ফিনিক্স গাছ

ইনাম আল হক
 | প্রকাশিত : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৯

ফিনিক্স-পাখির গল্প সবাই শুনেছি; কিন্তু ফিনিক্স-গাছের কথা আমরা কমই শুনতে পাই। ফিনিক্স-পাখিরা আগুনে আত্মাহুতি দিয়ে ছাই থেকে পুনর্জন্ম নেয়। মজার ব্যাপার হলো, কোনো কোনো গাছও তা করে থাকে! তবে ফিনিক্স-গাছ আর ফিনিক্স-পাখির মধ্যে পার্থক্য আছে। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, পৃথিবীতে সত্যিই ফিনিক্স-গাছ আছে; কিন্তু ফিনিক্স-পাখি মানুষের কল্পনামাত্র। একেবারে ছেলেমানুষ ছাড়া সবাই জানে, ভষ্ম থেকে কোনো পাখির পুনর্জন্ম সম্ভব নয়। তবে গাছের বেলায়ও কি তা বলা যায়! উদ্ভিদের পুনর্জন্ম নেওয়ার ক্ষমতা ও প্রক্রিয়া আমাদের বিশ্বাসের গণ্ডিছাড়িয়ে বহু দূর যায়।

‘গ্যাসগাছ’ নামের একটি উদ্ভিদকে বিশের প্রথম সারির ফিনিক্স-গাছের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডিকটামনাস অ্যালবাস । মধ্যপ্রাচ্যের মরূদ্যানে জন্মায় এ গাছ; তিন ফুটের বেশি বড় হয় না। গাছের চূড়ায় পিরামিডের মতো চমৎকার ফুলের ছড়া হয়। হালকা বেগুনি রেখা-টানা সুন্দর সাদা ফুল। ফুল ফুটলে মনোরম লেবুর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সে গন্ধের উৎস হলো উদ্বায়ী এক গ্যাস। ফুলের পাপড়ি থেকে নিরন্তর নির্গত হয় এ গ্যাস। খুব সহজেই আগুন ধরে এই গ্যাসে। কাছাকাছি একটা লাইটার জ্বালালে দপ করে জ্বলে ওঠে ফুলের পিরামিড। চুলার গ্যাসের মতো দাউ-দাউ করে কিছুক্ষণ জ্বলে আগুন নিবে যায়। আগুন নিবলে দেখা যায়, ফুলের পিরামিড সম্পূর্ণ অক্ষত আছে। কিছু সময় দম নেওয়ার পর এ ফুল আবার লেবুর গন্ধ ছড়াতে থাকে। আগুন কাছে নিলে আবার দপ করে জ্বলে ওঠে।

পরাগায়ণের পর গ্যাসগাছের ফুল থেকে ফল হয় এবং পাপড়িগুলো মাটিতে ঝরে পড়ে। মাটিতে ছড়ানো পাপড়ির শুকনো স্তূপ থেকেও উদ্বায়ী গ্যাস উঠতে থাকে। দুপুরের দাবদাহে একদিন সে স্তুপে আগুন ধরে যায়। গ্যাসগাছসহ সে এলাকার সব গাছপালা পুড়ে ছাই হয়। কিছুদিন পর দেখা যায়, ছাইয়ের মধ্যে অনেক গ্যাসগাছের চারা গজাচ্ছে। আসলে আগুনে সব পুড়ে গেলেও গ্যাসগাছের বীজ পোড়েনি। ফুলের মতোই গ্যাসগাছের বীজও আগুন-সহিষ্ণু। সব জ্বলেপুড়ে যাওয়ার পর ছাইয়ের ফার্টিলাইজার পেয়ে গ্যাসগাছের চারা দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে।

গাছপালার বংশ বিস্তারের প্রতিযোগিতা মরু এলাকায় প্রখরতর। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য গ্যাসগাছেরা তাই মরুর দাবদাহকেই ব্যবহার করেছে। কোটি বছরের বিবর্তনে গ্যাসগাছের ফুল ক্রমেই বেশি বেশি দাহ্য-গ্যাস তৈরি করেছে এবং বীজগুলো বেশি বেশি আগুন-সহিষ্ণু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য প্রজাতির গাছপালার ক্ষেত্রে তা হয়নি। এর ফলে ফিনিক্সের মতো আগুনে পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাওয়ার পর মরূদ্যানের পোড়ামাটি থেকে এখন কেবল গ্যাসগাছের চারাই গজিয়ে ওঠে।

মধ্যপ্রাচ্যে ফিনিক্স-গাছ দেখেই মানুষ ফিনিক্স-পাখির কথা কল্পনা করেছিল। ইহুদি ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, একটি জ্বলন্ত-ঝোপ থেকে ঈশ্বর ‘ইয়াহয়ে’ কথা বলেছিলেন। অনেকের মতে, ফিনিক্স-গাছকে আপনা-আপনি জ্বলে উঠতে দেখার অভিজ্ঞতা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের ছিল বলেই ধর্মগ্রন্থে তা লেখা সম্ভব হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের রাজকীয় উদ্ভিদ উদ্যানে কিছু গ্যাসগাছ লাগানো হয়েছে। এই গাছগুলো যাতে হঠাৎ করে আগুনে আত্মাহুতি দিতে না পারে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আমাদের দেশেও এক ধরনের ফিনিক্স-তরু আছে; নাম ইউক্যালিপ্টাস। আমরা একে কখনো আগুনে আত্মাহুতি দিতে দেখিনি; কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় হরহামেশাই সেটা দেখা যায়। ইউক্যালিপ্টাস-পাতায় কীটনাশক তেল থাকে; তাই কোনো পোকা এ পাতা খায় না। পাতা ঝরে গেলেও মাটিতে তা পচে না। বনের মাটিতে ইউক্যালিপ্টাস-পাতার স্তূপ জমতে থাকে। সেই স্তূপ থেকে হালকা নীল রঙের দাহ্য গ্যাস ওঠে। বজ্রপাতে ঝরাপাতায় আগুন ধরে গেলে অস্ট্রেলিয়ায় বনের পর বন পুড়ে যায়। কিন্তু আগুন-সহিষ্ণু বলে ইউক্যালিপ্টাস-গাছ ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকে। আগুন নিবে গেলে সেই গাছ নতুন ডালপালা ছাড়ে। বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়ায় ইউক্যালিপ্টাস তেমন সুবিধে করতে পারে না। তাই আমরা আজও এদেশে কোথাও এর আত্মাহুতি-পর্বটি দেখিনি। তবে বৈশি^ক উষ্ণায়নের ফলে সেটা খুব দূরবর্তী কোনো ঘটনা নাও হতে পারে। ইউক্যালিপ্টাস যে আসলে ভয়ংকর এক ফিনিক্স-তরু তা না জেনে যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার চারা লাগানো হয়েছিল। চারাগুলো বৃক্ষে পরিণত হতে না হতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সে অজ্ঞতার মাশুল দিতে হয়েছে। ১৯৯১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় ইউক্যালিপ্টাস-সারিতে আগুন ধরলে তিন হাজার বাড়ি পুড়ে শেষ হয়; নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে ইউক্যালিপ্টাসের কা-গুলো।

বাংলাদেশে যারা ইউক্যালিপ্টাস লাগিয়েছেন তারাও সম্ভবত ফিনিক্স-তরুর ষড়যন্ত্র-কাহিনি জানেন না। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এক পর্যায়ে এই ফিনিক্স-তরু হয়তো একদিন এর বংশ বিস্তারের প্রাচীন পদ্ধতিটি এদেশেও প্রয়োগের সুযোগ পাবে। অতএব, এখনি সাবধান হতে হবে আমাদের!

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

যে পাঁচ সমস্যায় আক্রান্তরা গুড় খাওয়ার আগে একবার ভাবুন, নইলে...

সাজেদুর রহমান শাফায়েতের স্বপ্ন পৃথিবী ঘুরে দেখা

খাওয়ার পরপরই চা পান উপকার না ক্ষতি? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জ্বরের মধ্যে যে পাঁচ খাবার খেলেই বিপদ! জানুন, সাবধান হোন

গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ডায়াবেটিস রোগীদের! সুস্থ থাকবেন যেভাবে

মুখে দুর্গন্ধের কারণে হা করতেও অস্বস্তি লাগে? সমাধান কী জানুন

লিভার ভালো রাখে লাউ! ওজন এবং উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

কিডনি ভালো রাখে আমের পাতা! উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

ইফতার ও সাহরিতে বাহারি আয়োজন ধানমন্ডির দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জে

বারবার ফোটানো চা খেলেই মারাত্মক বিপদ! বাঁচতে হলে জানুন

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :