দেখা না দেখা ঈদ বিনোদন

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:২৭

মাসুদ কামাল

একটা সময় ছিল যখন টেলিভিশনের ঈদ অনুষ্ঠান নিয়ে রীতিমতো মাতামাতি হতো। কোন কোন নাটক দেখানো হবে, গানের কি অনুষ্ঠান, কিংবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান- এসব নিয়ে আলোচনা শুরু হতো ঈদের আগেই। প্রিয় অনুষ্ঠানটি নির্বিঘ্নে দেখতে আগে থেকেই দেখা যেত প্রস্তুতি। সেই দিন আর নেই এখন। প্রবীণ অনেককে দীর্ঘশ্বাস সহকারে বলতে শুনি, সেই রকম নাটক আর অনুষ্ঠানই তো হয় না, তাই আলোচনা বা আলোড়নই বা হবে কি করে?

আমার নিজের কাছে অবশ্য এ ধরনের বক্তব্যকে কিছুটা অতিসরলীকৃত বলে মনে হয়। আসলে আমাদের নাটক বা অনুষ্ঠান নির্মাণই কেবল নয়, দেখার দর্শকও আর আগের মতো নেই। সেই সময় আলোচনা হতো আগে, এখন আলোচনা হয় পরে। মৌসুম শেষে নিজের ভালোলাগা নিয়ে কেউ কেউ আলোচনা করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা নিয়ে লিখেন। এরপরই শুরু হয় তা নিয়ে আলোচনা, ইউটিউবে খোঁজাখুঁজি।

এটি অবশ্য এমনি এমনি হয়নি। অনুষ্ঠান নির্বাচন নিয়ে দর্শকদেরও নানা জটিলতায় পড়তে হয়। দেশে এত এত টেলিভিশন, এত এত অনুষ্ঠান। কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন? আগে তো মাত্র একটি টেলিভিশন ছিল। তাই সকলকে ওই এক টিভির অনুষ্ঠানই দেখতে হতো। ফলে আলোচনার বা সমালোচনার বিষয়বস্তুও হতো একই। এখন সে অবস্থা নেই। সমস্যা আরও একটা আছে। নাটক বা অনুষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সংখ্যা কিন্তু তেমন একটা বাড়েনি। ফলে একই অভিনেতার নাটক হয়তো ঘুরেফিরে চলে বিভিন্ন চ্যানেলে। এই মুহূর্তের জনপ্রিয় অভিনেতা হচ্ছেন মোশাররফ করিম। চেহারা সুরত ভালো না হলেও এই ভদ্রলোক অভিনয় করেন ভালো। ফলে তার চাহিদাও বেশি। অনেক নাটকেই তাকে দেখা যায়। কিছুদিন আগে এক রাতে চ্যানেল ঘুরাতে গিয়ে দেখি একই সময়ে চারটি টিভির নাটকে তাকে দেখা যাচ্ছে। আর একটি বিষয় ছিল লক্ষণীয়, এই চারটি নাটকেই তেমন কোনো গল্প ছিল না, ছিল কেবল ওই মোশাররফ করিমের অভিনয় আর কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা। অতি ব্যবহারে ভালো কিছুও যে নষ্ট হয়ে যায়, এই সময়ে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধকরি এই ব্যক্তি। এমন বাস্তবতায় অবস্থা এখন দাঁড়িয়েছে যে, পর্দায় মোশাররফ করিমের চেহারা দেখলেই আমি দ্রুত চ্যানেল পাল্টে ফেলি।

তবে অন্যদের আলোচনা সমালোচনার ওপর ভিত্তি করে দেখার পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর বলে মনে হয়েছে। গত ঈদের পর এই পদ্ধতিতে একটি নাটক দেখলাম। বিকেল বেলার পাখী। নাটকের পরিচালকের নাম- আদনান আল রাজীব। এই পরিচালকের নাম আগে শুনিনি। তবে নাটকটি দেখার পর অনেকক্ষণ মুগ্ধ বিস্ময়ে বসেছিলাম। এরকম মুগ্ধতা কোনো নাটকে বা অনুষ্ঠানে হবে, তা আগে থেকে বোঝার উপায় কি? এবারও তা ছিল না। তাই এখন অপেক্ষায় থাকতে হবে, পরিচিত কেউ কোনো নাটকের প্রশংসা করে কি না। করলে হয়তো ইউটিউবে অথবা অন্য কোনো সাইট থেকে সেটি দেখার চেষ্টা করব।

তবে ঈদের আগে থেকেই এবার একটা অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনেকের মধ্যেই আগ্রহ দেখা গেছে। সেটি হচ্ছে- ড. মাহফুজুর রহমানের একক সংগীতানুষ্ঠান। যদিও এই আগ্রহ কতটা পজেটিভ অর্থে ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকেই বলতে শুনেছি, এমনকি আমি নিজেও বলেছি, এই অনুষ্ঠানটা দেখতে হবে।

মাহফুজুর রহমান দেশের দু-দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানার সঙ্গে জড়িত। সাংবাদিক জগতে মালিক হিসাবে ওনার বেশ সুনাম রয়েছে। ভদ্রলোকের ব্যবসায়িক বুদ্ধিও ভালো। ব্যবসায়ের একাধিক সেক্টরে তার সফলতা এসেছে। কিন্তু তিনি নিজে যে একজন শিল্পী, বিশেষ করে সংগীতশিল্পী, সেরকম কখনো মনে হয়নি। যারা তার অতীত জানেন, তারাও কখনো বলবেন না যে, এই ভদ্রলোক কখনো সংগীতশিল্পী ছিলেন। তার চলন, বলন, আচার আচরণ- সবমিলিয়ে যে একটা ইমেজ সর্বসাধারণ্যে প্রচারিত, তার সঙ্গে আর যাই হোক গানটা ঠিক যায় না। তারপরও সেই লোকের গান টেলিভিশনে দেখানো হবে, তার নিজের মালিকানাধীন টিভি এটিএন বাংলায়, কেবল একটি দুটি গান নয়, একেবারে তার একক সংগীতানুষ্ঠান- এ খবরটি নিঃসন্দেহে চমক সৃষ্টিকারী।

সেই চমকের উপর নির্ভর করেই অনেকে টেলিভিশনের সামনে বসেছিলেন। আমি নিজেও বসেছিলাম। পুরো অনুষ্ঠানটা দেখা সম্ভব হয়নি। আমার বাসার ছোটরা শুরুতে আমার আগ্রহের বিষয়বস্তু দেখে হাসি তামাশা করেছে, পরে এক পর্যায়ে অসহ্য বোধ করে টেলিভিশনই বন্ধ করে দিয়েছে। পরবর্তী দুইদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, প্রায় সকলেরই আলোচনা এই মাহফুজুর রহমান ও তার গান নিয়ে। নানা জন নিজ নিজ ভাষায় লিখেছেন। যেহেতু ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে কমেন্টসের ক্ষেত্রে নীতিমালার বাধ্যবাধকতা অত বেশি প্রবল নয়, তাই প্রায় সকলেই মন খুলে লিখেছেন। কারও কারও লেখা হয়তো শালীনতাকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু মূলভাবটা সকলের মধ্যে ছিল একই রকম। অধিকাংশেরই বিবেচনায়, মাহফুজ সাহেবের গান হয় না, হয়নি। পুরো অনুষ্ঠানে তিনি যা করেছেন, তা রীতিমতো হাস্যকর, ভাঁড়ামো ছাড়া আর কিছু নয়। তবে মতামত দানকারীদের মধ্যে এক শতাংশ বা তারও চেয়ে কম দেখা গেছে ইতিবাচক মন্তব্য করতে। এরা এই নতুন গায়ককে তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেছেন। কেউ কেউ আবার তার সাহসের প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, তিনি যে পর্দায় গান গেয়েছেন, এটাই অনেক বড় ব্যাপার।

এই অনুষ্ঠানটির পর আমি সতর্কভাবে একটা বিষয় খেয়াল করেছি। ওনার মালিকানাধীন টেলিভিশন দুটির সঙ্গে জড়িত কারও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায় কি না, খুঁজেছি। বলা বাহুল্য তেমন একটা পাইনি। অথচ শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত অনেকেই তো রয়েছেন প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে। তারা বিষয়টিকে সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন। অতি অল্প যে দু-একজন ড. মাহফুজের পক্ষে মন্তব্য করেছেন, তারা যে আসলে এই মালিক ভদ্রলোকের নজর কাড়ার চেষ্টাই করছেন, সেটা উপলব্ধি করতে তেমন একটা কষ্ট হয়নি।

এরকমই একজন বললেন, ফেসবুকের এত এত স্ট্যাটাস দেখে মনে হচ্ছে, এ অনুষ্ঠানটি এরা সবাই দেখেছেন, এটাই কি এই অনুষ্ঠানের সফলতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ নয়? একজন তো রীতিমতো চ্যালেঞ্জ দিয়েই বললেন, দেখবেন আগামী সপ্তাহে যখন টিআরপি রিপোর্ট আসবে, এই অনুষ্ঠানটিই থাকবে শীর্ষে। এই কথাগুলো খুব যে মিথ্যা তা হয়তো নয়। কিন্তু এই তথ্য কিন্তু গায়ক হিসাবে মাহফুজুর রহমানের উৎকর্ষ, কিংবা অনুষ্ঠানটির যথার্থতা মোটেই প্রমাণ করে না। আজ যদি আমাদের অর্থমন্ত্রী হঠাৎ করেই মুষ্টিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চান এবং সেটা সরাসরি সম্প্রচারের জন্য টেলিভিশনগুলোকে অনুরোধ করেন, তাহলে কিন্তু সকল টেলিভিশনই তা করবে। তিনি কোনো টেলিভিশনের মালিক না হওয়া সত্ত্বেও সবাই আগ্রহ দেখাবে। এই যে সরাসরি সম্প্রচার হবে, সেটা মুষ্টিযোদ্ধা হিসাবে তার যোগ্যতা প্রচারের জন্য নয়, বরং তার মাথা যে আসলেই পুরোটা আউলা হয়ে গেছে, সেটা প্রমাণের জন্য। দর্শকরাও হয়তো হুমড়ি খেয়ে দেখবে পাগলের কর্মকা-। তাই টিআরপি এক্ষেত্রে মাপকাঠি হতে পারে না। মাহফুজ সাহেব কিন্তু অন্য কোনো টিভি পাননি, অন্য কোনো টিভি তার সংগীত প্রতিভার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি, নিশ্চিতভাবে বলা যায় কখনো দেখাবেও না।

এ বিষয়টি অনেকটা ওই ন্যাংটো রাজার গল্পের মতো। প্রতারক তাঁতীরা রাজার অদৃশ্য পোশাক যখন বানানোর ভান করছিল, তখন রাজার সভাসদরা নিজ নিজ পদ টিকিয়ে রাখতে আর রাজাকে খুশি করতে বায়বীয় পোশাকের প্রশংসাই কেবল করে যাচ্ছিল। যার কোনো স্বার্থ নেই রাজার কাছে, সেই শিশুটিই কেবল বলতে পেরেছিল সত্য কথাটি। এ ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। যারা এই মাহফুজুর রহমানের চাকরি করেন, কখনো করেছেন কিংবা আগামীতে করবেন বলে আশা করেন, তারা ছাড়া আর কেউ তার সংগীত প্রতিভাকে এক শর মধ্যে এক নম্বরও দেবেন না। যার ব্যবসায়িক বুদ্ধি ভালো, তিনি কেন এমন স্থূল মোসাহেবিকে প্রশ্রয় দিতে পারেন, সেটা বুঝতে কষ্ট হয়। আমার বিশ্বাস, এই মোসাহেবরা জনসমক্ষে তার কাপড় চোপড় কতটা খুলে দিয়েছে, একদিন তিনি সেটা বুঝতে পারবেন। একসময় নিশ্চয়ই তিনি বুঝতে পারবেন, বিখ্যাত হওয়ার জন্য সংগীতশিল্পীই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এমনিতেই তিনি বিখ্যাত, নিজে যা পারেন সেটা দিয়েই বিখ্যাত। একজন মানুষকে সর্বগুণে গুণান্বিত হওয়ার দরকার নেই।

কিন্তু আমার আতঙ্ক অন্য জায়গায়। গায়ক মাহফুজরা টিকে থাকবে না, এরা টিকে থাকেও না। সমস্যা হলো- যারা এদেরকে পর্দায় নিয়ে আসে, তাদেরকে নিয়ে। এদের হাতেই তো নানাভাবে জিম্মি হয়ে আছে আমাদের টেলিভিশনগুলো। এরাই নির্ধারণ করে দেয়, দর্শকদের কি দেখানো হবে আর কি দেখানো হবে না। এদের রুচি আর বুদ্ধিমত্তার কারণে টেলিভিশনগুলোতে লাগাতার নানা অখাদ্য কুুখাদ্য পরিবেশিত হচ্ছে। কখনো কখনো এদের চাহিদা মিটাতে গিয়ে গুণী নির্মাতাকেও করতে হচ্ছে আপস। আর সেসবের অনিবার্য প্রভাব গিয়ে পড়ছে দর্শকদের উপর। তারা দেশীয় অনুষ্ঠান ত্যাগ করে হয়ে যাচ্ছে বিদেশমুখী। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিজ্ঞাপনের উপরও। বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে বিদেশি টিভির অনুষ্ঠানে। আমাদের বিজ্ঞাপনের রেট কমছে। রেট কমায়, বাড়াতে হচ্ছে বিজ্ঞাপন প্রচারের সময়সীমা। ফলে অনুষ্ঠানের ফাঁকে আর বিজ্ঞাপন নয়, বরং বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে প্রচার করতে হচ্ছে অনুষ্ঠান। দর্শকরা বিরক্ত, গুণী নির্মাতারা হতাশ। এ এক অনতিক্রমনীয় বৃত্ত।
তবে আমি আশা ছাড়িনি। ঈদ বিনোদনের এই ধামাকার মধ্যে ভালো কিছুই যে হয়নি, তা আমি মনে করি না। ভাঁড়ামির বাইরেও সৃষ্টিশীল কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। হয়তো আমাদের অলস চোখে তা ধরা পড়েনি। কিন্তু নিশ্চয়ই কেউ না কেউ দেখেছেন, হয়তো দু-একদিনের মধ্যে তার হদিসও মিলবে। তখন ঠান্ডা মাথায় সেসব দেখা যাবে ইউটিউবে অথবা অপর কোনো মাধ্যমে।

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক