তেইশ বছর পর আবার...

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:৫১

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

ছবি কথা বলে! সত্যিই বলে। কথা বলে মমতার। মাতৃত্বের। ভালোবাসার। দুটো ছবির মধ্যে ব্যবধান ২৩ বছরের। অথচ ভাষা একই। দৃশ্যপটও বদলায়নি। বদলেছে মুখগুলো। ঘরহারা, দেশহারা মানুষগুলোর পাশে সেদিনও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। দুই দশকের বেশি সময় পর মঙ্গলবার আবার ছুটে গেলেন নীল পানিতে ভেসে আসা মুখগুলোর পাশে। এই তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা।

১৯৯৪ সালে যখন কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের দেখতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেতা। আর আজ যখন ছুটে গেলেন অসহায় মানুষের পাশে, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। দুটো পরিচয়ের মাঝে বিস্তর ব্যবধান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যার মনবিকতা এতটুকু কমেনি।    

১৯৯২ সালের দিকে মিয়ানমার সরকার চড়াও হলে প্রায় পৌনে তিন লাখ শরণার্থী চলে আসে বাংলাদেশে। সেই যে এসেছে তার মধ্যে আর কেউ ফেরত গিয়েছে বলে খবর নেই। গত বছর এসেছে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এ বছরের ২৫ আগস্ট থেকে আবার বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। এরই মধ্যে রাখাইন রাজ্যের অন্তত চার লাখ লাখ মানুষ এসে উঠেছে আমাদের সাগর উপকূলে।

এসব দেশহীন মানুষ যে পথে এসেছে, সেই পথে তাদের ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। বরং মাটি কামড়ে এপারেই পড়ে থাকছে শরণার্থীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই বলছেন, রোহিঙ্গাদের বাঙালি তকমা দিয়ে মিয়ানমার যেভাবে তাদেরক এ দেশে ঠেলে দিচ্ছে তা মেনে নেয়ার মতো নয়। তাদের নাগরিকদের অবশ্যই ফেরত নিতে হবে। এসব ঘরহারা মানুষকে তাদের নিজ ভূমিতেই জায়গা দিতে হবে। মানবিক দিকটিও হেলা করেননি বঙ্গবন্ধু-কন্যা। অত্যাচার-নির্যাতন সইতে না পেরে যারা এ দেশে ঢুকে পড়েছে, তাদের মাথার ওপর এক টুকরো ছাউনি, খাবারের জোগান দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এসব শরণার্থীর জন্য সাহায্যের আবেদন করেছেন। সাগরে ভেসে আসা মানুষগুলোকে যেন তাদের নিজ মাটিতে ফেরত পাঠানো যায় সে জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন।
রাষ্ট্রের অনেক ব্যস্ততা। এর মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী সময় করে গেছেন কক্সবাজারের উখিয়ায়। কুতুপালংয়ের শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নেয়া শরণার্থীদের বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনেছেন। কান্নায় ভেঙে পড়া মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি। নিজেও কেঁদেছেন। বোন শেখ রেহানা ছিলেন সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার মানবিকতায় অনেকে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। আপ্লুত হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের পাশে ছুটে গিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রমাণ দিয়েছেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি।

পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় অসহায় মানুষের খাদ্যের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেছেন। ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবুও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পক্ষে আন্দোলন করে গেছেন। তিনি এসব করেছিলেন শুধু মানবিকতার কারণে। মানবিক মূল্যবোধ ছিল তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার মনও বাবার মতো বড়। জাতি কিংবা ধর্ম নয়, মানবিকতাই তাদের কাছে বড়। রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফিরে যাওয়ার অধিকার আদায়েও দৃঢ়চেতা মনোভাব দেখিয়েছেন। যার প্রতিফলন ছিল প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়― ‘এই নিরীহ রাখাইন সম্প্রদায়ের ওপরে অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধে এবং বাংলাদেশ থেকে তাদের নিজের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ প্রয়োগ করা উচিত।’
দেশহারা মানুষগুলোকে দেখিয়েছেন বাঁচার আসা। বলেছেন, ‘এই রাখাইন সম্প্রদায়কে তাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করার মিয়ারমারের কোন অধিকার নেই। তাদেরকে মিয়ানমার সরকারের নিরাপত্তা দিতে হবে। যাতে নিজেদের দেশে তারা নিরাপদে বসবাস করতে পারে।’

মানবিক দিক বিবেচনা করে রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পাড়ি জমানো মুখগুলোকে আশ^স্ত করেছেন আশ্রয় আর দুবেলা দুমুঠো খাবারের। শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের মানুষ তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।...১৬ কোটি মানুষের এই দেশে যদি সকলের মৌলিক অধিকার নিশ্চিয়তা সরকার বিধান করতে পারে সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের শরণার্থীদেরও কোনো সমস্যা হবে না।’ তবে সবকিছুর পর প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশে একরকম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসা সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। ওই দেশে নিরাপদ অঞ্চল গঠন করে তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। কারণ রোহিঙ্গাদের সংকট সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। সমাধান তাদেরই করতে হবে। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে।’

শেখ হাসিনা উখিয়ায় আজ রোহিঙ্গাদের পাশে গিয়ে, তাদের ওপর নির্যাতনের ক্ষত দেখে যে মিয়ানমারের উদ্দেশে যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তা একজন বিশ^নেতার পরিচয় দিচ্ছে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি যতটা মানবিক ততটা দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অন্যায়-অবিচার যেখানেই হোক, যারাই করুক, ছাড় মিলবে না। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ তহবিল যেন লোপাট না হয় সেদিকেও ছিল তাঁর নজর। রোহিঙ্গা সংকটে শেখ হাসিনার ভূমিকা আবারও দেশ পরিচালনায় তাঁর মেধা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার অভেদ্য উদাহরণ তৈরি করল।

লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার।