আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ
| আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:৩৪ | প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১০:৩৩

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সারা বিশ্বে আজ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’- ২০১৭। আজ হতে ৫০ বছর পূর্বে (১৯৬৭) বিশ্বে প্রথম আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হয়। সে হিসেবে আজ এই বিশেষ দিবসের পাঁচ দশক পূর্তি বলা যায়। এই দিবস উদযাপনের বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে আর তা হলো বিশ্ব সম্প্রদায়কে মনে করিয়ে দেওয়া যে সাক্ষরতা ব্যক্তি, গোষ্ঠি এবং সমাজ - সবার জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে সমাজকে আরও বেশি সাক্ষর করে গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করা। এবারের বিশ্ব সক্ষরতা দিবসের থিম (Theme) বা বষয়বস্তু হচ্ছে ‘ডিজিটাল বিশ্বে সাক্ষরতা’ (Literacy in a Digital World). এ থিমের তিনটি উদ্দেশ্য (objectives) চিহ্নিত করা হয়েছে, এগুলো হলোঃ ১) ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালিত (Digitally mediated) সমাজে সাক্ষর হওয়া বলতে কী বুঝায় তার উপর আলোকপাত করা; ২) ডিজিটাল বিশ্বে সাক্ষরতার দক্ষতা উন্নয়নে কার্যকরী নীতিমালা ও কর্মসূচীসমূহ উন্মোচন (explore) করা; ৩) ডিজিটাল টেকনোলজি কীভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-৪ (এসডিজি-৪), বিশেষ করে লক্ষ্য ৪.৬ এর অগ্রগতিতে সহায়তা করতে পারে তা উন্মোচন (explore) করা । এই লক্ষ্য ৪.৬ এর ফোকাস হল যুব ও বয়স্ক সাক্ষরতা নিশ্চিত করা।

ইউনেস্কো তাদের ধারণা পত্রে (concept note)) ডিজিটাল টেকনোলজি বলতে কী বোঝায় তার সংজ্ঞা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ডিজিটাল টেকনোলজি হল ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনসহ সবধরনের উপকরণ যা ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য ব্যবস্থাপনা করে এবং মানুষের জীবন, কর্ম, শিখন ও সামাজিকতায় মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে। একথা সত্য যে গত দু’দশকে ডিজিটাল টেকনোলজি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা বিশ্বের মানুষের জীবন, কর্ম, শিখন ও সামাজীকিকরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তেমন একটি পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কামশন (বিটিআরসি)-এর সূত্রমতে, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ বাংলাদেশে মোবাইল ফোন সাবসক্রাইবারের সংখ্যা ১২৯.৫৮৪ মিলিয়ন যা কোটির হিসেবে ১২ কোটি ৯৫ লক্ষ ৮৪ হাজার। আর এই জুন মাসে ইন্টারনেট সাবসক্রাইবারের সংখ্যা ৭৩.৩৪৭ মিলিয়ন যা কোটির হিসেবে ৭ কোটি ৩৩ লক্ষ ৪৭ হাজার। একই সময়ে পাঁচ বছর আগে ইন্টারনেট সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ছিল ২৬.৬২৮৫২২ মিলিয়ন যা কোটির হিসেবে ২ কোটি ৫৫ লক্ষ ২৮ হাজার ৫২২ জন। সুতরাং বলা যায়, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বেড়েছে।

দেশে ডিজিটাল টেকনোলজি যে এত বৃদ্ধি পেলে এর প্রভাব কী। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু’ধনেরই প্রভাব রয়েছে মানুষের জীবন, কর্ম, শিক্ষা ও সামাজিককতায়। মানুষের জীবন এখন অনেক বেশি ডিজিটালময়। অনেক মানুষের ঘুম ভাঙ্গা থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত ডিজিটাল নির্ভর। বর্তমান ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কৃষি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেক বেশি ডিজিটাল টেকনোলজি নির্ভর। সেইসাথে আইসিটি নির্ভর ডিজিটাল টেকনোলজি ক্রমাগত নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আইসিটি সেক্টরের বাজার মূল ৬৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। বাংলাদেশের অনেক তরুণ ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন আউট সোর্সসিং পেশায় নিয়োজিত রয়েছে যার গত বছর নভেম্বরে বাজার মূল্য ছিল ১৮০ মিলিয়ন ডলার (সূত্রঃ Financial Express, 18 November, 2016)। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রেও ডিজিটাল টেকনোলজি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি, সরকারি, বেসরকারি এবং দাতা সংস্থা কখনও একক ভাবে কখনও বা যৌথভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। সরকার ইতোমধ্যে a2i Innovation Lab এর মাধ্যমে ৩৮,৩৩১ টিরও বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং ১৫০০০ হাজারেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করেছে যেখানে একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি ল্যাপটপ রয়েছে। কোথাও কোথাও প্রজেক্টরও দেওয়া হয়েছে। এ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের মাধ্যমে ৮ মিলিয়ন (৮০ লক্ষ) শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করছে। এ শিক্ষা প্রদানের প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত রয়েছে ২ লক্ষের বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। কিন্তু এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ শ্রেণিশিক্ষণে কতটা মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করছেন বা করতে পারছেন তার সঠিক হিসেবে কারো কাছে নেই। এক্ষেত্রে সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এছাড়া বর্তমান ৯০ লক্ষ স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের জন্য তৈরি করেছে Teacher Portal (www.teacher gov.bd)। এ পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষকরা শিক্ষা ও শিক্ষণ-শিখন বিষয়ে তাদের ভাব বিনিময় করতে পারে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী, এনজিও ও দাতা সংস্থারাও ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রদানে নিয়োজিত রয়েছে। যেমন বৃটিশ কাউন্সিল Connecting Classrooms প্রকল্পের মাধ্যমে ডিজিটাল নির্ভর সাক্ষরতা প্রদানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ও অনুপ্রাাণিত করছে। ব্র্যাকসহ অন্যান্য এনজিও এ কাজে পিছিয়ে নেই।

একথা সত্য যে, ডিজিটাল টেকনোলজির বিস্তারের সাথে সাথে ডিজিটাল ডিভাইড (Digital Divide) একটা ইসু হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল টেকনলোজির Access বাংলাদেশে এখনও অসম। এই অসমতা যতটা না নারী-পুরুষের মধ্যে তার চেয়ে বেশী শহর ও গ্রামে এবং ধনী ও দরিদ্রের মাঝে। তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎ প্রবাহের সমস্যা রয়েছে এইসব সমস্যা প্রবণ এলাকায় সরকার হাইটেক সোলার পাওয়ার মাল্টিমিডিয়া ইউনিট (High-tech Solar Powered Multimedia Unit) স্থাপনের চিন্তা ভাবনায় আছে। শুধু চিন্তা ভাবনা করলেই হবে না, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া, সরকার ই-লার্নিং প্লাটফর্মের মাধ্যমে দক্ষতার উন্নয়নে সচেষ্ট আছে। অনুরুপভাবে ডিজিটাল ডিভাইড দূর করে গ্রামের কিশোরীদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বৃটিশ কাউন্সিল ইতোমধ্যে ব্র্যাকের সহায়তায় English and Digital for Girl’s Education (EDGE) প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক হাজার কিশোরীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

বললে অমূলক হবে না যে সরকারসহ অনেক সংস্থা এখনও যতটা না গুণগত দিককে প্রাধান্য দেয় তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় পরিমাণগত দিককে। কিন্তু জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৪-এ একীভূত এবং গুণগত শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে যা এ বছরের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসেরও ফোকাস। কিন্তু বাংলাদেশ এ লক্ষ্য পূরণে অনেক পিছিয়ে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বাংলাদেশেরে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই স্কুলে যা শেখার তা অনেকাংশেই শিখতে পারছে না। তাদের শিখন গভীর হচ্ছে না। এমনকি কখনও কখনও তারা ভুল শিখছে। তাই বাংলাদেশের সাক্ষরতা হার সরকার যাই দেখাক না কেন বিদেশি সংস্থারা তাদের মতো করে সাক্ষরতার হার নির্ধারণ করছে। তাই বাংলাদেশকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে যে, যে মানের শিক্ষা দেশে দেওয়া হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মানদন্ডে কোন পর্যায়ে রয়েছে। আরও চিন্তা করতে হবে ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিশ্বে কোন ধরনের এবং কোন মানের সাক্ষরতার দক্ষতা প্রদান করতে হবে যা প্রকৃত অর্থেই গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করবে, নিশ্চিত করবে ২০৩০ সালের মধ্যে পুরুষ-নারী সকলেই প্রকৃত সাক্ষরতা অর্জন করতে পারে। এ কাজ করতে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ আসা স্বাভাবিক, তবে তা মোকাবেলায় চাই সমন্বিত পরিকল্পিত প্রয়াস- কথা নয়, কাজে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :