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাই, বানে ভাসতে ভাসতে রাস্তা কিংবা গাছে আটকাই। গা সওয়া হয়ে গেছে সব। এইতো বানের ক্ষত পার করলাম! আবার চলতে শুরু করেছি ভাঙ্গা সড়ক থামাতে পারেনি আমাদের। হাত লাগিয়েছে সবাই ..। হতাশ হয়নি বাড়ি হারানো রেললাইনের অজিফা। তুলেছে চার টিনের ছাপরা। পচে যাওয়া ধান ক্ষেতে সার ছিটাচ্ছে প্রান্তিক কৃষক কালু মিয়া, সেখান থেকেই আবার ক্ষেত ভরবে সবুজে। সাদা বালুতে তারা মিয়া ফলাবে তরমুজ। পলি পড়া মাঠে মরিচ হবে অফুরান স্বপ্ন দেখে কমলার বাবা। এক সের মাষকলাই ছিটাবে ভূপেন তাতেই জুটবে ছ মাসের খোরাক। পাথর ভাঙ্গার টুংটাং আওয়াজ বাঁচতে শেখায় বন্দর শ্রমিকদের! জাল নিয়ে নেমেছে মাঝি পাড়ার নগেন্দ্র খগেনেরা। আবার পথচলা নুতুন করে জেগে উঠা ... ভুলে গেছি সপ্তাহ আগের বানের তীব্রতা! আবার আনন্দ মিছিল হবে ছিটমহলে কোন না কোন উপলক্ষে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু চঞ্চলই না, রংপুর লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুরের অবস্থা একই। বিশেষ করে করুণদশা চরাঞ্চল এলাকায়। বন্যায় বিধ্বস্ত মানুষগুলো এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি।

রংপুরের চরাঞ্চল এলাকা লোহানী ইউনিয়নের বাসিন্দা মকবুল হোসেন ও তার স্ত্রী রহিমা খাতুন বলেন, ‘বন্যায় তো সব শ্যাষ। হামার কিসের ফির ঈদ। বাচপের পাওচোং না ফির ঈদ করমো হামরা।’ হামাক ট্যাকা পয়সা দেও, আবাদ করি চৈল পৈলোক খাওয়াই!!!।

রংপুরের ছাওলা এলাকার পঞ্চাশোর্ধ আব্দুল কুদ্দুস বলেন, বাহে বছর বছর তো বান আইসে এবারের মতন দেকি নাই। হামার এখন কিছু নাই। কি করি খামো সেই চিন্তায় আছি। বসি আচি কখন সরকার, এমপি নেম্বর চেয়ারম্যান হামাকগুলেক টেকা দিবে, কাম দিবে বা খাবার দিবে। ঈদ হামার এত্তি নাই।

জানা গেছে, একই অবস্থা দিনাজপুরেও। সেখানকার মানুষ কখনো এমন ভয়ংকর বন্যা দেখেনি। তাই তাদের ক্ষতির পরিমানটাও বেশি।

বানভাসি এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই ভেঙে পড়েছেন। আবার অনেকই আছেন সরকারের দিকে তাকিয়ে। তাদের দাবি সরকার সহযোগিতা করলে কষ্ট হলেও তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে সরকারের সে উদ্যোগ আছে। বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সহযোগিতা করা হবে।

(ঢাকাটাইমস/৩১আগস্ট/আরআই/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :