বন্যপ্রাণীর সান্নিধ্যে নিন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা

ফয়সাল আহমেদ, শ্রীপুর (গাজীপুর)
| আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৯:২৪ | প্রকাশিত : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৯:২১

বিশাল অরণ্য, আপনি বের হয়েছেন প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভের আশায়। হঠাৎ ক্ষুধার্থ হিংস্র বাঘ বা সিংহ আছড়ে পড়লো আপনাকে শিকারের আশায়। কিন্তু বিধিবাম, কাচে ঘেরার কারণে দুই ইঞ্চির জন্য আপনাকে গ্রাস করতে পারল না। আপনি তো ভয়ে অজ্ঞান। এমন সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আপনাকে পাইয়ে দেয়ার লক্ষে থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কটির ধারণা অন্যান্য কিছু হতে ভিন্ন। অন্যান্য জায়গায় জীবজন্তু আবদ্ধ অবস্থায় থাকে আর দর্শনার্থী উন্মুক্ত অবস্থায় ঘুরে ঘুরে আনন্দ উপভোগ করেন। আর এখানে জীবজন্তু উন্মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করে আর দর্শনার্থীরা কাচে ঘেরা গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে আনন্দ উপভোগ করেন।

সাফারি পার্কের বন্য প্রাণী পরিদর্শক আনিসুর রহমান জানান, সাফারি পার্কে এখন সবধরনের জীবজন্তু রয়েছে। নতুন অনেক প্রাণীরও জন্মের মাধ্যমে আনন্দে ভিন্ন মাত্রা পাবে দর্শনার্থীরা।

সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক মো. শাহাবউদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রকৃতির বিচিত্র সাজে সজ্জিত আমাদের এই বাংলাদেশ। দেশের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপার সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার দেশের কোটি প্রাণের মৌল মানবিক চাহিদা চিত্তবিনোদনের অভাব দূর করার জন্য নির্মাণ করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্ক। রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় ব্যস্ত মানুষের বিনোদনের খোরাক যোগাতে পারে এ সাফারি পার্ক।’

তত্ত্বাবধায়ক জানান, চলতি ইদুল আজহাকে সামনে রেখে নতুনভাবে সজ্জিত করা হয়েছে পার্কটি। আশা করা হচ্ছে এই ঈদে প্রচুর লোক সমাগম হবে।

গাজীপুরের শালবন ঐতিহাসিকভাবে ভাওয়াল বাজার জমিদারির অংশ হিসেবে খ্যাত ছিল। ১৯৫০ সালের জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইন জারির পর শাল বনের ব্যবস্থাপনা বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে অধিকাংশ চালা জমি শালবন সমৃদ্ধ বনভূমি বিধায় বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বাইদ জমিসমূহ ব্যক্তি মালিকনাধীন। শালবন ঢাকার অতি কাছে হওয়ায় দ্রুত শিল্পায়ন, জবরদখল, গো-চারণ ও ভূমিদস্যুতার কারণে শালবনের জীববৈচিত্র্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। শিল্পকারখানা হতে নিঃস্বরিত বর্জ্যরে কারণে জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন ও বন্যপ্রাণীকে ভালোবাসতেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকার অতি কাছে প্রাকৃতিক পরিবেশে পর্যটন শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে চম্পা বন বিশ্রামাগার নির্মাণের নির্দেশনা দেন এবং ব্যক্তিগত তহবিল হতে চেক প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের রাথুরা মৌজা ও সদর উপজেলার পিরুজালী ইউনিয়নের পিরুজালী মৌজার ৩৬৯০ একর এলাকাকে সাফারি পার্কের মাষ্টার প্লানের অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পটি ২০১০ সালে ৬৩.৯৯ কোটি টাকা প্রকল্পিত ব্যায়ে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক এর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১১ সালে প্রকল্পটি (১ম সংশোধিত) একনেক কর্তৃক বর্ধিত আকারে ২১৯.৮৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে অনুমোদিত হয়।

শালবনের বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বাংলাদেশের বিরল ও বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণীকে নিজ আবাসস্থলে এবং আবাসস্থলের বাহিরে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সাধন, রাজধানীর অতি কাছে ইকো-ট্যুরিজমের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশ, দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাসহ সারাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাঘের বাজার হতে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে সাফারি পার্কটির অবস্থান। সাফারি পার্কের আয়তন ৩৬৯০ একর।

সাফারি পার্কের দর্শনীয় এরিয়া

কোর সাফারি পার্ক: কোর সাফারি পার্কে গাড়ি ছাড়া কোনো পর্যটক প্রবেশ করতে পারবে না। তবে বন্য প্রাণী বিচরণরত অবস্থায় পর্যটকরা গাড়িতে চড়ে দেখবেন। কোর সাফারি পার্ক ১২১৭ একর এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০ একরে বাঘ সাফারি, ২১ একরে সিংহ সাফারি, ৮.৫ একরে ভাল্লুক, আট একরে আফ্রিকান চিতা, ৮১ একরে চিত্রা হরিণ, ৮০ একরে সাম্বার ও গয়াল, ১০৫ একরে হাতি, ৩৫ একরে জলহস্তি, ৩০ একরে মায়া ও প্যারা হরিণ, ২৫ একরে নীলগার ১৬৪ একরে পাখীদ্বিপ, ৪০৭ একরে বন্যমহিষ। কোর সাফারি পার্কে পর্যটকদের পরিভ্রমণের জন্য দুটি মিনিবাস ও দুটি সাফারি জিপ রয়েছে।

সাফারি কিংডম: সাফারি কিংডমে পর্যটকরা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান এবং প্রাণীকূল বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ থাকে। সাফারি কিংডমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর নৈপুণ্য ও খেলাধুলা প্রদর্শনের মাধ্যমে পর্যটকদের চিত্তবিনোদন, বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা। সাফারি কিংডম ৫৫৬ একর এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সাফারি কিংডমের দর্শনীয় হচ্ছে পাহাড় গেট, প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র ছোট জাতের পাখিশালা, অ্যাকুরিয়াম, ফেন্সিকার্ড গার্ডেন, ফেন্সিডাক গার্ডেন, জিরাপ ফিডিং স্পট, ধনেশ এভিয়ারি, প্যারট এভিয়ারিসহ দেশি-বিদেশি পাখিশালা, কুমির পার্ক অর্কিড হাউস, প্রজাপতি বাগান, শকুন ওপেচা কর্নার, এগ ওয়ার্ল্ড, কচ্ছপ ব্রিডিংসেন্টার, লামচিতা হাউজ, ক্যাঙ্গারু বাগান, হাতীশো গ্যালারি, সর্প পার্ক, লিজার্ড পার্ক, ফুড কোর্ট, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও জলাধার।

বায়োডাইভার সিটি পার্ক: বিরল বিলুপ্তপ্রায় দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির গাছের জীন সংরক্ষণ করার উদ্দ্যেশ্যে নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে বায়োডাইভার সিটি পার্ক। এর এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮২০ একর।

এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক: এই পার্কে সকল এশীয় তৃণভোজী এবং ছোট মাংসাশী প্রাণী পাখি, সরিসৃপ ও উভচর প্রাণি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে পার্কের পশ্চিমাংসে নির্মাণ করা হয়েছে জলাধার রয়েছে অতিথি পাখির আবাসস্থল। এই পার্কের এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৬৯ একর।

বঙ্গবন্ধু স্কয়ার: পার্কের প্রবেশ পথে পার্কটির এলাকা বিনোদন উদ্যান ও প্রশাসনিক কাজে ৩৮ একর এলাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রধান ফটকের সামনে রয়েছে বিশাল পার্কিং এরিয়া। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে আকর্ষণীয় মুরাল ও মডেলসহ প্রধান ফটক, ফোয়ারা, জলাধার, ও লেক, তথ্য কেন্দ্র, পার্ক অফিস, ডরমেটরি, বিশ্রামাগার, ইকোরিসোর্ট ডিসপ্লে ম্যাপ, আর সিসি বেঞ্চ ও ছাতা।

প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র: এই কেন্দ্রে বাংলাদেশের প্রায় সব ধরনের বনাঞ্চলের গাছপালা ও বন্যপ্রাণীর মডেল, মুরাল ও স্ট্যাফিং তৈরি করে আলো ও শব্দধ্বনি প্রবাহের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও বনাঞ্চল সম্পকেৃ দর্শকদেরকে সম্ম্যক ধারণা প্রদান করা হয়। প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্রে প্রায় ৯৮০ ধরণের বন্যপ্রাণী ও অসংখ্য গাছ-পালার মডেল মুরাল তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ১২ মিনিটের দীর্ঘ একটি স্বব্যখ্যায়িত অডিও ভিস্যুয়াল প্রোগ্রামের মাধ্যমে দর্শকগণ আনন্দ লাভ করবে।

ন্যাচার হিস্ট্রি মিউজিয়াম: এখানে প্রায় ২০০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীরদেহাবশেষ, নমুনা ও স্ট্যফিং সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। এতে পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষকবৃন্দ বিপদাপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ করতে পারবেন।

পাখিশালা: সাফারি পার্কের পশ্চিমাংসে নির্মাণ করা হয়েছে আলাদা আলাদা ভাবে বিশাল তিনটি পাখিশালা। এতে প্যারট, ফিজেই ও ধনেশ পাখি অবমুক্ত করা হবে।

ফেন্সিডাক ও কার্প গার্ডেন: সাফারি পার্কে মাঝে বৃত্তাকারলেকটিকে কেন্দ্র করে বিচিত্র ধরনের দেশি বিদেশি সোয়ান ও ডাক অবমুক্ত করা হয়েছে। দক্ষিণ পূর্বাংশে বিচিত্র রঙিন মাছ অবমুক্ত করে কার্প গার্ডেন স্থাপন করা হয়েছে।

বাঘ ও সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ: বাঘ ও সিংহ বেষ্টনীর দক্ষিণাংশে প্রতিরক্ষা দেয়াল ঘেঁষে রেস্তোরাঁয় বসে অনায়াশে বাঘ দেখার জন্য বাঘ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ ও সিংহ দেখার জন্য সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা হয়েছে। এতে রয়েছে খাবার দাবারের সু-ব্যবস্থা।

পর্যবেক্ষণ টাওয়ার: পার্কের ভেতর অনায়াশে বিভিন্ন বেষ্টনীতে বিচরণরত বাঘ, সিংহ, হাতি, জেব্রা জিরাফ ও হরিণ ইত্যাদি বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ করার জন্য টাওয়ার নিমৃাণ করা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/০৩সেপ্টেম্বর/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :