২৫ বছর!

প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:০৪ | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:০৬

দিলরুবা সরমিন

আজ ১৫ সেপ্টেম্বর। আজ আমার আইনজীবী হবার ২৫ বছর পূর্ণ হলো। লম্বা সময়। কিন্তু কোথা দিয়ে কেটে গেল এতটা বছর মনে করতে পারি না। সেদিনের কথা আজ এক বন্ধু মনে করিয়ে দেয়াতে হঠাৎই মনে পড়লো। জীবন এবং জীবিকার তাগিদে কোনো দিবস-ই আমার আর আলাদা করে মনে থাকে না! তবে আজ তো অবশ্যই আমার জীবনে একটা বিশেষ দিন। এই দিনে আমি আইন সম্মতভাবে আইনজীবীর সনদ লাভ করি– এ কি কম পাওয়া?

আমরা যারা সেদিন একযোগে বার কাউন্সিল ভবনে “আইনজীবী” হবার ভর্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে এসেছিলাম, সে ছিলো এক অন্য রকম পরিবেশ। সন্ধ্যার অন্ধকারে বার কাউন্সিলের লাল দালানটা যেন আমাদেরকে গিলে খেতে চাইছিলো। আমরা মফস্বলের মানুষ। গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন নিয়ে পড়েছি অনার্স-মাস্টার্সে কে কোন ক্লাস পেয়েছি সেটা তো বড় কথা নয়। বড় কথা হলো- আমাদের বিশাল লিখিত পরীক্ষা আর ভাইভাতে পাশ করতেই হবে। আদালত পাড়ায় আমাদের তো আর কোনো পরিচয় ছিলো না। লিখিত পরীক্ষায় তো ভালোভাবেই আমরা পাশ করে গেলাম  তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, মৌখিক পরীক্ষা। তদবির–কারচুপি এই সব কথা কোনোদিন বার কাউন্সিল পরীক্ষায় আমরা শুনিনি। আমরা হলাম গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। তার ওপরে আমাদের কোনো ব্যাকআপ সাপোর্ট ছিলো না। তাই গাধার মতো পড়া ছাড়া আর কোনো গতিই আমাদের ছিলো না। এসএসসি, এইচএসসি বা অনার্স-মাস্টার্সে যা পড়েছি তার চেয়ে চারগুণ বেশি পড়েছি বার কাউন্সিল পরীক্ষার ওই তিন মাস। আমাদের পড়ার যুদ্ধ দেখে আশে পাশের অনেকেই হাসতো। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না আমাদের। কারণ বার এর সনদ যে নিতেই হবে! নইলে যে সব ই বৃথা!

লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ছিলো মৌখিক পরীক্ষা! কি অদ্ভুত সব ব্যাপার। আমাদের মাঝে মফঃস্বলীয় নৈকট্য এত প্রবল ছিলো যে আমরা একটা কালো কোট বানিয়ে ভাগাভাগি করে, এ- ওরটা পরে পরে ভাইভা দিতে গিয়েছি। কি অনায়াস এবং সাবলীল ছিল জীবন যাপন। কোনো হিংসা ইর্ষা-বিদ্বেষ, অহংকার কিছুই ছিলো না। কিন্তু প্রবল প্রতিদবন্দিতা ছিলো। আমরা লিখিত পরীক্ষায় ভালো করায় বেশ মনে আছে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ভাইভা বোর্ডের বারান্দায় আমাদেরকে একটু কঠিন চোখে দেখার চেষ্টা করছিল। যাই হোক ধুকধুক করা হৃদপিণ্ড নিয়ে ভাইভা বোর্ডে সুধাংসু শেখর হালদার স্যারের মতো মজাদার চৌকষ বিজ্ঞ আইনজীবীকে মোকাবিলা করা, বা অতি চমৎকার ব্যক্তিত্বময় আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরণকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম স্যার এর দিকে তাকিয়ে এক নাগারে তার কথা উত্তর দেয়া খুব যে সহজ ব্যাপার ছিল সেটা নয়। পাশাপাশি আরো বিজ্ঞজন যে ছিলেন তা আজ মনে করতে পারি না। তিনজন মহামান্য বিচারপতিও ছিলেন। ওনারা যে নিশ্চুপ ছিলেন সেটা নয়। আমাকে দীর্ঘ সময় ভাইভায় আটকে রাখাতে বন্ধুরা ধরেই নিলো যে  বোর্ড আমাকে ছিলেই ফেলছে। আসলে ফেলেছিলো তাই। তখনো বার কাউন্সিলের লাল দালানের দোতলায় লাইব্রেরি ছিলো। তখন সেখানেই ভাইভা হয়েছিলো। কিভাবে যেন আমি ও আমার বন্ধুরা অনেকেই ভালো ভাবেই পাশ করে গেলাম। ভাইভা বোর্ডেই গণ্যমান্য সদস্যরা শপথ করিয়ে নিলেন, প্রাক্টিস করতেই হবে নইলে----।   

আমার জীবনের শুরুটা ঠিক সরাসরি সেইভাবে আদালতে গিয়ে আইনি প্র্যাক্টিস দিয়েই করা হয়ে ওঠেনি। আমি হয়ে গেলাম এনজিও দের আইনজীবী। কি করে দেশে বিদেশে ডোনার কনসোরটিয়ামের সাথেই নানা অধিকার দাবি–দাওয়া আদায় প্রতিষ্ঠা নিয়েই বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরবর্তীতে সরকারের সাথে। এভাবেই দেশে বিদেশে– গ্রামে-মফস্বলে আমি “স্যোশাল অ্যাডভোকেট” হিসাবেই পার করছিলাম জীবন।

এই পথ পাড়ি দিতে কত সজ্জন আমি পেয়েছি সে বলাই বাহুল্য।  বিশেষ করে খুব সাধারণ চাল চলনের দৈহিক আকারে ছোট খাটো একজন অসাধারণ মেধাবি–পড়ুয়া এবং জ্ঞানী এ কে এম সলিমুল্লাহ স্যারের কথা আমি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত অব্দি মনে রাখবো। যাকে হারিয়ে এই পাড়ায় আমি এবং আমার মত অনেকে একেবারেই একা হয়ে গিয়েছি। যিনি আমাদের ছিলেন রেডি রেফারেন্স। এই রকম অসংখ্য বিজ্ঞ জনের নাম এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে পারি। যেমন বলতে পারি এই অঙ্গনের পথ পরিক্রমা ততটা মসৃণ নয় যতটা আমরা বাইরে থেকে দেখি বা মনে করি। 

মাঝে মাঝে অনুভব করি এই জীবনে কিছুই করি নি। যেমন আবার এটাও মনে হয়, করিনি কি ? কাজ করতে যাইনি কোথায়? কত রকম মানুষ দেখলাম। বিজ্ঞ, জ্ঞানী, পণ্ডিত, ভালো, সৎ, মেধাবী। যাদের দেখলেই নিজ থেকে মাথা নত হয়ে আসে। আবার পেলাম কিছু কুৎসিত কদর্য হিংসাত্মক লোভী মানসিকতার মানুষ। আদালত পাড়ায় আমি এই ২৫ বছর কিছুই দিতে পারিনি। আমার দেবার মত যে কিছুই নাই। বরাবরই আমি ক্ষমতাহীন মানুষ। আমি জীবনে কিছুই হতে চাইনি, তাই কিছুই হইনি। আজ বুঝি কিছু না হবার গ্লানি কত ভয়ংকর।

কিন্তু সুযোগ পেয়েছি অসাধারণ কিছু মামলা করার। যে সব কথা মনে এলে আজো চোখ ভিজে আসে। যাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি তাদের জন্য ভালোলাগা আছে। যাদের পারিনি তাদের কষ্টের ভার আমার বুকে পাহাড়সম। প্রায় সকল আইনজীবীর মতই আদালাত পাড়ায় যাওয়া আমার এক রকম নেশা। আমি কখোনো এই বিচার করিনি কোনটা উচ্চ আদালত আর কোনটা নিম্ন। আদালত মানেই আমার কাছে আদালত।  আমি কোনদিনই শুধুই ঢাকায় থাকবো বা ঢাকার আদালতেই যাবো এমন কোন পরাধীনতার শৃংখলে নিজেকে আবদ্ধ করিনি। বরং ঢাকার বাইরে মামলা করতে গিয়ে যে অভূতপূর্ব মানসিক প্রশান্তি অর্জন করেছি সে শান্তি কেবল ঢাকায় কেন দেশের বাইরে কোথাও পেয়েছি বলে মনে পড়ে না ।

এই আদালত পাড়া আমাকে কি দেয়নি? মান সম্মান খ্যাতি অরথ বিত্ত পরিচিতি, স্বাধীনতা, মানসিক শান্তি, জ্ঞানী গুনিজনের সান্নিধ্য সব দিয়েছে। কিন্তু আফসোস আমি কিছুই  দিতে পারিনি এই অঙ্গনের সহযাত্রীদেরকে। কিছুই না। কারণ আমি এখানে রাজনীতির সাথে জড়িত থেকেও সক্রিয় হইনি। নির্বাচন করিনি। ক্ষমতাহীন আইনজীবী আমি। তাই আজো আমি নিজ বিবেকের কাছে আমি দোষী। সংকোচ বোধ করি। কিছুই দিতে পারলাম না কাউকে। নবীন আইনজীবীদের। প্রবীণ আইনজীবীদের। বা প্রয়াত আইনজীবীদের। অথবা তাদের পরিবার পরিজনকে। অথবা আইনজীবী সহকারী বা আদালত পাড়ার বিভিন্ন শ্রেণির সহকর্মীদের। যারা একটা ফাইল রেডি করে না দিলে আমরা মামলা শুনানি করতে পারিনা। আদালত পাড়ার অসংখ্য সমস্যার মাঝেও আমরা দিনের পর দিন বা বলতে পারি যুগের পর যুগ পার করে দিচ্ছি এই অঞ্চলেই। কত কিছু দেখলাম, জানলাম, শিখলাম এই অঙ্গন থেকে। কিছু কি শেখাতে পারলাম? যদি এমন কোন দৈব শক্তির বলে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকি তবে এই পাড়াতেই থাকতে চাই। এটাই যে আমার শেষ ঠিকানা তাই এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী