রোহিঙ্গা নিধনে মোদির ‘ইয়েস’ এবং বিএনপির অপরাজনীতি

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:১২

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হলেও বাংলা ভাষারই বিশেষ একটি রূপ নিয়ে কথা বলে। চেহারা-সুরুতে ঠিক আমাদের মতো। ধর্মও এত দিন জানতাম ইসলাম। বর্মি সন্ত্রাসীদের পরিচালিত গণহত্যার কবলে পড়ে শ পাঁচেক হিন্দু রোহিঙ্গাও বাংলাদেশে পালিয়ে আসায় জানতে পারলাম তাদের মধ্যে হিন্দুও আছে। থাকবেই। আমরা যেমন বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আছি। সব মিলে বর্মিদের দস্যুতা সহ্য করার মতো নয়।

মানবিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে চলেছে। মুখে না বললেও বিজিবি রোহিঙ্গাদের আসতে দিচ্ছে। শুধু আসতে দিচ্ছে তা নয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এনে উন্নত চিকিৎসাও দিচ্ছে সরকার। অথচ বিএনপি-জামাত অপপ্রচার করছে যে, সরকার নাকি রোহিঙ্গাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করছে! রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সহানুভূতিকে রাজনীতির নোংরা খেলায় কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। তাই গণ-অনুভূতির সুযোগ নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় বিএনপি। বিএনপির দোসর জামাতও হয়তো কোনো না কোনো ষড়যন্ত্র করছে। জামাত কাজ করে কূটবুদ্ধিতে, কূটকৌশলে।

চোখের সামনে গণহত্যা হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গারা বর্মি সন্ত্রাসী সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় বৌদ্ধদের হাতে অসহায়ের মতো প্রাণ হারাচ্ছে রোহিঙ্গারা। রাখাইন রাজ্য তথা মিয়ানমার থেকে শেষ রোহিঙ্গা মানবটিকেও হত্যা করতে চায় বর্মি সেনা-সন্ত্রাসীরা। এত দিন ধরে মনে হয়েছে, শুধু মুসলমান বলেই এই গণহত্যা। হিন্দু রোহিঙ্গা আক্রান্ত হওয়ার পর মনে হয়েছে, জাতিগত নিধন। অর্থনৈতিক কারণগুলো আলোচনায় আসায় এখন মনে হচ্ছে, অর্থনৈতিক কারণে বার্মার বর্বর সেনাবাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহুজাতিক কোম্পানির হয়ে ভাড়াটে খুনির মতো কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে তাই নিধন চলছে রাখাইন রাজ্যে। এই গণহত্যা তাই একই সাথে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট।

নির্যাতিত রোহিঙ্গা দেখলেই বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। মনে হয় যেন আমারই বাবা, মা, ভাই কিংবা বোন। এই মানুষগুলো যে বাঙালি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ এরা আমাদের সামনেই কচুকাটা হচ্ছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্র স্বয়ং এই সন্ত্রাসী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। শুধু রোহিঙ্গা মারছে তা নয়, বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি করেছে এক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা। ঐতিহাসিকভাবে দস্যু এই বর্মিরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে গুলি করে বসছে। সেদিন এসে পড়ল মর্টার শেল। বিজিবির কড়া প্রতিবাদ উপেক্ষা করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার একাধিকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। আচ্ছা, মিয়ানমারের হেলিকপ্টার যখন বাংলাদেশের আকাশে অনুপ্রবেশ করেছিল, তখন কি আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী দেখেনি? প্রথমবার না হয় বোঝা যায়নি, বুঝলাম। পরে যখন এল, তখন আমাদের বিজিবি গুলি করল না কেন? হেলিকপ্টার তো আর চড়ুই পাখি নয় যে, ফুড়ুৎ করে এসে আবার চলে গেছে। গুলি করলে কী হতো! তবে কি মিয়ানমার আমাদের যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে? কী চায় মিয়ানমার? আমরাই বা কী চাই?

মিয়ানমার সরকারের বর্বরতায় টিকতে না পেরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। গত কয়েক দিনেই নাকি দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সব মিলে কয়েক দশকে সাত-আট লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশের টেকনাফ অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার সরকার মজা পেয়ে গেছে। যা পারে হত্যা করে, আর যে রোহিঙ্গাগুলো বাকি থাকে এদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের বিজিবি সাধ্যমতো ফেরানোর চেষ্টা করে। ১/২ হাজার ফেরাতে পারে, কিন্তু লাখ লাখ প্রবেশ করে। রোহিঙ্গাদের হত্যা করে, বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়ে, বাংলাদেশের সীমানায় মর্টার শেল নিক্ষেপ করে, হেলিকপ্টার নিয়ে অনুপ্রবেশ করে মিয়ানমার তাই বাংলাদেশের ‘শত্রু’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সামরিক-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করলেও প্রতিবেশী ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারের প্রতি তার বুকভরা সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। মিয়ানমারে গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সমর্থক নিন্দিত নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেছেন, ‘রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর ওপর হামলায় সৃষ্ট সংকটে উদ্বিগ্ন’ তিনি। অর্থাৎ রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করে এই সংকট সৃষ্টি করেছে! আর সেনাবাহিনী যে সন্ত্রাস দমন করছে, তাতে মোদি সাহেবের পূর্ণ সমর্থন আছে বলেও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমান হত্যার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তিনি রোহিঙ্গা নিধনে সমর্থন দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। মোদী সরকার ভারতে এমনই সাম্প্রদায়িক আচরণ করছে যে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিশ্বে ভারতের স্থান এখন চতুর্থ। এমন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সাপোর্ট করবেন, স্বাভাবিক।

তবে সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে আঞ্চলিক রাজনীতি। চীনের সঙ্গে অর্থনীতি ও সামরিক সামর্থ্যে পেরে না উঠে, মিয়ানমারের সঙ্গে ভাব জমাতে চায় ভারত। উদ্দেশ্য চীন যেন মিয়ানমারের ওপর ভর করে এ অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। বাংলাদেশ ও ভুটান ছাড়া এ অঞ্চলে ভারতের ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র আর একটিও নেই। তাই মিয়ানমারের প্রতি মোদির এই নির্লজ্জ সমর্থন। বাংলাদেশের বিপদের দিনে মোদি সরকার যখন মিয়ানমারের প্রতি তার সমর্থন দিল, তখন বাংলাদেশের কী করণীয়?

মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও ক্রমেই বিষয়টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ৭-৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। একদিকে বলা হচ্ছে, বিজিবি রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করেছে, অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে দিচ্ছে। অথচ বাস্তবে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এই অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কি কোনো তালিকা তৈরি হচ্ছে? জাতিসংঘকে সঙ্গে নিয়ে এই তালিকা তৈরি করতে হবে। কখনো যদি মিয়ানমারকে রাজি হতে বাধ্য করা যায়, তাহলে এই তালিকা কাজে দেবে। জাতিসংঘের অনুমোদিত তালিকা না থাকলে মিয়ানমার পরে এদের না নিতে নতুন অজুহাত দাঁড় করাবে। অন্যদিকে তালিকা না থাকলে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে যাবে। ইতোমধ্যেই দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ার কথা শোনা গেছে। পাসপোর্ট বানিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বিদেশ চলে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গারা এ দেশে এসে প্রাণে বাঁচতে পারলেও এখানেও অমানবিক জীবনযাপন করে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মহামারি আকারে রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা একবার শুরু হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের সংকটে পড়বে। যেমন ডায়রিয়া হতে পারে। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে সরকার কতটুকু ভেবেছে, জানি না। জাতিসংঘ এবং সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলো থেকে অনুদান নিয়ে স্বাস্থ্য দিক নিয়ে সরকারের আগাম প্রস্তুতি থাকা উচিত। রোহিঙ্গারা দরিদ্র, নির্যাতিত। ফলে এদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করা সহজ। তাই স্বাধীনতা-বিরোধী জামাত এবং অন্যান্য জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো যেন কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে সরকারের কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তুরস্কের ফার্স্ট লেডি ও সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদেরও বৈঠক করার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সাবধানতার সঙ্গে এই বিদেশি বন্ধুদের পরামর্শ শোনা এবং ক্ষতিকর মনে না হলে সাহায্য-সহযোগিতা নেয়া।

সংকট মোকাবেলায় এগুলো সাময়িক পথ। মিয়ানমারকে অবশ্যই বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে। বাংলাদেশ সম্প্রতি দুই দফা মিয়ানমারের দূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হলে বেসামরিক-সামরিক সব উদ্যোগ জোর দিয়ে অব্যাহত রাখতে হবে।

রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে এবং তাদের ফিরিয়ে নিতে বিশ্ব জনমত তৈরি করতে হবে। প্রবাসীদের কাজে লাগানো হোক। হাজার হাজার প্রবাসী জাতিসংঘের সামনে, মিয়ানমারের দূতাবাসগুলোর সামনে বিক্ষোভ করুক। বাংলাদেশের উচিত হবে চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিবিড় যোগাযোগ করা। চীন আমাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগী রাষ্ট্র। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের সাহচর্য চায় চীন। মোদি যেমন বাংলাদেশের পাশে না থেকে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বাংলাদেশেরও উচিত নিজেদের স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিবেচনায় রেখে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া। নিজের সীমান্ত, নিজের সংস্কৃতি, নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মাথায় রেখে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ও সামর্থ্য শেখ হাসিনা সরকারের আছে। মিয়ানমারের দস্যুতা বন্ধ করতে জাতিসংঘ ও ওআইসিতে বারবার জোর দাবি করা হোক। চীনের শত্রু ভারতের সঙ্গে মিয়ানমার সুসম্পর্ক রাখতে পারে। আমরাও চীনের কাছে সহায়তা চাইতে পারি। ইতোমধ্যে আমরা চীন থেকে সাবমেরিন ক্রয় করে নিজেদের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার স্বাক্ষর রেখেছি। চীনের কথা শুনবে মিয়ানমার। তাই চীনের সহযোগিতা জোরেশোরে কামনা করতে পারে বাংলাদেশ।

রোহিঙ্গা ইস্যুকে শুধু ধর্ম দিয়ে বিবেচনা করলে সমুহ বিপদ। পাকিস্তান ১৯৭১ সালে আমাদের যে ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল, তার অধিকাংশই ছিল মুসলিম। পাকিস্তান সম্প্রতি নিজের তৈরি যুদ্ধবিমান বিক্রি করেছে মিয়ানমারের কাছে। ইসরায়েল, ভারত ও চীন থেকে মিয়ানমার অস্ত্র সহযোগিতা নেয়। বাংলাদেশের উচিত হবে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে সহযোগিতা দিতে ইচ্ছুক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে পুরো বিশ্বে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করা। সম্ভাব্য সব উপায়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। জনগণ, রাজনৈতিক দল ও সরকার-সব পক্ষকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে উদ্যোগী হতে হবে। সেই সঙ্গে সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :