রাখাইনের নৃশংসতা সীমান্তের জিরো পয়েন্টেও

মোসলেহ উদ্দিন, উখিয়া (কক্সবাজার)
 | প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৮:০৫

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে বাঁচতে গত ১২ দিনে আড়াই লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে সরেজমিনে স্থানীয় প্রশাসন ও লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এর মধ্যে গত দুই দিনে শুধু পালংখালীতে ঢুকেছে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। প্রতিদিনই মিলছে রোহিঙ্গাদের লাশ। আজ নারীসহ ছয়জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। সরেজমিনে না দেখলে বোঝা যাবে না কী মানবিক বিপর্যযে পড়েছে রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গারা যেসব এলাকায় ও পয়েন্টে আশ্রয় নিয়েছে, সেসব এলাকায় গিয়ে তাদের বর্ণনায় পাওয়া গেছে এক বীভৎস নৃশংসতার চিত্র। ডজন ডজন যুবক রোহিঙ্গাকে ঘরে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা, তাড়া করে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে পলায়নরত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে। এমনকি আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের সীমান্তে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের নাকি জিরো পয়েন্টে এসে গুলি করে হত্যা করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বন-জঙ্গল, ধানক্ষেত ও নদীতে নিজেদের লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে আসে। এভাবে রাত-দিন বাংলাদেশে আসতে তাদের কারো কারো ১০-১২ দিন লেগে যায়।

বৃহস্পতিবার ও গতকাল বুধবার কক্সবাজারের পালংখালী, উখিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে এসেছেন আমাদের এই প্রতিনিধি।

কক্সবাজারের উখিয়া পালংখালী নাফনদী সংলগ্ন জামে মসজিদের উঠানে গিয়ে তিনি দেখেন, রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের পাঁচটি রক্তাক্ত লাশ। এর মধ্যে বিভিন্ন বয়সী পাঁচজন পুরুষ গুলিবিদ্ধ। আর মহিলাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তুব্রুতে পচনধরা আরো একটি লাশ পাওয়া গেছে। নানা সূত্রে তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত টেকনাফের শাহপরির দ্বীপসহ নাফ নদী এলাকায় পাওয়া গেছে অন্তত ৬১টি মরদেহ।

মিয়ানমারে সহিংসতার পর বৃহস্পতি-বুধবার দুই দিনে আরো ৩০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তে বিস্তীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি জনপদ এবং নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্তে অসংখ্য পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ চলছে।

কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্প, অনিবন্ধিত বালুখালী ও থাইখালী শরণার্থী ক্যাম্পসহ উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঝুপড়ি বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এ পর্যন্ত আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে অনুমান করছেন স্থানীয় প্রশাসন।

বুধবার বিকেলে সরেজমিনে আনজিমান পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, জামে মসজিদের চত্বরে খোলা আকাশে নিচে পড়ে থাকা বাবার মরদেহের পাশে অঝরে কাঁদছে তার মেয়ে মোমেনা খাতুন। অন্যদিকে হাউমাউ করে কাঁদছিল আরো চার-পাঁচটি শিশু। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। মরদেহগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে। লাশগুলো কখন কোথায় দাফন করা হবে কেউ জানে না। লাশগুলো দাফনের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট মানবতার এমন চরম বিপর্যয় এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের স্থানে স্থানে।

মোমেনা খাতুন জানান, তার গ্রামের বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিদং এলাকায়। সহিংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে বুধবার দুপুর ১২টার দিকে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে তারা ঢুকে পড়েছিল জিরো পয়েন্ট নাফ নদী এলাকায়। এ সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী জিরো পয়েন্ট এলাকায় এসে তার বাবা ফজলু রহমান, একই বাড়ির সৈয়দ আলম, শামসুল আলম, সুফিয়া খাতুনকে গুলি করে হত্যা করে। সেখানেই পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যাক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

বুধবার বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সরেজমিন কুতুপালং, বালুখালী, থাইনখালী, পালংখালীসহ নাফ নদীর তীরবর্তী এলাকায় হাজারো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র দেখা যায়।

নাফ নদী সংলগ্ন পালংখালী ইউনিয়নের পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা চিংড়ি ঘের, বেড়িবাঁধ এলাকায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছে। ওপারে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলতে দেখা যায়।

৭০ বছর বয়সী অসুস্থ মাকে কাঁধে নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসছিলেন বুচিদং এলাকার মোহাম্মদ সালাম। মাকে নিয়ে ১২ দিন ধরে ছুটছেন তিনি। সালাম বলেন, ’জীবন বাঁচাতে গত ১২ দিন ধরে মাকে কাঁধে নিয়ে কখনো পাহাড়ের ঝোপজঙ্গল, কখনো ধানক্ষেতে লুকিয়ে-চুরিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছি।’ এখন কোথায় যাবেন, কে তাকে আশ্রয় দেবে জানেন না। সালাম জানান, তার পরিবারের তিন ছেলে, দুই মেয়ে ও চার ভাইকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে।

পালংখালীর আনজিমান পাড়ায় দেখা মেলে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের কুয়াঞ্চিবন পাড়া থেকে পালিয়ে আসা যুবক আবদুর রহিমের। তিনিও ১২ দিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। রহিম জানান, গত ২৯ আগস্ট তাদের কুয়াঞ্চিবন পাড়ার বাড়িঘর ঘিরে ফেলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা পাড়া থেকে বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের সরিয়ে নিয়ে মুসলিম নিরীহ নারী-পুরুষকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পাড়ার ৩৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশু মারা যায় তখন। এ সময় অন্তত ১১ জন যুবককে একটি ঘরে তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনাবাহিনীর লোকজন।

নাফ নদীর সীমান্তে আনজিমান ও ধামনখালীর পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুরা বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে। যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই অবস্থান নিচ্ছে ও বসতি গাড়ছে।

(ঢাকাটাইমস/৮সেপ্টেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :