বানিয়ানগর থেকে লন্ডন

মোসলেহ উদ্দিন খোকন
 | প্রকাশিত : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:১২

‘স্রোতের শ্যাওলা যেমন ভাসে

তেমন করে ভাসলাম আমি

এই ভবের পরবাসে-’

স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জাব্বারের এ গানটি প্রায়ই আমার মনের গহিনে বেজে ওঠে। মনের অজান্তে প্রায়ই গেয়ে উঠি গানটি। কারণ আমি নিজেকেই আবিষ্কার করি এই গানের ভেতর দিয়ে। শিকড়হীন শ্যাওলার মতো সময়ের ঘূর্ণী ¯্রােতে ভাসতে ভাসতে এঘাট-ওঘাট হয়ে আজ ক্ষণিকের জন্য থমকে আছি পৃথিবীর অপর প্রান্তে, এক দ্বীপ রাষ্ট্র্রে। প্রতিনিয়ত এই আমাতে আশার প্রদ্বীপ জ্বেলে রাখি যদি কোনোদিন এই গোলাকার পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে নিজ ভূমে ফিরতে পারি!

১৯৯৬ সালের প্রথম দিনে পুরোনো বছরের সব দুঃখ-কষ্ট আর জরা-জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে সারা বিশ্বের মানুষ যখন নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে নব উদ্যমে পথচলা শুরু করল, ঠিক তখন এই আমি আপন শিকড় ছিন্ন করে অজানার পথে পা বাড়ালাম দিগন্তের ওপাড়ে আকাশটাকে ছোবো বলে ঘর থেকে সেই আমার বেরিয়ে পরা। কত দিন হয়ে গেল অথচ এখনো আমার আকাশ ছোঁয়া হয়নি।

কিন্তু এই জীবনে কত কিছু ছুঁয়ে গেছে আমাকে। বুকের ভেতর কত গল্প জমা হয়ে আছে! শুধু কি গল্প? আছে রাজ্যের গ্লানিও।

“নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে

ভিখারি তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি? -

কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ-সদনে।”

মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই অমর বাণী প্রতিটি প্রবাসীর মতো আমারও হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ বিদীর্ণ করে দেয় প্রতিনিয়ত। প্রথম বিশ্ব নামে খ্যাত ইউরোপের চাকচিক্য আর জৌলসের মাঝে থেকেও কেন যেন দীনহীন আর কপর্দকহীন মনে হয় নিজেকে। মাইকেল মধুসূদনের ভাষায়, প্রাণহীন-রসহীন- নিরানন্দ আমি এই আনন্দ-সদনে।।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৫ - রাতে বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত নব্বর্ষের আনন্দ উল্লাসে। আমি তখন থাকি পুরান ঢাকার বানিয়া নগর মসজিদের এক মেসে। পড়াশোনা করি জগন্নাথ কলেজে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এমএ ক্লাসে পড়ছি। সাথে থাকে আমার আরেক ছোট ভাই সিদ্দিক- সেও একই পাঠশালার ছাত্র। ইতিমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছে আমার মা, বড় ভাই আর বাল্যবন্ধু বাবর। বাবর একসময় এই রুমে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছিল। আমি থাকতাম দোতলার পূর্ব দিকের একটি রুমে। খাওয়া-দাওয়া করতাম তিনতলার একটি রুমে। গোজগাছ শেষ করে রাত ১০টার দিকে ওপরে গেলাম খাওয়া-দাওয়া করতে। খাওয়া-দাওয়া সেরে রুমে ফিরতেই বন্ধু বাবর হাত ধরে বাইরে টেনে নিয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল “একটা ঘটনা আছে” অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, কী ঘটনা? বাবর জানাল, পাসের জানালা থেকে দুটো মেয়ে তোকে রাত ১২টার আগে ঘুমাতে নিষেধ করেছে। প্রথমে নিতান্তই ফাজলামি ভেবে উড়িয়ে দিলাম। পরক্ষণে নিশ্চিত হয়ে হালকা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম ১২টা ১ মিনিটের জন্য।

এখানে বলে রাখা ভালো, আমি যেই মেসে থাকতাম সেখানে ছাত্রদের থাকার ব্যাপারে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমরা কয়েকজন মুরুব্বির রেফারেন্সে শর্ত সাপেক্ষে থাকার অনুমতি পেলাম। রুমে গান বাজানো নিষেধ ছিল, অপ্রয়োজনে জানালা খোলা নিষেধ ছিল। পাশের ফ্যামিলি বাসা থেকে কোনো ধরনের অভিযোগের ভয়ে বেশ সাবধানে থাকতে হতো। তাই নিয়মকানুন কড়াকড়িভাবে মেনে চলতাম। তারুণ্যের উৎসুক্য মন পাশের জানালায় মাঝে মাঝে দুটি মেয়ের অস্তিত্ব অনুভব করলেও রুম হারানোর ভয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ তৈরি করা বা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতাম। এমন একটি পরিস্থিতিতে এ ধরনের আমন্ত্রণ অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগল।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। ঠিক ১২টা ১ মিনিটে পাশের জানালায় খটমট আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। আমার জানালা থেকে ৩-৪ হাত দূরে অপর জানালা। ১৪-১৫ বছরের এক তরুণী ফুলের পাপড়ি ভরা ডালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে গড়গড় করে প্রায় মিনিট খানেক বক্তব্য দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে ডালা থেকে ফুলের পাপড়ি নিয়ে আমার শরীরে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণের বৃথা চেষ্টা চালাল। সেই পুষ্প আমার কপালে জোটেনি। কারণ আমার জানালাটিতে ছোট খোপের নেট লাগানো ছিল। সব ফুল ছড়িয়ে পড়ল নিচের রাস্তায়। তবুও মন যেন ভরে গেল এক অনাবিল আনন্দে। মেয়েটি আমাকে বারবার এমন ভাবে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকছিল, মনের ভেতর তার প্রতি এক আশ্চর্য স্নেহ অনুভব করলাম। তাকে পরের দিন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলতেই, পেছন থেকে অস্ফুট স্বরে ভেসে এলো “কালকে কখন ফ্লাইট”। ঠিক তখন লক্ষ করলাম মেয়েটির একটু পেছনে কিছুটা আবডালে দাঁড়িয়ে ১৭-১৮ বছরের এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চোখ রাখতেই মেয়েটি লজ্জা পেয়ে কিছুটা আড়ালে চলে গেল। জানা গেল তারা দুজন বোন, ছোটজন স্কুলে পড়ে বড়জন কলেজে পড়ে। বাবা একজন ব্যাংকার বিদেশে থাকেন। তাদের মায়ের সাথেও কথা বিনিময় হলো। জানালার নেট ফাঁক করে ওরা মিষ্টি দিল আমি মায়ের আনা ভাপা পিঠা তাদের দিলাম। পরের দিন ঠিক ১টা বাজে বাসা থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হব জানিয়ে বিদায় নিয়ে ঘুমাতে চলে গেলাম।

দুই. পরের দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ১৯৯৬ দুপুর ১টা সবেমাত্র জামা-কাপড় পরে রেডি হয়েছি, ঠিক তখনি পাশের জানালা খোলার শব্দ শুনে জানালার পাশে গিয়েই চমকে গেলাম। গতকালের অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা সেই মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আজ আর ততটা লাজুক নয়-মুখ ফুটে কথা বলছে আমার সাথে। টুকিটাকি অনেক কথা হলো। জানালার পাশে বসে চুপিচুপি আমার গান শুনত বলে জানাল সে। অতীতে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেও আমার সাড়া না পেয়ে আমাকে গম্ভীর আর অহংকারী ভাবত সে। কী করে বোঝাই গম্ভীর হতে বাধ্য ছিলাম আমি। জার্মান গিয়ে বড় কিছু হয়ে গেলে তাদের মনে রাখব কি না, বারবার প্রশ্ন করছিল। ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোনের যুগ তখনও শুরু হয়নি। তাই জার্মান এসে চিঠি লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলাম।

এয়ারপোর্টে রওনা হলাম। তখনও পাসপোর্ট ভিসা হাতে আসেনি ট্রাভেল এজেন্সির লোকজন এয়ারপোর্ট নিয়ে আসবে। কথা ছিল জার্মানের ভিসা থাকবে। কিন্তু পাসপোর্ট হাতে পেয়ে দেখি মস্কোর ভিসা। এজেন্সির লোকের সাথে এ বিষয়ে বাগ্্বিত-া হলো। ওরা জানাল মস্কো থেকে জার্মানির ভিসা নিতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইমিগ্রেশনের জন্য পা বাড়ালাম। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে রুশ বিমান আয়েরোফ্লট-এ গিয়ে উঠলাম। বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে ঢাকা থেকে মস্কোর উদ্দেশে বিমান আকাশে উড়াল দিল। ক্লান্ত শরীর সিটে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করলাম। চোখ বন্ধ করতেই চোখের পাতায় সহসা ভেসে উঠল কাল রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা সেই মুখ। মনের ভেতর বারবার বেজে চলছে, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে/আমারও দুয়ারো প্রান্তে/সে তো হায় মৃদু পায়/এসেছিল পারিনি তো জানতে।’

ততক্ষণে পৃথিবীর আকাশে ধেয়ে চলা মেঘমালা ছেদ করে বিমান উঠে গেছে অনেক ওপরে। বিমান ছুটে চলছে দুরন্ত গতিতে আমার মাতৃভূমি বাংলাকে পিছে ফেলে- যেখানে আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের হাজারো স্মৃতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। স্মৃতির জানালা খুলে গেল মুহূর্তেই। আমি হিরিয়ে গেলাম অতীতের মাঝে।

কোনো এক বিকালে মেসের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম সাদেক ভায়ের সাথে। হঠাৎ কেন জানি গান গাইতে ইচ্ছে করল। আমাদের এখানে গান গাওয়া বা শোনা নিষেধ। তাই খুব নিচু স্বরে জানালার পাশে বসে গান গাইতে শুরু করলাম- “আমায় এত দুঃখ দিলি বন্ধু রে বন্ধু, আমি তোর পিরিতেরই দেওয়ানারে দেওয়ানা”। হঠাৎ পাশের বাসার জানালা খোলার শব্দ শুনে ভয়ে মুছড়ে গেলাম। তাড়াহুড়া করে আমার জানালা বন্ধ করে দিয়ে ধুম ধরে বসে রইলাম। এক সপ্তাহ ধরে ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি মসজিদ কমিটি থেকে ডাক পড়ল -ইভটিজিংয়ের অভিযোগে। আজ মনে হচ্ছে সেদিন যদি জানালা বন্ধ না করে সাহস করে দাঁড়াতে পারতাম তবে আজকের লেখাটি হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। একেই বলে ভাগ্যের বিড়ম্বনা। আমি কট্টর অদৃষ্টবাদী নই। কিন্তু ভাগ্য যে কখনো কখনো মানুষকে কক্ষচ্যুত করে, তা বোধ হয় কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। একটি গল্প বলি -

এক লোক প্রতিদিন তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে স্রষ্টার কাছে একটি স্বর্ণের ইট পাওয়ার জন্য আবেদন করে যাচ্ছে। স্রষ্টা সুভাগ্যের ফেরেস্তাকে ডেকে বললেন “যাও অমুককে একটা স্বর্ণের ইট দিয়ে দাও”। ফেরেস্তা বলল, হে রাব্বুল আলামিন তার ভাগ্যে তো বড়লোক হওয়ার কথা লেখা নেই। স্রষ্টা বললেন, আমি তার দোয়া কবুল না করে পারছি না। ওই দেখ, সে একাকী নির্জন পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তুমি তার সামনে স্বর্ণের ইট রেখে আস আর দেখ সে কী করে। তার যদি ভাগ্যে না থাকে তবে সে তার নিজের দোষেই তা হারাবে। সুভাগ্যের ফেরেস্তা যথারীতি ওই লোকের চলার পথে রাস্তার মধ্যখানে এমন ভাবে স্বর্ণের ইট রেখে এলো যেন সে একটু এগোলেই স্বর্ণের ইটটা পেয়ে যায়। এরই মধ্যে ওই লোকের মাথায় একটি কুচিন্তা এসে ভর করল। সে ভাবল আচ্ছা, অন্ধরা কিভাবে হাঁটে? সে চোখ বন্ধ করে অন্ধের হাঁটা অনুকরণ করতে লাগল। ঠিক তখনি সে স্বর্ণের ইটটা ক্রস করে চলে গেল। তার ভাগ্যে আর স্বর্ণের ইট জুটল না।

নিয়তির নির্মম পরিহাস, মস্কোতে গিয়েই দালালের খপ্পরে পড়ে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। অনেকটা বন্দির মতো এ-শহর ও-শহর, এ-দেশ ও-দেশ ঘুরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে প্রায় এক বছর পর জার্মান গিয়ে মুক্তি পাই। তত দিনে অনেক কিছু পালটে গেছে। সেই স্বর্ণের ইটের মতো অনেকেই হারিয়ে গেছে অজানায়। খোঁজার চেষ্টা করেছি তাদের কিন্তু পাইনি। তত দিনে তারা নাকি বাসা চেঞ্জ করে অন্য কোথাও চলে গেছে। তারা হয়তো ভেবেছে আমি বড় কিছু হয়ে গেছি- আমি অন্য কিছু হয়ে গেছি। হ্যাঁ, আমি অন্য কিছু বনে গেছি- তত দিনে আমি ফুল বিক্রেতা বনে গেছি।

কী পেয়েছি? কী পাইনি? অতীতের সেই হিসেব-নিকেশ এখন আর মেলাতে যাই না। নিহা (মেয়ে)- নিঝুম (ছেলে) -নিলু (বউ)-কে নিয়ে ভালোই আছি। কিন্তু মাঝে মাঝে এই ভেবে কষ্ট পাই, কেউ হয়তো আমাকে ভুল বুঝে দাম্বিক ভেবে কষ্ট পেয়েছে।

তিন. মস্কো বিমানবন্দরে নেমে প্রথমেই এক ধাক্কা খেলাম। এয়ারপোর্টে প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা বসে আছি রিসিভ করার কেউ নেই। আমরা প্রায় ৮-১০ জন বঙ্গসন্তান। অবশেষে একজন এসে বলল, কোনো কথা বলবেন না শুধু আমাকে অনুসরণ করুন।

এ কথা শোনার পর আমরা যথারীতি তার পিছু পিছু গিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা হেঁটে উঠলাম এক অ্যাপার্টমেন্টে। এখানে এসে দেখা মিলল মূল দালালের সাথে, যিনি কিনা বাঙালি। তিনি আমার সাথে দুটি বড় বড় লাগেজ দেখে রাগত স্বরে আমাকে বললেন “আপনাকে কেউ বলেনি কোন জিনিসপত্র সাথে না আনতে?” আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে না পারার কারণ জানতে চাইলে তিনি আমাকে যা জানালেন তা শুনে আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যেভাবে এবং যে পথে আমাদের ইউরোপের পথে পাড়ি দিতে হবে স্রষ্টার দেওয়া প্রাণটি থাকবে কি না, তা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। দালালরা কিভাবে মিথ্যা বলে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, তা কিঞ্চিৎ অনুধাবন করলাম। সবাই মিলে কিছুক্ষণ কথাকাটাকাটি হলো। অবশেষে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হলো। সব মালামাল ফেলে রেখে ছোট একটি পলিথিনের ব্যাগে একটি শার্ট আর একটি প্যান্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হলাম।

সেখান থেকে সন্ধ্যার পর পাতাল রেলে করে ট্রেনস্টেশন। জীবনে প্রথমবারের মতো পাতাল রেলে চড়ার অভিজ্ঞতা। বলা হয়ে থাকে মস্কোর মাটির নিচে আরেকটি মস্কো আছে। জালের মতো ছড়ানো মস্কো মেট্রো বা পাতাল রেল। এসকেলেটর বা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে যখন মাটির নিচে ঢুকছি, তখন ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। মনে হলো কয়েক কিলোমিটার নিচে চলে গেলাম। দুরন্ত গতিতে ট্রাম এসে থামল, ভয়ে ভয়ে ট্রামে উঠে জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। জোড়ায় জোড়ায় যুবক-যুবতী বুড়া-বুড়ি একে অপরকে বগলদাবা করে এমন ভাবে বসে আছে, মনে হয় কেউ তাদের সাথিকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করতে পারে। পাশের সিটে বসে একজন আরেকজনের সাথে এত নিচু গলায় কথা বলছে যে অন্য কারো কোনো ডিস্টার্ব হচ্ছে না।

সেখান থেকে বের হয়ে আমরা গিয়ে উঠলাম দূরপাল্লার ট্রেনে। রাতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে তো চোখ ছানাবড়া। যে দিকেই তাকাই দিগন্তজুড়ে শুভ্র বরফের চাদরে ঢাকা। প্রথমবারের মতো বরফ ঢাকা পৃথিবীর দর্শন। আধাঘণ্টা-একঘণ্টা পর পর ছোট ছোট লোকালয় চোখে পড়ে। দু-একজন মানুষ মাঝা সমেত বরফের ওপর দিয়ে হাঁটছে। এরা কি আমাদের মতো মানুষ? না তুষার যুগের কোনো তুষারমানব। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এভাবে কোনো মানুষ বসবাস করতে পারে। ১৭-১৮ ঘণ্টা চলার পর ট্রেন এসে থামল আরেক শহরে। পরে জানলাম এটি বাইলোরাশিয়ার রাজধানী মিন্সক। এক বাসায় নিয়ে উঠানো হলো যেখানে আগে থেকেই আরো ২০-২৫ জন অপেক্ষা করছিল। সেখানে এক দিন থেকে পরের রাতে আবার নিরুদ্দেশে যাত্রা। এখান থেকে বাঙালি দালাল লাপাত্তা হয়ে গেল। আমাদের গালিভারের মতো দুজন রাশিয়ান যুবক বরফে আচ্ছাদিত জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ছোট্ট একটা ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দিল। সুবোধ বালকের মতো প্রায় ৩৫ জন যুবক হুড়মুড় করে দেড় টনি ট্রাকে উঠে একজনের গায়ের ওপর আরেক জন শুয়ে পড়লাম। মাইনাস ১০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৮-৯ ঘণ্টা চলার পর নতুন গন্তব্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হওয়া ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়ায় যখন পৌঁছলাম তখন ঠা-ায় হাত-পা জমাট বেঁধে অর্ধমৃত সবাই। যে বাসায় আমাদের উঠানো হলো সে বাসার মালিক প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধ ইভান। ইভানের সহযোগিতায় আগুনে ছেঁকে ২-৩ ঘণ্টা পর সবার হাত-পায়ের বোধ শক্তি ফিরে এলো। এখানে এসে আটকা পড়লাম প্রায় চার মাস। ছোট ছোট দুটি রুমে গাদাগাদি করে ৩৪ জন লোকের বসবাস। একসাথে ঘুমাতে পারতাম না। শিফট করে ঘুমাতে হতো। একদল ফ্লোরে চার ঘণ্টা ঘুমাতো বাকিরা চেয়ারে বসে ঝিমাতো। চার ঘণ্টা পর ঝিমানোর দল ফ্লোরে শুয়ে ঘুমানোর সুযোগ পেত। এক বেলার পরিমিত খাওয়ার (মটরশুঁটি আর চাল দিয়ে খিচুড়ি) দালালদের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হতো, যা ছিল সকাল বা বিকালের নাশতার সমপরিমাণ। বাকি বেলার খাওয়ার বৃদ্ধ ইভানকে দিয়ে নিজের পয়সার জোগাড় করতে হতো। কারণ বাইরে যাওয়ার কারো অনুমতি ছিল না। জঙ্গলের ভেতরে বরফ ঢাকা ছোট্ট টিলার ওপর নির্জন পরিত্যক্ত বাড়ি। গোসলখানা নেই এমনকি টয়লেটও নেই। চার মাসে মাত্র দুবার গোসল করার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাও প্রতিবার ৫ ডলারের বিনিময়ে। রাত ১২টার পর গাড়িতে করে লোকালয়হীন কোনো জায়গার একটি বিশেষ সুইমিংপুলে গোপনে নিয়ে যাওয়া হতো। কোনো কিছুতেই আপত্তি করার কোনো সুযোগই ছিল না। ভয়ে ভয়ে থাকতাম কখন কোন অজুহাতে কার ওপর চড়াও হয় ডাংকার বা দালালরা। এভাবে কয়েক মাস চলার পর সবার ডলার ফুরিয়ে গেল। এরপর শুরু হলো অর্ধাহারে কালাতিপাত করার দিন। গল্পগুজব করা তাস খেলা আর রাত গভীর হলে মনের দুঃখে গান গাওয়া, এভাবেই কাটল প্রায় চারটি মাস। অবশেষে একদিন সন্ধ্যায় ফরমান জারি হলো এক ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে প্রস্তুত হয়ে থাকতে। সবাই প্রস্তুত, দালালরা এসে চারজন করে বের করে নিয়ে গেল। সবাইকে জড় করা হলো শহরের উপকণ্ঠে সড়কের পাশে এক ছোট জঙ্গলে। কিছুক্ষণ পরে অন্ধকারে একটি বড় বাস এসে দাঁড়াল। দালালরা পাখির মতো করে আমাদের ছুড়ে মারল বাসের ভেতর। অনেকেই হাতে, পায়ে কিংবা মাথায় ব্যথা পেল। বাসের সিটের ফাঁকে পাটাতনে বসিয়ে দেওয়া হলো আমাদের। ঘণ্টা খানেক পরে বাস থামল। আবার একই কায়দায় আমাদের ছুড়ে ফেলা হলো বাস থেকে।

জায়গাটি লিথুয়ানিয়া আর পোলান্ড সীমান্তের কাছাকাছি একটি পাহাড়ি অঞ্চল। পেছন থেকে হুংকার এলো “দাবাই-দাবাই” মানে দৌড়াও। এ শব্দটি ছাড়া তাদের আর কোনো ভাষাই বুঝতাম না। অবশ্য মাঝে মাঝে রাজা নামক একজনের মাধ্যমে বিশেষ নির্দেশনা পেতাম। রাজা প্রায় দুই বছর মস্কোতে বসবাস করার সুবাদে রুশ ভাষা কিছুটা বুঝতে পারত। শুরু হলো দৌড় প্রতিযোগিতা। আস্তে হাঁটলে বা পিছে পড়ে গেলে ডাংকারদের (রাশিয়ান দালাল) লাথি খেয়ে দৌড়ের স্পিড আরো বেড়ে যেত। এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে প্রায় চার ঘণ্টা পর একটি কাঁটাতারের বেড়ার কাছে এলে ১০ মিনিট রেস্ট দেওয়া হলো। আমাদের বলা হলো এটি সীমান্ত বেড়া- বিদ্যুৎ থাকতে পারে। তাই কাঁটাতারের বেড়ার নিচ দিয়ে মোটা পানি সরার পাইপের ভেতর দিয়ে ওপারে অর্থাৎ পোলান্ড ঢুকতে হবে। দালালদের একজন প্রথমে পাইপ দিয়ে ওপারে চলে গেল। তারপর আমাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হলো পাইপের ভেতরে। প্রথমে কামাল নামে ১৮-১৯ বছরের এক বালক তার পর আমি পেছনে পেছনে অন্যরা। আমার সামনের ছেলেটিকে মাথা দিয়ে অনেকটা ধাক্কাতে ধাক্কাতে পার করতে হলো। পাইপ থেকে থেকে বের হয়ে যেই নিঃশ্বাস ফেলতে যাব তখনি কামাল নামক ১৮-১৯ বছরের দাঁড়ানো থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল- ভয়ে সেন্সলেস হয়ে গেল। ১০-১৫ মিনিট পরে তার সেন্স ফিরে এলো। তার পর শুরু হলো আবার ছুটে চলা। আমরা যতই ক্লান্ত হতে লাগলাম দৌড়ের গতি ততই কমতে লাগল আর ততই ডাংকারদের দাবাই-দাবাই বলে হুংকার বাড়তে লাগল। কারণ ভোর হওয়ার আগেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। ছোট ছোট পাহাড় ডিঙাতে ডিঙাতে অনেকেই চলনশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলল। লক্ষ্মীপুরের কবির আর সোনাইমুড়ির শাহাদাত বাবর টিলার পাদদেশে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। আমিও আর চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি প্রায়। দুজনকে দুই বাহুতে ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম। অন্যরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। আমাদের না পেয়ে দালালরা পেছনে ফিরে এসে আধা ঘণ্টা পরে আমাদের উদ্ধার করল। ততক্ষণে সূর্য উঠে উঠে। এখানে এসে নতুন দালাল পেলাম। এদের ব্যবহারও তুলনামূলক ভালো এবং থাকার জায়গাটাও মোটামুটি ভালো। যদিও কোনো গুদামঘর।

বিছানায় সবাই এলিয়ে পড়ল, কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে। জেগে দেখি আরেক রাত-অনুমান করলাম ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা কেটে গেছে এক ঘুমেই। সবাই তখন উজ্জীবিত, স্বপনের কাছাকাছি এসে গেছি বলে। চোখে মুখে সবার আনন্দ। আর মাত্র এক দিন পরেই স্বপনের জার্মান। কিন্তু বিধি বাম।

চার. পরদিন সন্ধ্যায় আমাদের প্রস্তুত হতে বলা হলো। নিয়ে যাওয়া হবে জার্মান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বার্লিনে। চারজন চারজন করে ট্যাক্সিতে করে রওনা হলাম জার্মানের পথে। আমি ছিলাম সর্বশেষ ট্যাক্সিতে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না। ঘুম ভাঙল হঠাৎ প্রচ- এক ঝাঁকুনিতে। হতচকিত হয়ে চোখ খুলতেই দেখলাম, পিস্তল উঁচিয়ে গাড়ির দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুলিশ। ড্রাইভার কখন যে লাপাত্তা হলো টেরই পেলাম না। হাত তুলে গাড়ি থেকে বের হয়েই শিহরে উঠলাম। আর মাত্র এক হাত সামনে গেলেই বিরাট খাদে পড়ে চূর্ণবিচূর্র্ণ হয়ে যেতাম। প্রাণে রক্ষা পেয়ে মনে মনে স্রষ্টার কাছে শোকর আদায় করলাম। আমাদের নিয়ে আসা হলো পোলান্ডের রাজধানী ওয়ার্সার একটি থানায়।

থানায় গিয়ে দেখলাম একে একে আমাদের সাথের সবাইকে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমাদের গায়ের রং দেখে ওরা ভাবল আমরা ভারতীয়। এক ভদ্রলোক এসে আমাদের হিন্দিতে বহু কিছু বোঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু আমরা কোনো সাড়া দিলাম না। কারণ আমরা তখনো বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমাদের কী করা উচিত। অবশেষে ওয়ার্সা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাংলার অধ্যাপককে (পোলিশ নারী) নিয়ে আসা হলো। আমরা তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলাম। আমরা আশ্রয় পেলাম ওয়ার্সার উপকণ্ঠে এক রাজনৈতিক আশ্রয় শিবিরে। তখনও আমরা সারা বিশ্ব থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

আশ্রয়শিবিরে আমাদের রুমের সামনের রুমেই থাকত রাশিয়ান এক শিল্পী দম্পতি। একদিন সকালে তারা এসে আমাকে বলল, তোমাদের দেশে খুব গ-গোল হচ্ছে। আর্মি ট্যাংক নিয়ে রাস্তায় ঘুরছে। তারা আমাকে ওয়ার্সা শহরে নিয়ে গিয়ে পোলান্ডে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করে দিল। এই প্রথম কোনো শহরে মুক্তভাবে ঘোরার এবং কারো সাথে কথা বলার সুযোগ পেলাম। বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে ফোন করে বাংলাদেশের অবস্থা জানতে চাইলে এক ভদ্রলোক জানালেন যে বাংলাদেশে কী হচ্ছে তারা নিজেরাই অবগত নয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলেন আপনি কোথায় ছিলেন এত দিন? খালেদা জিয়া তো অনেক আগেই পদত্যগ করেছেন। লজ্জিত হয়ে তাকে দুরবস্থার কথা জানালাম। দু-এক দিন পরে ফোন করলে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা জানাতে পারবেন বলে জানালেন। এদিকে আমরা পড়লাম মহাচিন্তায়। আমরা সবাই না জেনে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছি। যেহেতু বিএনপি সরকার ক্ষমতায় নেই সেহেতু আমাদের ডিপোর্ট করার সমূহ সম্ভাবনা। তাড়াতাড়ি পোলান্ড ছাড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। দেশে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলাম। আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানালাম। ভাগ্য ভালো, পুরোনো দালালরা এক সপ্তাহের মধ্যে যোগাযোগ করল। একদিন সকালে দালালদের পরামর্শে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে দুজন দুজন করে বের হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ ট্রেনে, কিছুক্ষণ ট্যাক্সিতে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে আবার কয়েক ঘণ্টা লরিতে করে অবশেষে অবতরণ করলাম জার্মানির বার্লিন শহরের উপকণ্ঠে এক জঙ্গলে।

পাঁচ. জার্মানিতে এলেই প্রথমে বসবাসের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে হয়। তার পর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আশ্রয়প্রার্থীকে নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে এলাকায় পুস্টিং হয়, বিশেষ অনুমতি ছাড়া সে এলাকার বাইরে যেতে পারে না কোনো আশ্রয়প্রার্থী। নির্ধারিত এলাকাতেই কাজ করার অনুমতি প্রাপ্ত হয়। সুভাগ্যবশত বড় কোনো শহরে পুস্টিং হলে ভালো কাজকর্ম জোগাড় করা যায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে গ্রামাঞ্চলে পুস্টিং পেয়ে সরকারি খরচে খেয়ে দেয়ে ক্যাম্পে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটাতে হয়। তাদের জন্য আয়-রোজগারের একমাত্র পথ খোলা থাকে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্য কোনো শহরে গিয়ে অবৈধভাবে ছোটখাটো ব্যবসা করা। ধরা পড়লে এক-দুই দিনের হাজত খেটে আর্থিক জরিমানার নোটিশ হাতে নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরতে হয়। সুভাগ্য সাথি হয়নি আমার।

বার্লিনে যে বাসায় প্রথম গিয়ে উঠলাম, বাসার মালিকের রূঢ় ব্যবহারে খুবই মর্মাহত হলাম। পরের দিন অফিস খোলার আগেই ভদ্রলোক আমাদের ইমিগ্রেশন অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। এক ঘণ্টা পর অফিস খুললে যথারীতি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করলাম। বার্লিন থেকে প্রথমে ড্রেসডেন তার পর বাউটজসেন নামক এক অজপাড়ায় পুস্টিং হলো আমার। সেখানে কয়েক সপ্তাহ থেকে অবশেষে হেনোভারে আশ্রয় নিলাম এক বড় ভাইয়ের কেয়ার-অব-এ। জার্মানের পুলিশ খুবই চৌকস। ওদের চোখে ফাঁকি দেওয়া প্রায়ই অসম্ভব। এক বছরে ৯ বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলাম। অতিষ্ঠ হয়ে ইতালি পাড়ি জমাতে মনস্থির করলাম। জার্মানিতে দুই পদ্ধতিতে বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ পাওয়া যায়। প্রথমত, রাজনৈতিক আশ্রয়। বাংলাদেশিরা রাজনৈতিক আশ্রয় পায় না বললেই চলে। দ্বিতীয়ত, বিয়ে করে। এ বিষয়ে মন সায় দিচ্ছিল না বলে ৯৮-এর মার্চ মাসে চলে এলাম ইতালির রোমে।

ইউরোপের মধ্যে ইতালিকে ইমিগ্রেন্টদের স্বগরাজ্য বলা চলে। হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসী এখানে বসবাস করে। পুলিশ ধরলেও মানবিক কারণে কাউকেই দেশে পাঠায় না। কয়েক বছর পর পর শর্তসাপেক্ষে অবৈধদের বৈধ করে নেওয়া হয়। কিন্তু জব মার্কেট এতটা সুপ্রশস্ত নয়। হাজার হাজার অভিবাসী বেকার। ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবন ধারণ করে- বিশেষ করে যারা নবাগত এবং যাদের স্টে-পারমিট হয়নি এখনো। তাছাড়া রয়েছে ভাষাগত সমস্যা। ইংরেজি একদমই চলে না। ভাষা শিখতে শিখতেই ২-৩ বছর চলে যায়-তাই প্রথম প্রথম সবাকেই ছোটখাটো ব্যবসা করেই জীবন ধারণ করতে হয়। অবশ্য পুরোনোদের কেউ কেউ ইচ্ছে করেই এসব ব্যবসা করে। সামার মৌসুমে সাগর পাড়ে গিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে সারা বছরের আয় করে নেয়, বাকি সময় কোনোমতে চালিয়ে যায়। বাংলাদেশি প্রবাসীদের বিরাট একটা অংশ রেস্টুরেন্টে কাজ করে- মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা যা আয় করে শ্রমের তুলনায় তা অতি নগণ্যই বলা চলে। আরেকটি অংশ যারা বিভিন্ন কল-কারখানায় কাজ করে তারা মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে। আরেকটি ক্ষুদ্র অংশ যারা স্থায়ী ব্যবসা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, বলা যেতে পারে তারা বেশ ভালোই আছে।

ছোট ব্যবসা দিয়েই ইতালির জীবন শুরু। অতঃপর ভ্রাম্যমাণ দোকানে চাকরি। তারপর টেলিফোন-ইন্টারনেটের স্থায়ী ব্যবসার ব্যর্থ চেষ্টা। ব্যর্থ হয়ে রোম ছেড়ে মিলানোতে হিজরত। মিলানো এসে ‘টাউনহাউস’ হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে কয়েক বছর চাকরি তার পর আবার রেস্টুরেন্ট ব্যবসার ব্যর্থতার গ্লানি। এ গ্লানির শুরু ঢাকা থেকে যাত্রার পর থেকেই। আমি গ্লানিকে ছেড়ে থাকতে চাইলেও সে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রাখে। হায়রে জীবন!

ছয়. প্রবাসজীবনের অনেকটা সময় পার করেছি ইতালিতে। জীবন সংগ্রাম কাকে বলে ইতালিপ্রবাসী বাঙালিরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে। ছোট ব্যবসা আর রেস্টুরেন্টে যারা কাজ করে তারা ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ করে উপার্জিত অর্থ পরিবারের জন্য ব্যয় করে। ইতালিতে বাংলাদেশিদের বসবাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৯০ সালের পর থেকেই ব্যাপক হারে বসবাস শুরু হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দীর্ঘ ১৮-২০ বছর পরিশ্রম করে বাংলাদেশি প্রবাসীদের একটা অংশ মোটামুটি ভালো অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে অর্থনৈতিক মন্দায় সবার সাজানো জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। তার ওপর ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যাওয়াতে ধর্মীয়, বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার কথা মাথায় রেখে আবার অনেকের মতো আমিও পাড়ি জমাই ব্রিটেনে। এখানে এসে আবার জীবন সংগ্রামে উপনীত হতে হয় নতুন আঙ্গিকে। ব্রিটেনের বৈরী আবহাওয়া সাথে যোগ হয় পুরোনোদের বৈরী মানসিকতা, তার ওপর ব্রেক্সিটের ধাক্কা। সব মিলিয়ে ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলে অনিশ্চিত গন্তব্যের যাযাবর আমরা। এই দুরন্ত যাযাবর জীবনের প্রাণান্ত সংগ্রাম কত দিন চলবে কে জানে?

ব্রিটেনে বাঙালিদের বসবাস বহু দিনের। কারো কারো তিন জেনারেশন হয়ে গেছে এখানে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের মানুষের প্রাধান্য এখানে। রেস্টুরেন্টের কিচেন থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপদে, রাজনীতিতে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে, সব জায়গাতেই রয়েছে তাদের সাবলীল পদচারণ। অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও এখন মোটামুটি তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে। বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বাঙালিরা চালকের আসনে অধিষ্ঠিত। খুব প্রকট না হলেও ভেতরে ভেতরে আঞ্চলিক ইজম বেশ সক্রিয় এখানে। ইউরোপ থেকে আগত বাঙালিদের প্রতিও কারো কারো বৈরী মনভাব লক্ষ করা যায়। রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের প্রভাব। সব মিলিয়ে আমরা এখনও একক বাংলাদেশি বা বাঙালি হয়ে উঠতে পারিনি শতভাগ। আরেকটি শঙ্কার বিষয়, নতুন প্রজন্মের একটি বিরাট অংশের বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ প্রায় শূন্যের কোঠায়।

ব্রিটিশদের কেন ব্রিটিশ বলা হয় আমি জানি না। আমরা অনেক সময় বলে থাকি এই বেটা একটা ব্রিটিশ। আমার কেন জানি মনে হয় ব্রিটিশরা সব কিছু একটু জটিল করে ভাবতে ভালোবাসে। ইউরোপিয়ান অন্যান্য জাতির চেয়ে ওদের ভাবনা বেশ জটিল। ইদানীং ‘ব্রেক্সিট’ তাদের জটিল ভাবনারই একটি ফসল। ব্রেক্সিটের কারণে ইউরোপ থেকে আগত ইমিগ্রেন্টরা নতুন সমস্যার মুখোমুখি। তাদের ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেল। বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে শঙ্কিত সবাই। যদিও ইউকে সরকার, যারা ২৯ মার্চ ২০১৭-এর আগে এসেছে তাদের অভয় দিচ্ছে তবুও সবাই নিশ্চিত হতে পারছে না শতভাগ। কারণ ব্রেক্সিট ডিল আলোচনায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে নতুন কোনো সমস্যা তৈরি, এ বিষয়ে শঙ্কামুক্ত হতে পারছে না কেউই।

কত সভ্যতার সাথে পরিচিত হলাম। কত সংস্কৃতির সাথে বিলীন হতে চাইলাম- ডয়েচ কালচর, রোমান কালচার, ইংলিশ কালচার। কিন্তু পারিনি। হৃদয়ের গভীরে লুকায়িত কোনো এক সংস্কার সব কিছু এলোমেলো করে দেয়। বৈশাখ এলে মনটা কেন যেন পান্তা আর ইলিশের জন্য হাহাকার করে ওঠে। ফেব্রুয়ারি এলে বরকত-জব্বারেরা মানস পটে এসে কড়া নাড়ে। মার্চে কেন জানি ঘৃণায় আর ক্ষোভে মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ডিসেম্বরে বুকটা গর্বে ফোলে থাকে অকারণে।

৪০টি ঈদ কেটে গেছে বিদেশবিভূঁইয়ে মা-ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়স্বজন ছাড়া। ঈদ কিভাবে এলো কিভাবে গেল কাজের চাপে খবরই থাকত না। কয়েক বছর থেকে স্ত্রী-সন্তান কাছে আছে বলে ঈদটা জানান দিয়ে যায় শুধু তাদের জন্য। গভীর রাতে কাজ থেকে ফিরে খাওয়ার টেবিলে রকমারি রান্না দেখে মনে পড়ে “আজ বোধ হয় ঈদ ছিল”। ভাগ্যিস বৌ-বাচ্চা ঈদের শপিংয়ের বায়না ধরে না তাহলে ভুলেই যেতাম ঈদ বলে কিছু আছে। এই আমাদের প্রবাসজীবন- এই আমাদের সুখের জীবন। আপন স্বদেশ ছেড়ে নির্বোধ আমরা সুখ খুঁজি অসুখের মাঝে। আজ জীবনের এই প্রান্তে এসে খুব করে মনে পড়ে মধুসূদন দত্তকে,

‘নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন /

অগণ্য; তা সবে আমি অবহেলা করি /

অর্থলোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ /

বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী /

কাটাইনু কতকাল সুখ পরিহরি।’

‘৯৬ থেকে ২০১৭। জীবনের দীর্ঘ এই স্বর্ণালি সময় কাটিয়ে দিলাম পরবাসে। ঢাকার বানিয়ানগর থেকে জার্মানির হেনোভার, হেনোভার থেকে ইতালির রোম-মিলান হয়ে অবশেষে লন্ডন।

এক জীবনে আর কত রকমভাবে আমাকে, আমার কাছের মানুষদের নিয়ে এক গন্তব্য থেকে আরেক গন্তব্যে ছুটে বেড়াতে হবে, সেটা আমি নিজেও জানি না।

তবে এত দিনে এতটুকু অন্তত আমার বেশ জানা হয়ে গেছে পরবর্তী কোনো না কোনো গন্তব্য আমার অজান্তে আমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

আমি তার শিকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :