বিষন্নতা: এক নীরব ঘাতকের নাম
আমাদের মাঝে এমন কোন মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না, যার জীবনে কখনো বিষন্নতা বা ডিপ্রেশনে ভোগেননি। জীবনে চলার পথে আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছি। বাড়ছে কাজের গণ্ডি, সেই সাথে সামাজিক, পারিবারিক, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন বা অন্তরঙ্গ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিকূলতা বাড়ছে। তাই বিষন্নতার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আরো অনেক দৈনন্দিন সমস্যা। আমরা কতটুকুই বা জানি এই বিষন্নতা সম্পর্কে?
বিশ্বজুড়ে বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন একটি অন্যতম মানসিক সমস্যা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিষন্নতা বা ডিপ্রেশনকে এক নম্বর প্রতিবন্ধকতা বলা হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে এটি শারীরিক ও মানসিক উভয় রোগের অন্যতম কারণ। শুধু তাই নয়, বিষন্নতা মানুষের মৃত্যুহারকে প্রভাবিত করে। শতকরা ১০-১৫% মানুষ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে এই বিষন্নতার কারণেই। বিষন্নতা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তিন গুণ বাড়িয়ে দেয়। বিষন্নতা থেকে বের হয়ে গেলেই মুক্তি তাও কিন্তু নয়। বিষন্নতা মানুষের জীবনে বারবার ফিরে আসতে পারে। যদি সে ব্যক্তি এই বিষন্নতার সাথে সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনাগুলোকে পরিবর্তন না করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৫০-৮৫% মানুষের জীবনে বিষন্নতা বারবার ফিরে আসে। সুতরাং আমাদের জীবনধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনা ইতিবাচক পরিবর্তন আনাটা জরুরি, যাতে করে আমরা বিষন্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। শুধু তাই নয়, বিষন্নতাকে নীরব ঘাতকও বলা হয়। কারণ এর জন্য আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আমরা সহজেই বিভিন্ন পড়ি যদি আমাদের কর্মক্ষমতা, উজ্জীবনীশক্তি, কর্মস্পৃহা কমে যায় বিষন্নতার কারণে।
ইদানিং দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম, ফেইসবুক, টুইটারে আমরা অধিক সময় অতিবাহিত করছি। পারিবারিক বন্ধন, আত্মীয়-স্বজনের সাথে যোগাযোগ দিনদিন কমে আসছে। আমরা অতি ব্যস্ত থাকি অন্যের জীবনধারা, সম্পর্ক, গতিবিধি পযালোচনা করত, কিন্তু আমরা আমাদের চার দেয়ালের পাশেই কি হচ্ছে পরিবারের লোকজন কে কোথায় আছে, কি করছে সেই ব্যাপারে কোন খবর নিচ্ছি না। আমাদের জীবনটা যেন ভার্চুয়াল জগতে আটকা পড়ে আছে। অন্যের জীবনের সাথে নিজের তুলনা করছে, যা আমাদের আত্মতুষ্ট হতে দিচ্ছে না।
কখন বুঝব আমরা বিষন্নতায় আছি?
নানান ঘটনায় প্রায়ই আমাদের মন খারাপ হয়, অশান্তি হয় বা দুশ্চিন্তা হয়, কিন্তু দেখা যায় সকাল বেলা মন খারাপ থাকলে, রাতের দিকে তা ভাল হয়ে যায় বা বন্ধু-বান্ধবের সাথে কথা বললে ভালো লাগে। অর্থাৎ এ বিষন্নতাটা সাময়িক, আসে আবার চলে যায়।
আপনি যদি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মন খারাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ান, আপনার যদি কিছুই ভালো না লাগে, জীবন নিয়ে যদি হতাশ লাগতে শুরু করে আর প্রতিটা দিনের বেশির ভাগ সময়ই যদি এভাবেই কাটতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আপনি বিষন্নতার শিকার হয়েছেন কিংবা হতে যাচ্ছেন। সেই সাথে আপনার কিছু শারীরিক উপসর্গও চোখে পড়বে। যেমন শারীরিক শক্তি কমে যাওয়া, অনুশোচনা, ঘুমের সমস্যা বা অতিরিক্ত ঘুমানো, ক্ষুধামন্দা বা ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে বা মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা, কোন কিছু মনে রাখতে বা কোন সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হওয়া, অল্পতেই রেগে যাওয়া, আত্মতুষ্টির ঘাটতি বা অভাব, আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করা কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টা করা। অনেক সময় কিছু শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এমনকি চিকিৎসা করার পরও কোন এসব সমস্যার কোনো সমাধান হয় না যেমন: মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা বা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা।
বিষন্নতার মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
বিষন্নতায় আক্রান্ত মানুষটি নিজ সম্বন্ধে, নিজের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে, যা মনোবজ্ঞিানের ভাষায় নেতিবাচক ত্রিমূর্তি বলা হয়। এই নেতিবাচক ত্রিমূর্তি একটি ভ্রান্ত এবং বিষন্নতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি যা একজন বিষন্ন মানুষের চিন্তাধারা, বিশ্বাস এবং সেইসাথে তার আচার-আচরণকে প্রভাবিত করে। তখন তাদের চিন্তাধারায় একধরনের পক্ষপাত দেখা যায়। সে তখন তার ভালো গুণ বা তার অর্জনকে অস্বীকার করে ক্ষুদ্র অপ্রাপ্তিকে বড় করে দেখে। অনেক সময় তারা তাদের কাছের মানুষের বা পরিবার পরিজনের ভালোবাসা, সদিচ্ছা এবং উদ্বেগকে অবমূল্যায়ন বা করুণা মনে করে। এছাড়াও বিষন্নতায় আক্রান্ত মানুষটির মাঝে সাধারণ আরো কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়ঃ
১। কোন ধরনের পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়াই খুব সহজইে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন এবং সেটা আকড়ে পড়ে থাকেন।
২। শুধু এক বা দুইটি নেতিবাচক উপাত্ত বা প্রমাণের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যাওয়া।
৩। নেতিবাচক ঘটনাকে অতি মাত্রায় গুরুত্ব দেয়া এবং ইতিবাচক ঘটনাকে বিবেচনা না করা।
৪। সবসময় ভবিষ্যত সম্বন্ধে নেতিবাচক চিন্তা করা এবং এই ব্যাপারে ভীত থাকা।
৫। সবসময় নিজের অবস্থান অন্যের সাথে তুলনা করা।
৬। নিজেকে বা নিজের ভাগ্যকে সবসময় দোষারোপ করা।
বিষন্নতায় আক্রান্ত হলে করণীয় কি?
আমাদের বিষন্নতার পিছনে কোন বিশেষ ঘটনা বা কোন প্রিয় ব্যক্তিকে হারানো বা বর্তমান জীবনের বিভিন্ন দুশ্চিন্তা প্রভৃতি কারণে হতে পারে। তবে বিষন্নতার পেছনে প্রধান কারণ হলো আমাদের নেতিবাচক চিন্তা। যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে- ‘তাৎক্ষণিক নেতিবাচক চিন্তা।’ বিষন্নতায় থাকাকালীন নিচের বিষয়গুলো চেষ্টা করা যেতে পারে এবং সেই সাথে পারিবারিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। যেমন:
১। কাউকে বিষন্নতাগ্রস্ত হতে দেখলে সেই ব্যক্তিকে একা থাকতে না দেয়া। ছোট ছোট কাজে তাকে ব্যস্ত রেখে তার সাহায্য করা এবং এই জন্য তাকে প্রশংসা করা বা উৎসাহ দেয়া।
২। যে সমস্ত কাজ আগে করতে ভালো লাগত সেই সমস্ত কাজ অল্প অল্প করার চেষ্টা করা।
৩। প্রিয় বন্ধু বা কাছের মানুষের সাথে সময় অতিবাহিত করা বা ফোনে কথা বলা।
৪। বিষন্নতায় আক্রান্ত মানুষ শারীরিকভাবে দুর্বল অনুভব করলে সেক্ষেত্রে একটু শারীরিক ব্যায়াম বা একটু হাঁটলে, শারীরিক ও মানসিকভাবে একটু ভালো অনুভব করেন। তাই এসব ক্ষেত্রে তাদেরকে হাঁটতে বা ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করা।
৫। রিল্যাক্সেশন বা ডিপ ব্রিদিং-এর মাধ্যমে একজন বিষন্ন মানুষ দুই দিক থেকে লাভবান হবেন। এতে করে তার শরীরে প্রশান্তি আসবে এবং ঘুম ভালো হবে।
৬। বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় মন খারাপ থাকার কারণে যে সমস্ত কাজ করতে পছন্দ করতো সেইগুলো করতে না পেরে আরো বিষন্ন হয়ে পড়েন। তারপর একসময় চেষ্টা করাই বন্ধ করে দেন। সেই ক্ষেত্রে তাকে নতুন কোন শখ বা সৌখিন কিছুতে অংশগ্রহণ করাতে পারলে তিনি ভালো বোধ করবেন। যেমন সেটা হতে পারে একটু গাছে পানি দেয়া, টেবিল গোছানো। এমন কোন একটা কাজ তাকে দিয়ে করানো যাতে করে খুব একটা শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে না কিন্তু কাজটি সহজেই সম্পন্ন হয়ে যাবে।
লেখক: কাউন্সিলর, সিআরপি
এম এস ( ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)