অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৪০

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:৪০

অসংখ্য পাঠকের প্রিয় ছিলো সাপ্তাহিক সুগন্ধা। একই সময় কতিপয় ব্যক্তির বিরক্তিরও উদ্রেক করেছিলো ইর্ষণীয় মাত্রায় জনপ্রিয় সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি। এদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদও ছিলেন। কিন্তু অন্যদের মতো হামলা-মামলার পথে যাননি তিনি। তার অর্থ এই নয় যে, তার সময় সাংবাদিকরা নিগৃহীত হননি। তবে তা ছিলো পরবর্তী দুই দলের আমলের চেয়ে অনেক নমনীয়। আমি এর প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী।

সংশ্লিষ্টদের মতে, জেনারেল মাহমুদুল হাসান ও মেজর রফিকুল ইসলামের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিলো অধিকতর স্বচ্ছ। যদিও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক থাকাকালে জেনারেল হাসানকে নিয়ে ছিলো অন্য রকম প্রচারণা। সে সময় তাকে বলা হতো, ‘থিফ অব বাগদাদ।’ এর বিপরিতে রাজধানীর দেয়াল লিখন ছিলো, ‘মাহমুদুল হাসানের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র।’ ঢাকা সিটির প্রশাসক হিসেবে আলোচিত-সমালোচিত জেনারেল মাহমুদুল হাসান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন অন্য ইমেজের। অধ্যাপক ডা. মতিনের পর জেনারেল মাহমুদুল হাসান স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। চিকিৎসকের পর জেনালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অধিকতর শৃংখলায় আসে। সম্ভবত ঢাকা সিটির প্রশাসক হিসেবে কাজ করার সময় জনম্পৃক্ততার নানান বিষয়ের সাথে পরিচয় ঘটেছিলো জেনারেলর হাসানের।

উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসার। সম্ভবত এ কারণেই জেনারেল হাসান অধিকতর সহনশীল ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে।

এদিকে গণমাধ্যমের বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল ছিলো জেনালের এরশাদের সরকার। সংবাদপত্রের রিপোর্টের আলোকে অনেক সমস্যা সমাধান হয়েছে সেসময়। ৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংবাদপত্রের গুরুত্ব অঘোষিতভাবে কমতে থাকে। এমনকি সাংবাদিক সংগঠনগুলোও দ্রুত কার্যকারিতা হারাতে থাকে। এ বিষয়টি তরান্বিত হয়েছে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ১৯৯৩ সালে খালেদা সরকারের তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকা সংবাদিক ইউনিয়নে বিভাজনের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অপকৌশলের পাশাপাশি কাজ করেছে ‘নেতা পরিচয়ে’ এক শ্রেণির সাংবাদিকের অধিকতর সুবিধা বাগিয়ে নেবার অনৈতিক প্রবণতা। দুই তরফের কুমতলব এক মোহনায় সঙ্গম করার অনিবার্য ফল হিসেবে সাংবাদিক সংগঠনগুলো মূল কার্যকারিতা হারাতে থাকে; কমতে থাকে ইউনিয়নের দর কষাকষির ক্ষমতা। এক পর্যায়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো পরিণত হয় এক ধরনের নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রে। ফলে গণমাধ্যম-সাংবাদিক-প্রকাশিত রিপোর্ট, সবকিছুরই গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। অথচ এরশাদের সময় ছিলো এর উল্টো। সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রভাবে মালিক পক্ষ প্রচন্ড চাপে থাকতেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সর্বশেষ অবিভক্ত নির্বাহী কমিটির নির্বাচিত সদস্য হিসেবে এটি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এরপরও ইউনিয়নের পারফরমেন্স নিয়ে আমার অসন্তোষ ছিলো। আমি মনে করতাম, ইউনিয়ন প্রত্যাশিত মাত্রায় দায়িত্ব পালন করছে না।

শুধু ইউনিয়নের প্রভাব নয়, প্রকাশিত রিপোর্টেরও বেশ গুরুত্ব ছিলো ৯১ সালের আগে। সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে একটি রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় মালিক মোস্তাফিজুর রহমানকে ডেকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদ বলেছিলেন, ‘রাস্তায় ক্যাটস আই না বসিয়ে কি গোবর দিয়ে লেপে দেব!’ একই ধারায় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় মংলাবন্দর নিয়ে একটি রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার মিনার মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে মংলা নিয়ে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। যা বেশ আলোচিত হয়েছে। সেসময় সুগন্ধাসহ অনেক পত্রিকার খবরের সূত্র ধরে বহু সমস্যার সমাধান করেছে সরকার। গেদুচাচার খোলাচিঠি অকল্পনীয় জনপ্রিয় হবার প্রধান একটি কারণ ছিলো সরকারের মনোযোগ। অনেক মন্ত্রী গেদুচাচার খোলাচিঠির বিষয়ে অধিক সংবেদনশীল ছিলেন। কারণ প্রেসিডেন্ট এরশাদ এ চিঠির কাটিং নিয়মিত ফলো করতেন। এমনকি সুগন্ধার কার্টুনও প্রেসিডেন্টের নজর এড়ায়নি। তবে এ বিষয়টি বড় বিপদের কারণ হতে পারতো। কিন্তু বাঁচা গেছে অনকটা দৈবক্রমে।

এক দিন দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সরোয়ার ফোন করে বললো, স্যার আপনাকে চা’র দাওয়াত দিয়েছেন। তার কণ্ঠ ছিলো খুবই মোলায়েম। আমি বললাম, আচ্ছা একদিন অসবো। সরোয়ার বললো, ‘না আজই আসতে হবে।’ এবার তার কণ্ঠ বেশ শক্ত মনে হলো। একটু খটকা লাগলো; এ কেমন দাওয়াত! বিষয়টি আমার কাছে সামরিক ফর্মানের মতো বিরক্তিকর মনে হয়েছিলো।

সুগন্ধার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের নেপথ্য মালিকানার দৈনিক নবঅভিযানে চাকরি করলেও তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না। একবার মনে হলো, হয়তো নবঅভিযান নিয়ে কোন বিষয় আছে। আবার অন্য কিছুও হতে পারে। নানান রকম এলোমেলো ভাবতে ভাবতে পিআও সরোয়ারের রুমে গেলাম; তখন প্রায় বিকেল। আমাকে দেখেই সে লাফ দেবার মতো করে দাঁড়িয়ে গেলো। কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললো, চলেন স্যার অপেক্ষা করছে। আমাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রুমে নিয়ে গিয়ে বললো, স্যার আলম ভাই।

খুবই আন্তরিকভাবে রিসিভ করলেন জেনারেল হাসান। সেই প্রথম তার মুখোমুখি হওয়া। নানান বিষয় নিয়ে তিনি আলাপ করলেন। আমি নিশ্চিত হলাম, ইস্যু দৈনিক নবঅভিযান নয়। প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেলো গুরুত্বহীন গল্পকথায়। এ সময় তিনি বললো, মানুষের দারিদ্র্য তাকে ব্যথিত করে। খালি গায়ে শিশু দেখলে তার খুবই কষ্ট হয়। এ জন্য গাড়িতে বাচ্চাদের কাপড় রাখেন। এ রকমের আরো অনেক ‘চৈতালী আলাপ’ চললো। এক পর্যায়ে আমার বেশ খটকা লাগলো। একজন অতি সাধারণ সাংবাদিকের সঙ্গে দীর্ঘ গল্প করার মতো সময় সামরিক সরকারের অতি ক্ষমতাধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর থাকার কথা নয়। কিন্তু মূল বিষয় নিয়ে কোন ধারণা করতে পারছিলাম না। আমি যখন আকাশ-পাতাল হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখন ড্রয়ার থেকে সুগন্ধার একটি কপি বের করে তৃতীয় পৃষ্ঠায় একটি কার্টুন দেখিয়ে বললেন, ‘এর অর্থ কি?’

এ রকম পরিস্থিতির জন্য আমার কোনই প্রস্তুতি ছিলো না। তবুও অলৌকিক কেউ যেনো আমাকে রক্ষা করলো সেদিন; বিষয়টি আজও আমার কাছে বিস্ময়করই থেকে গেছে। আমি উত্তর দিলাম, ‘ও; এই! বিমানবন্দরে আইন শৃংখলা এতোটাই টাইট দেয়া হয়েছে যে যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া কোন কিছুই ঢোকার উপায় নেই।’মাহমুদুল হাসান বললেন, ‘ও.., তাই!’ এর পর তিনি প্রসঙ্গ পাল্টালেন। এর মধ্যে দৈনিক নবঅভিযানও ছিলো। তবে এ পর্বের আলোচনা পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়নি। বিদায়ের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, যে কোন প্রয়োজনে আপনি আসবেন। তার ডাইরেক্ট ফোন নম্বরও দিলেন। কিন্তু এরপর তিনি মন্ত্রী থকাকালে আমি তার কাছে কখনো যাইনি, ফোনও করিনি।

জেনারেল মাহমুদুর হাসানের রুম থেকে বের হয়ে ভাবলাম আল্লাহ এক বাঁচান বাঁচিয়েছে! তার প্রশ্নে বানানো উত্তর দিতে ইতস্থত করলে বা সাজানো উত্তর দিতে না পারলে বড় রকম ঝামেলা হতে পারতো। কারণ, কার্টুনের অর্থ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছি আসলে বিষয়টি মোটেই তা ছিলো না। কার্টুনের বক্তব্য ছিলো প্রেসিডেন্ট এরশাদকে জড়িয়ে আদি রসাত্মক।

সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে জেনারেল এরশাদের বদনামের দিকগুলোর মধ্যে প্রধান একটি ছিলো অসম প্রেম। ক্ষমতায় থাকা কালেই তার প্রেমিকা হিসেবে মেরীসহ অনেকের নাম দেশবাসী জেনেছে। নায়িকা-গায়িকা-নারী এমপি-নেত্রী-ছাত্রী- থেকে শুরু করে সচিবের স্ত্রীর সঙ্গে জেনারেলর এরশাদের পরকীয়া ও অনৈতিক প্রেম ছিলো ওপেন সিক্রেট। অনেক নারী আবার নিজের গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য এরশাদের সঙ্গে একান্ত ঘনিষ্ঠতার কথা রটাতেন। এ অবস্থার মধ্যে নতুন এক বিষয় যোগ হলো। তা হচ্ছে, ভারতীয় সেলিব্রেটিদের আনাগোনা। যতদূর জানা যায়, ভারতীয় সুন্দরীদের বিষয়ে দায়িত্বের সোল এজেন্ট ছিলেন আজিজ মোহাম্ম ভাই। যদিও এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর তার প্রথম রোষাণলে পড়ে ছিলো এই মাফিয়া ডন। তাদের বিরোধের নেপথ্যেও কামিনীর সংযোগ ছিলো বলে রটনা আছে। আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে জেলে নেয়া হয়েছিলো কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। বিষয়টি নজরে আসে তাকে জেল থেকে বের করার সময়। এ অবস্থায় ব্যাক ডেটে কাগজপত্র প্রস্তুত করা হয়। সামরিক সরকারের রাজত্বে সবকিছুই সম্ভব; তা জেলের অভ্যন্তরে হত্যাকাণ্ড হোক অথবা ব্যাকডেটে কাগজপত্র তৈরি করে কারাবাসীকে বের করাই হোক।

ভারত থেকে সিনেমার নায়িকাসহ সেলিব্রেটি আসার গুঞ্জনের ডালপালা বিস্তার করায় বিষয়টি নিয়ে সাপ্তাহিক মিটিং-এ আলাপ করলাম। সবাই দ্বিমত করলো। একজন বললো, এ নিয়ে কোনভাবে নাচাড়া করা তো দূরের কথা; বিষয়টি একদম ভুল যেতে হবে। আমি সকলের সঙ্গে একমত হলাম। কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না স্বভাবগত কারণে। কয়েকদিন পর বিষয়টি নিয়ে কামাল পাশা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললাম। কম কথা বলা স্বভাবের কামাল ভাই হ্যা-না কিছুই বললেন না। আমি ভাবলাম, হবে না। পত্রিকার প্রচ্ছদ রিপোর্টের প্রয়োজনে আমাদের ব্রিফ মতো কাভারের জন্য কার্টুন আঁকার পাশাপাশি তৃতীয় পৃষ্ঠার জন্য নিজ বিবেচনায় প্রতি সংখ্যায় একটি কার্টুন আঁকতেন চারুকলার মেধাবী ছাত্র কামাল পাশা চৌধুরী।

সেদিন আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে প্রচ্ছদের কাজ শেষ করে তৃতীয় পৃষ্ঠার জন্য কার্টুন আঁকলেন কামাল পাশা চৌধুরী। যাতে দেখা যাচ্ছে, বিমান বন্দরে এক সুন্দরীকে জাপটে ধরে আছে এক কর্মকর্তা। আর চিৎকার করছে, ‘ধরেছি স্যার, ধরেছি!’ কামাল ভাই নীরবে কার্টুনটি আমাকে দেখালেন। বুঝলাম, শিল্পীর হাতের তুলি কি জিনিস! এনিয়ে আর কোন আলোচনা করিনি। যথারীতি উল্লেখিত ‘ভয়ংকর’কার্টুনটি সুগন্ধায় ছাপা হলো। ছাপার পর সকলেই বুঝলো কি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ নিয়ে কেউ মুখ খুললো না। আমি ভাবলাম, হয়তো কারো নজরে পড়েনি। অথচ রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার নজরে পড়েছিলো বিষয়টি আমাদের অজান্তে। জানলাম সামরিক ফরমানের মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের কথিত চায়ের দাওয়াতের মধ্যদিয়ে। সেদিন তাৎক্ষণিকভাবে বানানো উত্তর দিতে না পারলে কপালের অনিবার্য দুর্ভোগ কোথায় গিয়ে ঠেকতো কে জানে! চা-বিস্কুটের বদলে নিদেন পক্ষে হয়তো ডিম-আইসক্রিম ছিলো অনিবার্য!

আলম রায়হান, জেষ্ঠ্য সাংবাদিক

ইমেইল[email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :